প্রত্যেক কাল বা দশকে পূর্বকালের মনীষীদের দর্শন পরিমার্জিত বা সংশোধন হয়ে আসছে অনাদিকাল থেকেই।প্রত্যেক কাল বা দশকে পূর্বকালের সাহিত্য, শিল্পকলা কিংবা চিন্তা চেতনার নব নব উন্মেষ ঘটে থাকে।কখনো কখনো সেটা পরিমার্জন বা কখনো কখনো সেটা পুরোপুরি পরিত্যাজ্যা হয়।নিউটনের সূত্র মতে,'বাহির হতে কোনো বল বস্তর উপর প্রযুক্ত না হলে অর্থাৎ বস্তর উপর বলের লব্ধি শূণ্য হলে স্থির বস্ত স্থির এবং গতিশীল বস্ত সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকে' এবং সেই বল সরবরাহ করেন পিকাসো কিংবা জউনুল আবেদীনের মতোন চিত্রকর কিংবা শার্ল বোদলেয়ার বা জীবনানন্দ দাশের মতোন মহৎপ্রাণ কবিরা।কবিতা একটি স্বতঃস্ফুর্ত প্রণোদনা হলেও এতে কবির দীর্ঘ প্রস্ততি ও নিরন্তর সাধনার প্রয়োজন।এ দু'য়ের সমন্বয় সচরাচর ঘটেনা বলেই প্রতি দশকে মহৎ কবিরা জন্ম নেন না।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতাবাদ পাশ্চাত্যের আধুনিক কবিতার চেয়েও বিস্ময় ও বিপর্য্যয়করভাবে আবির্ভূত হয়েছে।যেখানে একজন মহৎপ্রাণ কবির জন্যে দশকের পর দশক,শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয় সেখানে ১৮৯৯-১৯০৯ সালের মধ্যে বাংলা ভাষায় আবির্ভূত হয়েছেন পাঁচ পাঁচজন আধুনিক মহৎপ্রাণ কবি যথাক্রমে জীবনানন্দ দাস(১৮৯৯-১৯৫৪),অমিয় চক্রবর্তী(১৯০১-১৯৮৬),সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০),বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪) ও বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)।অথচ আমাদের পদাবলী সাহিত্যের বড়ু চন্ডীদাস,চন্ডীদাস,বিদ্যাপতি,জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাস--- এ পাঁচজনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে চার শতাব্দীকাল তেমনি মঙ্গলকাব্যের তিনজনের(মুকুন্দরাম চক্রবর্তী,বিজয়গুপ্ত ও ভারতচন্দ্র রায়) জন্যে তিন শতাব্দীকাল,মহাকাব্যের একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রোমান্টিক কবিতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই 'কল্লোলের কাল'ই হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার জন্মকাল। কল্লোলের কাল বলতে এখানে শুধু 'কল্লোল'ই নয়,কল্লোল,প্রগতি এবং কালি-কলম---এ তিন শাখা নিয়েই কল্লোলের কাল।কল্লোলের সুচনা-১৯২৩, কালি-কলমের সুচনা-১৯২৬ এবং প্রগতির সুচনা-১৯২৭ । এই সময়েই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত বলে সবাই একমত হন।পাশ্চাত্যে ১৯২২ সালে টি. এস. এলিয়টের
'The Waste Land' বা পোড়ামাটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ এবং ১৯২৫ সালে রবীন্দ্র কবি জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়েছে 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং বুদ্ধদেব বসু'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মর্মবাণী'তে(১৯২৫) সালে নূতন কবিতার নান্দীপাঠ করেছিলেন। সুতরাং সকল সাহিত্যবোদ্ধারা ১৯২৫ সালকেই বাংলা কবিতার আধুনিকতার সুচনাকাল হিসেবে গণ্য করেন।
আমরা নিঃসন্দেহে এটা বলতে পারি যে,বিশের দশক হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার ভিত্তিস্থাপন বা জন্মের বছর আর ত্রিশের দশক হচ্ছে প্রতিষ্ঠা লাভের বছর।যদিও বিশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার আত্মপ্রকাশে ছিল অসীম সীমাবদ্ধতা।যে সমস্ত তরুণ কবিরা আধুনিক কবিতার নূতন ফর্ম নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সাহস ছিল বেশী কিন্তু বয়সে নবীন।তাঁদের আত্মপ্রকাশে ও আত্মপ্রচারের সুযোগ ছিল কম।তাঁদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র,শিক্ষার্থী কিংবা নব্য বেকার যুবক।সে সমস্ত বিদ্রোহী তরুণ কবিদের প্রতি তখনকার সাহিত্য শাসকেরা প্রসন্ন ছিলেন না এবং এ সমস্ত কবির কবিতার কাব্যরীতি ও নির্মাণশৈলী (যেমন বুদ্ধদেব বসু’র রবীন্দ্র চর্চিত সাধুরীতি,সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নিও-ক্ল্যাসিক্যাল কাব্যরীতি) রবীন্দ্র মনস্ক কাব্য-পাঠকদের অভ্যস্ত রুচির পক্ষে তৎক্ষনাৎ গ্রহনযোগ্য ও অনুকূল হয়ে ওঠেনি।বিশের দশকের সম্পাদক ও প্রকাশকেরাও সাহস ও দূরদৃষ্টি সঞ্চয় করে রবীন্দ্র প্রভাব বলয় ভেঙ্গে বাইরে আসতে চাওয়া এসব নব্য তরুণ কবি যশঃপ্রার্থীদের পত্রিকার দ্বার কিংবা কাব্য প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতা করেন নি। সমাজে প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক সঙ্গতিহীন দুঃসাহসিক এ কবিগণ স্বীয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ থেকে রবীন্দ্র সাম্রাজ্যের মহাপ্রাচীরে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নবীন কবিতার বীজ থেকে চারাগাছ,চারাগাছ থেকে কিছু কিছু ফসলও তুলতে পেরেছিলেন সে সময়েই অর্থাৎ বিশের দশকে।ফলে গোটা বিশের দশকজুড়ে তরুণ এ সমস্ত কবিদের যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের এবং সর্বপ্রভাবব্যাপী রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে এবং সে সংগ্রামে কবিদের ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার চিহ্ন বিশের দশকের কবিতার অঙ্গে অঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়।ত্রিশ দশকের ইতিহাস হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তরুণ কবিদের সংগ্রামে রবীন্দ্র প্রভাবকে পরাস্ত করে আধুনিক বাংলা কবিতা সুস্থিত হতে পেরেছে।ত্রিশ দশক হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার স্বয়ংবৃত্ত ও দীপ্ততার ইতিহাস।বিশের দশকে যে নূতন কবিতার বীজ রোপণ করা হয়েছিল মাঠ ভরা তার অতুলনীয় ফলন দেখা যায়। ত্রিশ দশকের কবিতায় বিষয়বস্তর ক্ষেত্রে যেমন নূতন এক অভিনবত্ব এসেছে তেমনি কাব্যশৈলীর ক্ষেত্রেও অপরিমেয় বৈচিত্র এনেছেন তরুণ এ সমস্ত কবি তাঁদের সৃজনশীলতায়।তাঁদের এ সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ইউরোপীয় সাহিত্য মনস্কতার ফল।মন ও মানসে রবীন্দ্র চেতনার দুর্দমনীয় প্রভাব অস্বীকার ও নিজস্ব কাব্যরীতি অনুসরনরত ও পাঁচ মহৎপ্রাণ কবি (পঞ্চপান্ডব) ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যালোকেরই নাগরিক।বিদেশী সাহিত্যের অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান,সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব,পাশ্চাত্য সাহিত্যের নান্দনিকতা এমনকি বিচ্ছিন্নতাবোধও তাদের কইতায় স্পষ্ট রুপে ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রত্তোর বাংলাভাষার শ্রেষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন কীটস,এলিয়টস,বোদলেয়ার এবং তারঁ কবিতায় পরিস্ফুটিতভাবে ফুটে উঠেছে তাদের প্রভাব। কীটস যেখানে লিখেছেনঃ
'Much have I travelled'
জীবনানন্দ সেখানে লেখেনঃ
'অনেক ঘুরেছি আমি।' এবং
Then fell I like some watcher of the skies
When a new plannet swims into his ken
Or like start cortez when with eagle eyes
He star'd at the pacific
জীবনানন্দের কাছে হয়ে যায়
'.........অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে;.......'
শার্ল বোদলেয়ার যেমন চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখেছেন,জীবনানন্দও তেমনি মানুষের স্বভাবে দেখতে পেয়েছেন চিল,শকুন,শুয়োরের স্বভাব।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এলিয়টের রুপক ও চিত্রকল্প দেশীয় আবহাওয়ায় তাঁর সৃজনশীল অনুভব দিয়ে নূতন এক মাত্রা দিয়েছেন। যেমনঃ
"O curley,cry no more in the air
Or only to the water in the west
জীবনানন্দ সেখানে লেখেনঃ
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
বুদ্ধদেব বসু যথেচ্ছভাবে ইংরেজী কবিতার চিত্রকল্প ব্যবহার করে আধুনিক বাংলা কবিতায় নূতন এক স্রোত প্রবাহ সৃষ্টি করেন।রসেটি তাঁর 'Trow Town' কবিতায় লেখেনঃ
Look,I bring Thee carven cup
........
Each Twin breast is an apple sweet বুদ্ধদেব বসু'র কাছে হয়ে যায়ঃ
হেলেন রচেছে অর্থ নিজের বুকের ছাঁচে
........।
হেলেনের বুকে দুটি পাকাফল ভরেছে রসে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে চিত্রকল্প ও উপমায় নিয়ে এসেছেন স্বাদেশিক ভাষার নিজস্ব ভাবময়তা।
ভালেরি যখন লিখেছিলেনঃ
All perishes.A thing of Flesh and pore
Am I.Divine impatiebce also dies.
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুরুপভাবে বলেনঃ
মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা
যাতনা শুধুই যাতনা সুচির সাথী।
কিংবা এলিয়টের 'The Burial of the Dead' কবিতায় যখন শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতাকে এভাবে চিহ্নিত করেছেনঃ
April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
বিছিন্নতাবোধের যাতনায় জর্জরিত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁ 'প্রতিপদ' কবিতায় তা বর্ণনা করেনঃ
'সমাপ্ত সংরক্ত রাত্রি।-শ্রান্ত দোলপূর্ণিমার শশী,
....নীড়ে নামে,দেখে,চতুর্দিকে
বাদুড়-পেচাঁর ঝাঁক।অপুষ্পক ত্রিভঙ্গিম নীপ
দুঃস্বপ্নে প্রলাপ বকে,শব-শিবা-সর্পে পরিবৃত।
সমাপ্ত সংরক্ত রাত্রি;চূর্ণমুষ্টি ধূলিধূসরিত।
এলিয়টকে আদর্শ করে বিষ্ণু দে কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন।নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি,ক্লান্ত ও লক্ষ্যহীন জীবন-যাপনে যাপিত এলিয়ট বলেনঃ
What shall we do tomorrow?
what shall we ever do?
The hot water at ten
And if it rains,a closed car at four
And we shall play a game of chass.বিষ্ণু দে'র কাছে তা মধ্যবিত্ত্বের করুণ অবস্থায় পরিবর্তিত হয়।
তারপরে চা এবং তাস
ব্রিজই ভালো,না হয়তো ফ্লাস
ঘোরতর উত্তেজনা,ধূমপান আর্তনাদ,খিস্তি,অট্টহাসি
তারপরে বাড়ি
অম্লশুল আর সর্দিকাশি
এলোমেলো,গোলমাল,ঘেঁষাঘেঁষি,ধোঁইয়া আর লংকার ঝাল।
ইংরেজী সাহিত্যের বিদগ্ধ পন্ডিত অমিয় চক্রবর্তী স্বতঃস্ফুর্ত কবি ভাবনা আমরা দেখি যখন হপকিন্স লেখেনঃ
I caught this morning mornonbg's minion kingdom
Of daylight's dauphin,dapple-dawn-drawn
falcon on his riding
Of the rolling level underneath him steady air and striding
High there,how how he rung upon the rein of a wimpling.
অময় চক্রবর্তী'র কাছে তা হয়ে যায়ঃ
চোঙ।কালো ছলছলে তল,উপরে চাকতি শুণ্যরঙা
ইটের ফাটল লাল জবাফুল সাওঁতাল পিতলের
ঘটি ঘটি রাঙা
গামোছা।গাঁয়ের বউ ছায়ে
কবি কাঁদে কাক ঠোঁট ঘ্যান ঘ্যান দড়ি,যায় ব'য়ে
গ্রীষ্মের কান্নাঃউনোনের রান্না ঘরের জল,ওঁ
চুন সুরকির ভাঙা চোঙ।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১.আধুনিক বাঙলা কবিতা-হুমায়ূন আজাদ সম্পাদিত।
২.জীবনানন্দ দাশ মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার-আবু হাসান শাহরিয়ার।
৩.হাজার বছরের বাংলা কবিতা-মাসুদূল হক।
৪.আধুনিক কবিতার মানচিত্র-জীবেন্দ্র সিংহ রায়।
(ক্রমশঃ)