Powered By Blogger

শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

নকীব

আমি ঈশ্বরকে বাতিল ঘোষণা করলাম
পরিত্যক্ত অন্তর্বাসের মতোন
আর স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যেতে বাধ্য করলাম শয়তানকে;দ্বিতীয়বার
আদমের স্বর্গচ্যুতি ঠেকাবার জন্যে
বেহেশতের সুদৃশ্য,কারুকার্য্যময় দরোজায় সীল
এবং
নরকের অগ্নিশিখাগুলো আকাশের দিকে ধাবমান করলাম।

আমি পাপের ভাষাগুলোর ভার পাহাড়ের শিলাখন্ডের ওপর
আর পূণ্যের হরফগুলো দূর সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম

আজ থেকে পৃথিবীতে সমস্ত পাপের অবসান হল

কবি মৌ মধুবন্তীর 'বাতাসে বৃক্ষপ্রেম':নান্দনিক দৃষ্টিতে

কবিতা ব্যক্তি প্রতিভার আবেগসৃষ্ট।যদিও মানবেতিহাসে আদি কবিতার উদ্ভব---গোষ্ঠিমানসের জমাটবদ্ধ আবাগের ফসল।গোত্র বা গোষ্টির দলবদ্ধ উৎসবগীতেই কবিতার জন্মবীজ সুপ্তাবস্থায় ছিল।জন্মলগ্নে কবিতা ছিল একান্তই ধ্বণি বা ছন্দময়।চেতনার সংবদ্ধতা ও প্রকাশভঙ্গির বলিষ্টতা,ভাষাগত সুষম ও প্রাঞ্জলময়তা এবং আবেগ জারিত আকাঙ্ক্ষার দ্রুন তা হয়ে ওঠে ললিত ও গীতল।কবিতা তথা শিল্পবস্ত মাত্রই আনন্দদায়ক,নান্দনিক সৌন্দর্য্যের প্রকাশ করে।শৈল্পিক আনন্দ একান্তই আত্মোলব্ধিজাত ।দুঃখ,আনন্দ,ভয়,প্রেম,বিরহ,বেদনার সকরুণ সুর যদি কবিতায় থাকে তবে তা পাঠকের আত্মোলব্ধিতে চাঞ্চল্য,বেদনার্ত হয়ে ওঠে। তাই পাঠক সুনির্মল আনন্দ উপভোগ করে কিংবা দুঃখবোধে জারিত হয়ে মনকে স্পষ্ট করে তোলে।এতেই মানুষের আনন্দ,নান্দনিকতা বোধ :
হিরন্ময় এই পথ চলায়
হীরা-পান্নার গতি হোক
শ্লথ;ক্রমশ:জেগে উঠুক
স্বপ্ন কবি----
          এক আঁজলা
কবিতা পান করে----
অবিরাম দৃষ্টিদানে।
(হিরন্ময়)
মৌ মধুবন্তী তার 'বাতাসে বৃক্ষপ্রেম' কাব্যগ্রন্থে এভাবেই নির্ভেজাল নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটিয়ছেন;যা পাঠকচিত্তকে গভীরতম অনুভূতিত টেনে নিয়ে গিয়েছেন।
হানিমুন প্রকাশ গতকাল বাড়ি এসে বললো,
চলো,এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়ি।
ট্রেনটা মিস করলে আর কোনদিন
হানিমুনে যাওয়া হবে না।
কেন?কেন?
কেন আর কোনদিন যাওয়া হবে না?
কারণ,আজ রাতেই তারা
মৌচাকটা ভাংতে আসবে।
(হানিমুন প্রকাশ)
কবিতা শুধুমাত্র একান্ত আবেগানুভূতির ফসল নয়। এ বাস্তব, স্বেদাক্ত প্রাত্যাহিকতায় সৃষ্ট,মেধা, মন ও মননে অবচেতন স্মৃতির অনুবর্তন।মৌ মধুবন্তীর কবিতায় নন্দনতত্ত্বের ভাব-প্রবাহগুলো প্রেম,প্রকৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে ফিরে এসেছে।আর এসব নন্দনতত্ত্বের সূত্রকে তিনি তার কবিতায় আবেগের গ্রন্থিতে গ্রন্থন করে বিনির্মাণ করেছেন এভাবে :
কৃপন বিলাসে পড়ে সবুজ পুঁথি
অবিনাশী স্বপ্ন জমিন,মেঘের লাঙ্গলে চষে
দূরবীণ ফসল,ভাবের জগতে নিয়ে বলে,
এ আমার মাতৃমাতুল,এর নাম কবিতা।
জেনে রাখা ভালো।
(সবুজ পুঁথি)
কিছু কিছু মানুষ জন্মান  শ্রমজীবী,সর্বহারা মানুষের প্রতি দুর্নিবার ও প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে।নিঃসন্দেহে এঁদের সংখ্যা অতি অল্প,নগন্য পরিমাণে।অস্থির,টালমাটাল চলমান এ সময়ে ভালোবাসাহীনতাই মেদ-মাংশে স্ফীত হওয়ার একমাত্র উপাদান।এই স্বল্প সংখ্যক মানুষেরা এখানে কোন স্বস্তিবোধ করেন না।তাঁদের অনুভবে গভীরভাবে ধরা পড়ে অন্ধকার এক অরণ্যের ভয়ংকর,স্বার্থান্ধ,শুভবুদ্ধিহীন হিংস্রতা।মৌ মধুবন্তীর 'জঙনাম' কবিতার সুস্পষ্ট বক্তব্য,বাচনভঙ্গি ও শ্রেয়শের বোধ তা নিশ্চয়ই চলমান এ সময়ের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ,স্পর্ধিত ধারা।তার এ কবিতা পাঠকের অভিজ্ঞতার জগৎকে প্রসারিতার প্রগাঢ় মানবিক রসের অভিসিঞ্চনে পাঠকের হৃদয় অভিভূত হয়ঃ
.......দুর্বৃত সময়ের দুর্ব্যেধ্য চেহারার
সমিল বন্ধন খুলে বেরিয়ে আসুক
পাথুরে পথের কঠিন সংগ্রাম।
তারপর মানুষের গান লিখে লিখে
মুছে নিয়ে বুকের রক্ত,খুন-লাল;
লিখা  হবে নতুন জঙনাম ।
(জঙনাম')
কিংবা
মানুষ কখনো অসহায় নয়
দুর্যোগে সব হারিয়ে পথে
বসে;পায় নাকো ভয়
আবার আশায় বুক বেঁধে
পথে নামে
পথের উপরেই নতুন করে
ঘর বাঁধে
(পথ বাঁধে)
মৌ মধুবন্তী।বাস্তব থেকে এক অসীম পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করে তার মিথ ভাবনা;আধুনিক শিল্প ভাবনা,ইতিহাস ও মিথের সংশ্লেষণতার গভীর এক চেতনার জন্ম দেয় তার কবিতা।নান্দনিক ভাষার প্রত্যক্ষ প্রদর্শন ঘটিয়ে সযত্নে কবিতা বিনির্মাণ করেন করেন কবিতা;যা নূতন চিন্তা-পূরণো ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে পূরণোকে পরাস্ত করে নূতন এক চেতনার সৃষ্টি করে এবং প্রচলিত একরৈখিকতার বর্গকে গুঁড়িয়ে বহুরৈখিকতাকে আশ্র্য় করেছেন তার 'বেহুলা বহুব্রীহি'কবিতায়;যাতে একক ব্যক্তির কথা নেই,আছে সামষ্টিক সমস্ত নারী তথা মানুষের উপস্থিতির কথা আর শেণী যেখানে সমষ্টি বা জোটবদ্ধ;সেখানে নৈরাশ্যে উপক্ষিত।জীবনে ব্যর্থতার পাশাপাশি প্রবল আশাবাদও অস্ত্বত্মান।তবে শুধু আশাবাদকে আঁকড়ে থাকলে জীবনে শূণ্যগর্ভতা অনুভব করে আবার শূণ্যতাই একমাত্র তত্ত্ব ----মেনে নিলে উভয়েই ব্যর্থ।প্রবল শূণ্যতা ও আশাবাদ---এ দু'ইয়ের স্বার্থক মিলন দেখি কবির অভিজ্ঞান,দার্শনিক চেতনা,আত্মরতিমূলকভাবে একটি অপরুপ নান্দিনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেঃ
বিকেলটা গড়াতে গড়াতে
সময়ের কলস থেকে
সব জল উপুড় করে ঢেলে
দিল অন্ধকারের নদীতে
বেহুলা এবার প্রস্তুত হও
কল্পণার ভেলা নিয়ে...।
(বেহুলা বহুব্রীহি)
মৌ মধুবন্তী জীবনের পরিচর্যা করেন জীবনের অস্থির সময়,ক্ষয়িষ্ণু রুপ,ক্লেদ আর গ্লানিকে দৃশ্যমান করার মানসে।যুগ মানসের যন্ত্রণা,নৈঃসংঙ্গ,একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার সূত্রের প্রয়োগ করে স্বার্থকভাবেই তার কবিতায় নন্দনচেতনাকে দার্শনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন এভাবেঃ
আমি আলতা পরা পা দিলাম তোমাকে
তুমি আগুনে ঝলসে দিলে....
মেহেদী রাঙা হাত দিলাম তোমাকে
তুমি বৈধব্যের কামড় বসিয়ে দিলে
আমি উত্তপ্ত দুপুর দিলাম;
এক ফোঁটা জল দিতে পারো নাই,
আগুনও না
তুমি একটা নুব্জ্য প্রকৃতি,
....আদতেই তুমি নিঃস্ব।
(আদতেই তুমি নিঃস্ব)
কবিতাই পারে আমাদের হৃদয়ের গভীরে আত্ম-প্রতিফলন ঘটাতে।নান্দনিক ভাষার প্রত্যক্ষ প্রদর্শনে নিজেই হয়ে উঠতে পারে আরেক ভাষা।আর এ ভাষা নিজের নির্দিষ্ট অর্থের ভেতর বিশেষ অনুভব ফুটিয়ে তোলে,তখন বানানো অর্থের সঙ্গেস্পষ্ট বিরোধ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে আর তখনই মানুষের মাঝে আত্ম-প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওথে।মৌ মধুবন্তী মূলতঃ আবেগের সুক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে চষে বেড়ান কবিতার লাঙ্গল।স্পর্শ করার ক্ষমতা একান্ত নিজস্ব।মৌ মধুবন্তী শব্দ দিয়ে কবিতা এমনভাবে নির্মাণ করেন যাতে পাঠক চেতনার মর্মমূলে প্রবাহিত থাকে পাহাড়ী ঢলের মতোন;এখানেই তার কবিতার নান্দনিকতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠেঃ
এইটুকু প্রেম বৃক্ষের!
এইটুকু প্রেম বেদের জমিন
খুঁটিয়ে খেয়ে নাও পালক বিহীন
'প্রেম' লোকপাদ্যে লিখা কথা
শেকড়ে গুঁজে দিলাম
নিষুপ্ত ব্যথা,
(বৃক্ষপ্রেম)

ঈশ্বরের শেষকৃত

ঈশ্বরের শেষকৃতে সৌম্য,গম্ভীরমূর্তি পাদ্রীরা
ধীর,স্পষ্ট উচ্চারণে স্তব করছিল
এবং কালো পোষাকে আবৃত যাজিকারা
বিষন্ন,করুণ সুরে বেদনার চান্দ্রগীতি চারিদিকে
ছড়িয়ে দিচ্ছিল আর তখনই মুক্তির আনন্দে
পাইনের ডাল থেকে একঝাঁক পাখি
খোলা আকাশের দিকে উড়ে গেলো,---
তাদের দীঘল ডানা থেকে টুপটাপ খসে পড়ছিলো
কিছু পালক সুদৃশ্য কফিনের ওপর;হয়তো
পেরেকের প্রয়োজনে
গোধুলির আলো শেষ পেরেকটি ঠোকার আগেই
প্রবল তুষারপাত গোটা উপত্যাকা শুভ্রতার বিশুদ্ধ চাঁদরে ঢেকে দিলো

রহমান হেনরীর 'আদোনিসের কবিতা':উত্তরাধুনিক দৃষ্টিতে

কবিতার কোন অনুবাদ হয় না,বড়জোর তাকে ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে। এক ভাষা থেকে আরেকভাষায় ভাষান্তরিত করা নিঃসন্দেহে একটি দূরহ সাহিত্যকর্ম।বিশেষতঃ কবিতার ক্ষেত্রে।এটা কেবল ভাষান্তর বা পূণঃলিখন নয়।মূল কবিতার ভাব অক্ষুন্ন রেখে পূণঃবিনির্মাণ;যাতে থাকে কবির মানস ও প্রকৃত অভিব্যক্তি।অনুবাদ কবিতা সম্পর্কে জাপানী কবিতার আলোচক হ্যারী গার্ষ্ট বলেছেন,মূল থেকে অনুবাদের দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রে পরিমাপযোগ্য নয় কিংবা চীনা কবিতা বিশেষজ্ঞ আর্থার কুপারের মতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কবিতা কোন সময়েই অনুবাদ করা যায় না । অনুবাদে সব সময়েই মূল কবিতার কিছু না কিছু হারিয়ে যায়।তবে '৯০ দশকের শক্তিমান কবি রহমান হেনরী তাঁর বাঙলায়নকৃত ( উল্লেখ্য বাংলা কবিতায় এটি একটি নূতন শব্দ;যা রহমান হেনরী ব্যতীত ইতোঃপূর্বে আর কেউ ব্যবহার করেন নি) আদোনিসের কবিতা কাব্যগ্রন্থে উচ্চারিত বক্তব্য ও পারি-পার্শ্বিকতার প্রতি দৃষ্টি রেখে বাঙলায়নকৃত কবিতাগুলোর মূল বক্তব্য ও বৈশিষ্ট্য স্বীয় প্রতিভায় ধরে রেখেছেন।

কবিতার কোন দেশ-কাল নেই।কবিতা স্বয়ম্ভু।অন্যান্য কবিতার ভাব,প্রকার,পকরণে ও পারস্পরিক রসায়নে আমাদের বাংলা কবিতাও অভিনব উপস্থাপন,বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট বক্তব্য ও নান্দনিকতায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশেষ স্থান ও উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দুতে পৌছুবার অপেক্ষায় অপেক্ষমান।গত শতাব্দীর দু'দুটো মহাযুদ্ধ মানুষের চিন্তা ও চেতনার জগৎকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়।এ সময়ে ও পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ ও সামাজিক আন্দোলন বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে রোমান্টিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আধুনিকতার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়ে বিচিত্রমূখী নিরীক্ষা ও কবিতা আন্দোলনের পথ খুলে দিয়ে এক নূতন দিগন্তের দরোজা খুলে নূতন নূতন তত্ত্ব ও কবিতা আন্দোলনের পথ গতিশীল করে তুলেছে।বিট সাহিত্য আন্দোলন,হাংরি জেনারেশন,কংক্রিট কবিতা আন্দোলন, সিম্বলিজম, মডার্নিজম,পোষ্ট মডার্নিজম,পোষ্ট স্ট্রাকচারালিজম,কিউবিজম,ভ্যাঙ্গার্ডিজম,দাদাইজম,সুরিয়ালিজম, প্রভৃতি আন্দোলন গড়ে উঠেছে দেশে দেশে।কবিতার এমন নিরন্তর পালাবদলে কবিতার নূতন আঙ্গিকতা ও বিকাশময়তার স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণার জন্যে বিদেশী বা আন্তর্জাতিক কবিতা পড়ার কোন বিকল্প নেই।উত্তরাধুনিক পৃথিবীর সূচনা শতকে একবিংশ শতাব্দীর কবি ও কবিতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্যে কবি রহমান হেনরী নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরে 'দি সোসিও লজিক্যাল ইমাজিনেশন' বইয়ে সি.রাইট মিল লেখেনঃযাকে আধুনিক যুগ বলা হয় তার শেষে মানুষ উপনীত হয়েছে।অনন্ত 'পোষ্ট মডার্ন' বা বাংলায় যা উত্তর আধুনিক বা উত্তরাধুনিকতা এর সামনে উপস্তিত আমরা। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবোধ আর শৃঙ্খল্মুক্তি এতোদিন যে উদারতা আর সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে,আজ তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে অসওয়াল্ড স্পেংলার তাঁর ' দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট' বইয়ে লেখেন,পাশ্চাত্যের সভ্যতা আর তার মূল্যবোধ,দায়িত্ব এবং সংস্কৃতি দুর্গন্ধময় পচনে নিমজ্জিত।

এ রকম অস্থিতিশীল সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিস্তিতিতে উত্তরাধুনিকতার উদ্দীপক প্রতিভূ জঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার ' দি পোষ্ট মডার্ন' লিখে ঘোষণা করেন :মহা-আখ্যান ও পরা-আখ্যানের কাল শেষ।ওসব আখ্যানের বৈধতার প্রতিশ্রুতি লুপ্ত ও নির্বাপিত। উল্লেখ্য যে,এ মহা-আখ্যান/পরা-আখ্যান হলো কান্ট,হেগেল,মার্কসের দর্শন।

১৮৭০ সালে ওয়ট কিনস চ্যাপম্যান নামে এক চিত্রকর সর্বপ্রথম'পোষ্ট-মডার্নিজম' শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ফরাসী ইমপ্রেশনিস্ট চিত্র অপেক্ষা আরো আধুনিক,আরো অভাঁ-গার্দ ছবির ক্ষেত্রে এই অভিধা প্রয়োগ করেন। তারওপ্রে ১৯১৭ সালে এসে Rudolf Pannwitz একটি বইতে নিহিলিজম ও সে সময়কার ইউরোপে সব মূল্যবোধ ভেঙ্গে যাওয়ার বিবিরণ দিতে গিয়ে তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন।

রবীন্দ্র যুগের রোমান্টিক ধারার বিরোধীতা করেও তাঁর দৈশিক ও বৈশ্বিক ভাবনা,চিন্তন,মেধা ও মননশীলতা অনুসরণ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু তরুণ কবি নূতন ধারার এক কবিতা চর্চা শুরু করেন;যা আধুনিক কবিতা ( যার সূচনাকাল ১৯২৫ সাল)।এ আধুনিক কবিতার ফর্ম বা কনটেক্সট তড়তড়িয়ে এগিয়ে চলে অর্ধ শতাব্দী কালেরও কিছু বেশী সময়। তারপর বাংলা তথা বিশ্ব কবিতার ইতিহাস এক দীর্ঘ বাঁক নেয়;এর নাম উত্তরাধুনিকতা।এ উত্তরাধুনিক শব্দটি সম্পর্কে অনেকের দ্বিমত,বিভিন্ন তাত্ত্বিকের নানাবিধ বিশ্লেষণ,এর সার্বজনীন ব্যাখ্যা বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে নানা তর্ক-বিতর্ক প্রতিনিয়ত চলে আসছে এবং প্রায় তিন দশক কালেরও অধিক সময়ব্যাপী হয়ে এল এ তর্কের মীমাংসা এখনো শেষ হয় নি অর্থাৎ আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি কবিতার অবস্থান;আদোনিস স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ করেন :

তোমাদের এ ভাষায় কথা বলে না সে।
চেনে না,নিষ্ফলা-পতিত ভূখন্ডগুলির কন্ঠস্বর---
পাথুরে ঘুনের কর্ণকুহরে আগাম-নিগুমের বয়ানকারী,
অনাগত-সুদুরের অজস্র ভাষায় ভরপুর সে।

এখানে,এই ধ্বংশস্তুপতলে সে এলো
অভিনব শব্দাবলীর সুবাতাস বইয়ে দিতে,
সে,তার,ঘষাঁমাজাহীন অথচ চকচকে পেতলের পাতের মতো
কবিতাবলী,তুলে ধরছে মর্মাহত বাতাসের উদ্দেশ্যে

মাস্তলে মাস্তলে অভাবনীয় স্ফুলিঙ্গ-উদ্ভাসনের ভাষা,
অশ্রুতপূর্ব শব্দাবলীর নকীব,সে।
(নতুন নিয়ম)

মানুষ স্বভাবতঃই ক্ষমতালিপ্সু।সেই প্রস্তরযুগ থেকেই মানুষ সুযোগ পেলেই অন্যের ওপর প্রভাব বা আধিপাত্য বিস্তার করে অন্যকে নিজের অধীন করে নিচ্ছে।এতে খর্ব হচ্ছে ব্যক্তি-স্বাধীনতা।আর এই স্বাধীনতা বিপন্ন হচ্ছে ক্ষমতার দ্বারা ফলে সৃষ্টি হচ্চছে ক্ষোভ, তৈরী হচ্ছে দ্বন্দ্ব,ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন মানুষের মনে।ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন মানুষ সচেতন তার এই স্বাধীনতাহীনতায়।উত্তরাধুনিকতার ভালো দিকগুলোর একটি হল ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে একেবারে সামনে নিয়ে আসা।কর্তা ও অবনত পক্ষের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তারা সচেতন।উত্তরাধুনিকেরা মনে করেন ক্ষমতা মাত্রই দুঃশাষনকারী।ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তথা রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা তাদের লক্ষ্য কিন্তু বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার রুপান্তর ঘটাতে তারা চান না।তাদের লক্ষ্য স্থির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু নয়,পরিধির মধ্যে প্রতিরোধ করে ক্ষমতাকে দুর্বল করে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে গুরুত্ববহ করে তোলা :

দুনিয়াটাকে মুক্ত করে দিলাম আমি আর কারারুদ্ধ করলাম সাত আসমানকে
আলোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো বলে লাফিয়ে নামলাম;দুনিয়াকে দ্ব্যর্থক,
মনোমুগ্ধকর,পরিবর্তনীয় আর বিপজ্জনক করে তুলবো বলে,প্রচলিত
পদক্ষেপের বাইরে নূতন এক পদযাত্রা ঘোষণা করবো বলে,লাফিয়ে নামলাম।
.............
..........
(জগতের প্রান্তসীমায়)

আমরা বাস করছি উত্তরাধুনিক বিশ্বে।সময়ের সাথে সাথে পালটে গেছে চিরাচরিত লোকায়তপ্রথা,বিশ্বাস ও  বিশ্বও।আমাদের চিন্তা,চেতন ও মননকে নাড়া দিয়ে যায় মিশেল ফুকো,জ্যাক দেরিদা,রোঁলা বার্ত,লেভি স্ট্রস প্রমুখ চিন্তাবিদদের ভাবনা ও তত্ত্ব। উত্তরাধুনিকতার মূলমন্ত্র হল সৃজন নয়,বিনির্মাণ।উত্তরাধুনিক পূর্বকালে পাঠক ছিল লেখকের আজ্ঞাধীন কিন্তু এখন লেখক নয়,পাঠ ও বিষয় পাঠকের হাতে।আর এই মননজগতের নূতন ভাষা,'পাঠকৃতি';যা গড়ে উঠেছে বিখ্যাত ভাষাতাত্বিক ফার্দিনান্দ দ্য সোস্যুরের ভাষাতত্ত্বকে ধারণ করে।একবিঙ্গশ শতাব্দীর মানুষ কেবল অর্থনীতি বা যৌনের দ্বারা শাষিত নয় বরঞ্চ নিয়ন্ত্রিত ভাষার দ্বারা:

উত্তরাধিকার জ্বালিয়ে দিচ্ছি আমি,বলছি,
''অপ্ত্য-অক্ষত' এ ভূমি আমার যৌবন এখানে কোনও কবর ছিলো না''।
ভগবান ও শয়তান উভয়কে ছাপিয়ে উঠছি
(আমার চলার পথ ভগবান ও শয়তানের পথভূক্ত নয়)
আমি আমার কেতাবের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি,
বজ্রের দীপ্তিময় শোভাযাত্রার ভেতর দিয়ে,
সবুজ বজ্রের শোভাযাত্রার ভেতর দিয়ে
যেতে যেতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিঃ
''আমার পর এখানে থাকবে না কোনও বেহেস্ত,থাকবে না স্বররগচ্যুতি''
আর আমি মুছে দিয়ে যাচ্ছি পাপের ভাষাগুলি
(পাপের ভাষা)

উত্তরাধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ হল self-reflexiveness  বা আত্ম-প্রতিফলনঃ

২.
যদি আবারও শুরু হতো নতুন সময়,
আর জলরাশি হু হু করে ছুটে আসতো জীবনের মুখে,
আর কেঁপে উঠতো দুনিয়া,এবং যদি এমন হতো যে,খোদা তা'আলা
ত্বরিত সিদ্ধান্তে,অনুময় করে বলতেন আমাকে,''নূহ,প্রাণীগুলোকে বাঁচাও।''
সেই অনুরোধে কর্ণপাত করতাম না আমি।
আমার জাহাজটি চালিয়ে দিতাম,মৃতদের চোখগুলো থেকে
কাদা ও নুড়ি সরিয়ে সরিয়ে
তাদের ভেসে যাবার পথ সচ্ছন্দ করে দিতাম
আর তাদের শিরায়-ধমনীতে ফিসফিসিয়ে বলতাম,
উন্মত্ত বন্যতা থেকে ফিরে এসেছি আমরা,
বলতাম,গর্ত থেকে জেগে উঠেছি,
বলতাম,শতাব্দী প্রাচীন আসমানসমূহ পালটে দিয়েছি,
বলতাম,ভয়ের কাছে আত্ম-সমর্পন না করে,পাল তুলেছি---
বলতাম,ওই খোদার কথায় কান দিইনি আমরা।
বরং সাক্ষাৎকার-সূচি নির্ধারণ করেছি মৃত্যুর সাথে।
আমাদের গন্তব্য,সুপরিচিত সেই  নিরাশা-তাড়ানো উপকূলের দিকে
লৌহজলের বরফশীতল এক সমুদ্র পেরিয়ে
অপ্রতিরোধ্য,প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা,
সে খোদা আর তার কথাগুলোর কর্ণপাতহীন;
অন্য কিছুর প্রত্যাশায়,নতুনতর এক খোদার আশায়।
(নব্য নূহ)

কিংবা স্পষ্ট,সহক,সরল বলিষ্ঠ উচ্চারনঃ

যখনই বলিঃ
বয়স হয়ে যাচ্ছে আমার,অগ্নি যন্ত্রণার ক্ষতগুলো এসে ছিড়ে-খুঁড়ে ফ্যালে আমাকে,
প্রবল এক শঙ্কা শিহরণ ঝাঁকুনি দেয় মনে,
তারপর,ভোরবেলাকার তারুণ্যদীপ্তি এসে
আমাকে পরিয়ে দেয়
তার বেশভূষা।

নীৎসে ঘোষণা করেছিলেন ঈশ্বর মৃত্যুবরণ করেছেন অর্থাৎ রঙ্গমঞ্চে নায়কের আর প্রয়োজন নেই।দর্শকদের মধ্য থেকেই উঠে দাড়াঁতে হবে নায়ককে অর্থাৎ ঈশ্বরের স্থান পূর্ণ করবে মানুষ,অতি মানুষ।য়্যুরোপে রেনেসাঁর কাল হল মানব জাগরণের, মানবমুক্তির। মানুষ যে শুধু ঈশ্বরকে অস্বীকার করা শুরু করল শুধু তাই নয় তাকে অপ্রয়োজনীয়,বাতিল বস্ততে পরিণত করে মানুষ নিজেকেই ঈশ্বরের স্তরে উপনীত করে ফেলল।অপার সম্ভাবনাময়ী মানুষ নিজেই তার সৃজনশীলতা দিয়ে বিনির্মাণ করবে মহাকাব্যেরঃ

শব্দহীন আর্তনাদের মতো,নিরস বায়বীয় স্বরে
আদম আমার কানে মুখ রেখে বললোঃ
''জগতপিতা নই আমি,
বেহেস্ত আমি চোখের দেখাও দেখিনি।
স্রষ্টার কাছে নিয়ে চলো আমাকে''

কিংবা

................
................
আমাদের ভূ-খন্ডে ছিলো এক ঈশ্বর
কিন্তু আমরা পরিত্যাগ করেছিলাম তাকে
যখন থেকে সে নিজেই একটা দূরত্ব রচনা করেছিলো
আমাদের সাথে।
তার পশ্চাৎদিকে,আমরা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম
মোমের মন্দির আর বলিদানের রীতি।
আর অবিদ্যামানতার ভেতর থেকে
গড়ে-পিটে বানিয়েছিলাম ধূলির এক দেব প্রতিমা
এবং বিদ্যমানতা দিয়ে তাকে করে তুলেছিলাম পাথর প্রতিম
নতুন সেই এক পথ যা সুচিত প্রায়।
আহ,পথ,যা অসীকৃতি জানায় সূচিত হতে।
(একটা পথ)

বিনির্মাণ বা de-construction এর নিকটতম শব্দ বিশ্লেষণ বা  analysis.জ্যাক দেরিদার বলেছেন,....পাঠকৃতির মধ্যে নিজস্ব নিয়মেই তৈরী হয় তার অনুবিশ্ব এবং সেই অনুবিশ্ব সমগ্রের স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকে যে সব টুকরো টুকরো চিহ্ন বা স্মারক,বিনির্মাণের ধারায় তাদের ওপর সমীভূত হয় মননশীলতার আলো অর্থাৎ এ সব পাঠে আপাত প্রচ্ছন্নতার চূর্ণভষ্ম থেকে উঠে আসে এক সমগ্রের উজ্জ্বল আলোকিত মিনারঃ

পৃথিবীর ভেতরে একটা দুয়ার খুলে দিই
আর স্থাপন করি বিদ্যমানতার গনগনে শিখা
পরস্পরকে আড়াআড়ি ভেদ করে যাওয়া কিংবা আকাশময়
পথনিশানার মত ছুটন্ত ওইসব মেঘেদের মধ্যে
সমুদ্রে এবং তার মোহময় ঢেউগুলি জুড়ে
পাহাড়ে পাহাড়ে আর তাদের বনভূমিময়
আর পাথর ও শিলাখন্ডগুলোর অন্দরে
গর্ভবতী রাত্রিগুলোর জন্য
একটা জন্মভূমি বানিয়ে
শেকড়-বাকড়ের ছাইভস্মে
সঙ্গীতময়তার খোলা যত প্রান্তরে প্রান্তরে
বজ্রধ্বনি ও বজ্রপাতের ভেতরে
এবং এইসব অগ্নিকে খেতে দিই
যুগ-যুগান্তের মমিগুলো।
(বিদ্যমানতা)

উত্তরাধুনিক ভাববাদী কল্পণার নিগূঢ়ে আবদ্ধ নয়,বীক্ষণ আর অন্তঃবীক্ষণের কৌশলে ঐতিহ্য,চিন্তা,চেতন ও মননে চির সম্প্রসারণশীল এক অসীম সৌন্দর্য্যের আধারঃ

পরিভ্রমণরত
অথচ থেকে যাচ্ছি স্থির।
ও সূর্য্য,
কী প্রকারে তোমার পদচারণের
সমকক্ষ হয়ে উঠবো আমি
(পরিভ্রমণ)

উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম দাবী pluralism বা বহুরৈখিকতা।একরৈখিকতার কেন্দ্রকে গুড়িঁয়ে ভাষার এক অনির্দিষ্ট যাত্রায় উত্তরাধুনিকতা:

উপাসনা করছি এই শান্তিময় পাথরের
ঘর প্রস্ননমুখে চোখ রেখে আমি দেখতে পাই
নিজের মুখটি
আর আমার হারানো কবিতাবলী
(একটা পাথর)

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

কঙ্কা জামিলের 'সেদিন আকাশ এসেছিল' :বিচ্ছিন্নতার স্বরুপ।

আধুনিক মানুষ ছুটে চলেছে এক মহাশূণ্যতার দিকে,অসীমতার দিকে ধাবমান বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত একপাল মানুষ।আধুনিক মানুষ তার সীমাবদ্ধতা জানে কিন্তু মানে না অথচ সীমা লঙ্ঘন তার পক্ষে দুঃসাধ্য।ফলে জন্ম নেয় মনোজাগতিক এক দোদ্যুলময়তা। আসলে গত শতাব্দীর দু' দুটো অর্থহীন মহাযুদ্ধ মানুষের চিরন্তন মৌল বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে চিন্তা চেতনার জগতে আনে ব্যাপক পরিবর্ত্ন।মানুষ ক্রমেই ঈশ্বরবিমুখ হতে শুরু করে,সামাজিক রীতি-নীতি প্রহসনে পরিণত হয়,ভেঙ্গে যেতে থাকে যুথবদ্ধ পরিবার,মানুষ ক্রমেই নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে।তদুপর পুঁজিবাদী সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে মানুষের ব্যক্তি-সচেতনতা,ব্যক্তি-স্বাধীনতার সমস্যা ও অস্তিত্ব সংকটের যন্ত্রণায় মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবোধে জর্জরিত হতে থাকেঃ
..............
কোনও কোনও দিন
আঙ্গুলগুলো নিশ্চল থাকে তানপুরার তারে
অলস চোখ ঝিমায় বই এর একটা পাতায়
বেলির গন্ধ কী ভীষণ ঝাঁঝালো মনে হয়
গরম চা,ঠান্ডা সিরাপ একাকার হয়ে যায়
জীবনের টুকরা কথা
অসার বক্তৃতার মতো বাজে!!!
(কোনও কোনও দিন)

এমোন্ন পরিস্থিতে মানুষ অন্যের দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়।তার চিন্তা, চেতন ও মননে শংকা ও উদ্বেগ ভর করে। মানুষ ক্রমশঃ স্বীত সত্বা,ব্যক্তিক,পরিবার ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ফলে বিচ্ছিন্নতা বোধে জারিত থেকে স্বগত,অস্ফুষ্ট উচ্চারণ করেঃ

.............
ওর গায়ে দাগ আছে জানি
এও জানি,ওখানে একটা ক্ষত আছে
নিজেই গুলি ছুড়েছিলাম যে
এখনো থেকে থেকে রক্ত ঝরে
তবু দ্বার খুলি না সহজে
এ ব্যাথা,এ দাগ সারবে কোন মলম বা ওষুধে
(সেদিন আকাশ এসেছিল)

এবারের বইমেলায় প্রকাশিত কবি কঙ্কা জামিলের 'সেদিন আকাশ এসেছিল' কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবি মানস নির্লিপ্ত নিমজ্জন থেকে নিসর্গ নিবিড়ভূবন থেকে,নশ্বরতার পীড়া থেকে নৈরাশ্যপীড়িত স্বভাব থেকে,মানবচেতনে জাগ্রত নৈঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নতার এক অনুপম চিত্র দেখতে পাইঃ

জানি তুমি ফিরবে না
তুমি ফিরতে জান না
আমার সব ইচ্ছাগুলো পায়ে দ'লে
চলে যাবে;রেখে যাবে
ভাঙ্গা তানপুরার মর্মবেদনা
পোড়া বাড়ির হাহাকার আর
শূণ্য খেয়ার একাকিত্ব
(জানি ফিরবে না)

কবি কঙ্কা জামিল শান্ত,সৌম্য ও বিচ্ছিন্নতাবোধে আবেগাতাড়িত হয়ে হারিয়ে যাওয়া জীবন আর প্রিয় মানুষের মুখচ্ছবি নিয়ে বেদনার্ত হয়েছেনঃ

তুমি-ই ছিলে আমার পৃথিবী
তবু এক নিষ্ঠুর খেলা খেলতে
কেবল হারিয়ে যাবার ভয় দেখাতে
থরথরিয়ে কেঁপে উঠতাম,আমি এক ভয়ার্ত পাখির ছানা
আহত বিড়ালছানা হয়ে তোমার বুকে মুখ লুকাতাম
আর্তনাদ করতাম,তীর বেঁধা হরিণ শাবকের মতো
কী সুখ পেতে তুমি,মা....

কিংবা

আমার মনের ক্যনভাসে এখন দাদুই অসমাপ্ত ছবি
নেই তেমন রঙ বা শৈলী
যা দিয়ে ছবি শেষ করতে পারি
মনের আবেগ ও আকুতির কাছে.....
সব রঙ ফিকে হয়ে আসে।
(অসমাপ্ত ছবি)

নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গ পীড়িত বিচ্ছিন্নতাবোধে ভারাক্রান্ত একটি কবিতাঃ

ফোলা ফোলা লাল চোখ,দেখলেই বুঝি
গতরাতে ছেলেকে স্বপ্নে দেখেছে
আট বছর হল একমাত্র সন্তান নিরুদ্দেশ
মুখ বলে বেঁচে নেই
বুকের গহীনে জানি,জমে আছে গোপণ আশা।
স্বপ্নের হাত ধরে কাছে আসে
ঘুম ভাঙ্গে,লুটিয়ে পড়ে বাঁধভাঙ্গা কান্নায়
(কবিতা যদি)

ঈশ্বরে অবিশ্বাস বিচ্ছিন্নতাবোধের দ্বিতীয় কারণ।(প্রথম কারণটি হলঃমাতৃজঠর থেকে নাড়ীচ্ছেদের ফলে মানবশিশুর জন্মগ্রহণ।) তবু মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই ঈশ্বর আরাধনার মাধ্যমে মুক্তির পথ খুঁজে ফিরেছে বারে বারে ঃ

হে ঈশ্বর,ভালোবাসার এক সুনামী দাও
অন্ধত্বের কালি,ঘৃণার তুষাণল,বিদ্বেষের প্রাচীর
ভাসিয়ে নিয়ে যাও
(হে ঈশ্বর)

যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্য্যয়ের ফলে সকল মূলয়বোধের প্রতি আধুনিক মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিচ্ছিন্নতা আর নিরর্থকতাবোধে আক্রান্ত মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে সমস্ত প্রত্যয় ও প্রমূল্যেঃ

সীতা পেরেছিল......
প্রেমের ফসল একা একা ঘরে তুলতে
যত্নে লালন করতে
স্বামী-পুত্রের মিলন ঘটিয়ে
সংসারত্যাগী হয়েছিল,হয়তো অভিমানে
(আজকের সীতা)

কবির প্রতিকৃতি:সরদার ফারুক

যখন আমরা একটা অস্থির সময় পাড়ি দিচ্ছি,মানুষের সু-কোমল মানবিক মূল্যবোধগুলো ক্রমেই ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে,সর্বগ্রাসী এক ধ্বস নেমে আসছে আমাদের ব্যক্তি,সংসার ও সমাজ জীবনে,প্রেমের চিরন্তন,শ্বাশত বাণী,রমণীর রমণীয় রুপ কোথাও আস্থা রাখা যাচ্ছে না;তখন কবি সরদার ফারুক গেয়ে ওঠেন:

এখানে দুঃসহ দিন,জলের অভাবে
গাছগুলো পুড়ে গেছে,ওখানে অনন্ত
ঝর্ণা বয়ে যায় ?

তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে অদ্ভুদ এক ঘোর এনে দেয়। যখন তিনি বলেন:

আড়মেন্দি,ঢোল কলমির
ঝোপ পেরলেই হাইওয়ে
সব পথ গেছে
                  শহরের দিকে ।
কবির এ স্বগদোক্তি কি অনাগত ভবিষ্যতের বা নূতন পথযাত্রা্র দূরবর্তী হাতছানির না কি দুঃখী বাংলার চিরায়ত দারিদ্রপীড়িত গাঁ গ্রামের চিত্র:

গ্রামে ভাত নেই
শীতের কামড়,ছাড়া ভিটে
ভরে আছে তেলাকুচা ফুলে।

তীব্র সংবেদনশীল কবি সরদার ফারুক সচেতনভাবেই হতাশ নন।ভাবালুতায়ও তিনি আক্রান্ত নন,নন মধ্যবিত্ত্ব পলায়নী মানসিক প্রবৃত্তির।সমাজ সচেতন ও মানবপ্রেমিক কবি সরদার ফারুকের রয়েছে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি   সীমাহীন অভিমানঃ

..................
..................
পথ থেকে সরে গিয়ে বিপথেই হাঁটি
পাথরে পাথর গেঁথে ভাঙ্গি স্থাপত্যের
যাবতীয় পূরনো ধারণা
এক তুমি নির্বাসন বলো
বলো উন্মার্গগমন

অন্তর্গত অন্ধকারে থাকি
এইতো আমার অমল ক্যাথারসিস
(ক্যাথারসিস)

কবি সরদার ফারুকের কবি সত্ত্বায় আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান।পক্ষাঘাতগ্রস্ত মধ্যবিত্ত্বের জীবনবৃত্তে তিনি কখনো থেমে থাকেন নি বা আত্ম-সমর্পণ করেন নি।আত্মধিক্কারে তাঁর হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে,প্রবল সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়েছেন কিন্তু সংশয়ে সুস্থিত হন নি।সংশয়বাদী কবি তিনি নন,আশাবাদ তাঁর মজ্জাগত:

গান গাইবার কালে কন্ঠ চিরে গেলে
আর্তনাদ বলে মনে হয়
পারো যদি মুছে ফেলো
নিঃসঙ্গ পথের চিহ্ন,রক্তঝরা দিন।
(সজারুর অবয়বে)

কিংবা মানুষ কবিতায়ঃ

এইভাবে হয়ে ওঠো,হয়ে ওঠো নিজের ভেতরে
বেড়ে ওঠো রক্তবীজ,অবাঞ্জিত ভ্রুণ
ফুটে ওঠো অনায়াসে কিশোরীর গোপণ কোরক

অদম্য আশাবাদী কবি সোনালী ভবিষয়ৎকে দেখেন অন্তর্দৃষ্টি মেলে :

.............
দলে দলে মানুষেরা যাত্রা করে অদম্য সাহসে
নতুন ঠিকানা লেখে সুবাসিত নামে।
(এক্লোডাস)

কবি সরদার ফারুকের কবিতায় সমকালীন মানুষের বিচ্ছিন্নতার গভীর যন্ত্রণার আর্তনাদ শোনা যায়।যুগ-মানসের অস্তিরতা,অনিশ্চিত পরিবেশ,ব্যক্তি-জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণায় কবির হৃদয় বারং বার চঞ্চল হয়েছে।হতাশা,ক্লান্তি,নৈরাশ্য প্রসঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা এসেছে তাঁর কবিতায় :

হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে
মে ফ্লাওয়ারের বৃষ্টি ভাজা গাছ,নিঃসঙ্গ টিলার
নীচে বুনোলতা,ঘাস ফড়িং,খরস্রোতা মনু নদী
অনেক পূরণো ব্রীজ।এই পথ কোথায় গিয়েছে
মিশে আছে আরো কিছু পথের বেণীতে
( মনু ব্রীজ)

সমাজ সচেতন কবি সরদার ফারুক সমকালীন জীবনের নানা অসঙ্গতি ও অনাচারে পীড়িত হয়েছেন,যুগের অন্ধকারে তিনি গা ভাসিয়ে দেন নি।ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতা,সমাজ জীবনের একাকীত্বকে তিনি পরাবাস্তববাদী কবিতা রচনা করে মানুষের বিভঙ্গ ও অসহায়জীবনের একাকীত্বকে রুপদান করেছেন সফলভাবে।এখানে তিনি দক্ষ কুশীলব:

ভগ্ন এক প্রাসাদের ক্লান্তি
ভর করে ঘোড়ার শরীরে
রিংমাষ্টার,চাবুক দেখিয়ে
কোন লাভ নেই

ভীষণ গম্ভীর ভাঁড় দার্শনিক সেজে
শিষ্য পরিবৃত
দড়ির খেলায় শুধু বয়স্কা রুপসী
শিরা ওঠা হাতে
আকড়ঁ ধরেছে জোরে অদৃশ্য দেয়াল
(সার্কাস)

কবি সরদার ফারুকের মস্তিষ্ক প্রসুত অবচেতনের প্রতীকগুলো ভেসে অপূর্ব এক নান্দনিক তাৎপর্য্যে;যার ফলে পাথরের পাখিকে তিনি আকাশে উড়ে যেতে দেখেন।সত্যানুসন্ধানী এ কবি প্রকৃত বাস্তবকে উন্মোচনের জন্যে পরাবাস্তববাদী চেতনায় কবিতা রচনা করেন। এ পরাবাস্তব চেতনা তাই তাঁর কবিতার নন্দন্তত্ত্বের অপরিহার্য্য অংশ হয়ে ওঠে।নিসর্গ সৌন্দর্য্য ও আত্ম-অনুভবের অনুভূতি দিয়েই কবি সরদার ফারুক তাঁর কবিতার অবয়ব গড়ে তোলেন। তাঁর আত্মজ ভালোবাসা ও সৌন্দর্য্যতৃষ্ণা কবিতার প্রতিটি বাক্যে,প্রতিটি শব্দে।নন্দঞ্চিন্তার বীজ বপণ করেন একজন প্রকৃত শব্দচাষার মতোনই;যার ফলে কবিতার অকর্ষিত ভূমি থেকে তুলে নেন অপার প্রাচুর্য:

রেলপথ ধরে হেঁটে গেলে
ছোট কালভার্ট
অগভীর জলে খেলা করে
ডানকানা মাছ
তারপর তোমাদের বাড়ী

তুমি থাকো ভিতরের ঘরে
নীল জামা বাইরে শুকায়

আনন্দ কোথায় তুমি কবি সরদার ফারুকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।তিনি তাঁর প্রথম বইয়ের মাধ্যমেই বাংলা কবিতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।যদিও হোঁচট খেতে হয় নামকরণের হেতু কি?যদিও জানি এ নামে তাঁর একটি কবিতা রয়েছে। বাংলা কবিতায় সরদার ফারুকের আগমন এমন এক সময়ে যখন সাইবার কল্যাণের কারণে রদ্দিমার্কা কবিতায় পথ হাঁটা দুষ্কর।উনি সযতনে সমস্ত কাঁদা-পাক এড়িয়ে পূর্বসুরী জীবনানন্দ,বিনয় মজুমদারের পথে হাঁটছেন।কবিতার বিচরণক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ সার্থক হোক।

কবি সাবরিনা সিরাজী তিতিরের 'মেঘ হয়ে যাই':উত্তরাধুনিক চেতনায়

ক্ষমতাসীনেরা সেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই ক্ষমতার অতি প্রয়োগ ও অপব্যবহারের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যুদ্ধ,অশান্তি,দুর্নীতি,ঘৃণা ও বৈষম্যের সৃষ্টি করে জনজীবনে অশেষ দুর্ভোগ ও ভোগান্তির কারণ ঘটিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় তথা সমস্ত বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।প্রাচীন কালের বর্বরতা ও অদৃষ্টবাদী সমাজ ব্যবস্থা,মধ্যযুগীয় কু-সংস্কার ও অন্ধকার পেরিয়ে য়্যরোপে শিল্প-বিপ্লবের মাধ্যমে যে আধুনিকতার সুচনা হয়েছিল;শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বে তা কার্য্যত ব্যররথ।ক্ষুধা,দারিদ্র্য,যুদ্ধ,নিষ্ঠুরতা,অশিক্ষা,জীবন ধারণে অনিশ্চয়তা মুক্ত করতে পারেনি আধুনিকতাবাদ।চরম হতাশা ও গ্লানি,মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে উত্তরাধুনিকতার জন্ম। মানব কল্যাণের আশাবাদ ও সদিচ্ছায় দৃঢ় প্রত্যয়ী উত্তরাধুনিকতা বাদ ; যা নিছক একটি মতাদর্শ নয়। আধুনিকতাবাদের মরনোন্মুখ আর্তনাদ ও উত্তরাধুনিকতা বাদের সাবলীল যাত্রায় কবি সাবরিনা সিরাজী তিতি্র তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মেঘ হয়ে যাই' এ ব্যর্থ আধুনিকতা নিয়ে সীমাহীন ক্ষোভ নিয়ে লেখেন:

অবাক হই!মুখোসগুলো কেমন মানিয়ে যায় তোমাদের!
ক্রোধের ঘরে আস্তানা গড়ে মোনালিসা'র রহস্যময় হাসি,
কান্নাকে তালা দিয়ে চাবী তুলে দাও অট্টহাসির হাতে;
আবার নোংরা খিস্তি আড়াল হয়ে যায় তৈলাক্ত মুখোসে।
ব্যাকডেটেড মুখোসগুলো কি করবো আমি?
ভাবছিলাম কিছু পালটে হাল আমলের কিনবো
প্রয়োজনে একটা কিনলে আর একটা বিল্কুল ফ্রি।
গোপন একটা সত্যি বলি?
মুখোস পরতে পরতে মুখটা কেমন
ইট চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে
একটু সোনারোদ ছোঁইয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করে বুকটা,
আয়নায় খুঁজে ফিরি নিজেকে,কতদিন নিজেকে দেখি না ।
(মুখোস)

আমরা এমন এক ভীতিপূর্ণ সময়ে বাস করছি যে উন্নত বা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেরও এমন সব ভয়ংকর মারণাস্ত্র রয়েছে যা পৃথিবীটাকে ধ্বংশ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্টরো বেশী। আধুনিকতাবাদ আমাদের উপহার দিয়েছে সন্ত্রাসের আবহাওয়া ও আতংকের পরিমন্ডল, অস্থিতিশীলতায় পরিপূর্ণ বিশ্ব এ অবস্থায় আশাবাদ নিয়ে এগিয়ে চলছে  উত্তরাধুনিকতাঃ

আজ খুব ইচ্ছে করে জানো,
চেস বোর্ডে রাণীর মতো তোমাকে আগলে রাখবো,ভালবাসবো
প্রয়োজনে হাত ধরবো মৃত্যুর
( প্রিয় কে)

উত্তরাধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতা।আধুনিকের কৃষ্ণবিবরে পাঠক ছিল পুরোপুরি লেখকের আজ্ঞাধীন।উত্তরাধুনিক সাহিত্যের ভেতর পাঠক পুরোপুরি স্বাধীন।পাঠকের ভূমিকা এখানে ঊন বা বহিরাগত নয় অন্তর্গত :

দুই দুয়ারী ঘরে বসত আমার।
এক দুয়ার পাহারা দেয় দুঃখ
অন্যটায় সুখের পাহারাদার
ইচ্ছেমাফিক ঢোকার নেই উপায়---
হাজারো প্রশ্ন।
(দুই দুয়ারী)

সময়ের এক অবাস্তব যাদু দিয়ে গড়া আজকের এ পৃথিবী।বাস্তবতা বেরিয়ে যায় আঙ্গুলের ফাঁক গলে।প্রকল্পনার স্বচ্ছ চাঁদরে ঢাকা পড়ে যায় যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্ব।কূটাভাস থেকে কূটাভাসেই যার পরিভ্রমণ।তারুণ্যদীপ্ত অভিজ্জানে ছদ্ম এ সময় বিষদাঁত বিধিয়ে রাখে।ঊষর পৃথিবী ধরা  দেয় উত্তরাধুনিক চেতনায়ঃ

নামহীন অখ্যাত নদীটা তোমার দেয়া নাম পেয়ে---
লাজুক ভালোবাসায় আরও সিক্ত হয়েছিলো।
শান্ত নদীর হটাৎ জোয়ার,অন্যদের মতো তুমিও বুঝতে পারোনি।
চুপচাপ নদীর অসময়ের উচ্ছ্বাস,ভ্রু কুঁচকেছে অনেকের
(ডাকো প্রিয় নাম)

কবিতার অমোঘ শক্তি।মানুষকে কবিতার কাছেফিরতেই হয়।নানাবিধ বিবর্তণের মাধ্যমে আমাদের এখনকার এ উত্তরাধুনিকতা।কবি সাবরিনা সিরাজী তিতির উত্তরাধুনিকতাকে ধারণ করতে চেয়েছেন বাস্তবের উর্ধ্বে আরেক বাস্তবে উপনীত্র হয়ে।প্রকৃত বাস্তবকে তিনি প্রবল্ভাবে অবল্ম্বন করেই কবিতা বিনির্মাণ করেন :

অমাবস্যা বায়না করেছে সূর্য দেখবে ;ওকে খুশী করতে
রাতের সেই সূর্য রঙের টিপ আজও খোলা হয় নি
তবুও অমাবস্যা চোখের কাজল হয়
একসময় নিশ্চয়ই সূর্য ঘুমবে
অমনি অমাবস্যা ছুঁইয়ে দেবে তাকে
জ্বলে মরবে জানে তবুও চাতক হবার তৃষ্ণা
(সূর্য রঙের টিপ)

কবি অমিতাভ দাশের 'একমনা রোদ':উত্তরাধুনিক দৃষ্টিতে

রবীন্দ্র যুগের রোমান্টিক ধারার বিরোধীতা করেও তাঁর দৈশিক ও বৈশ্বিক ভাবনা,চিন্তন,মেধা ও মননশীলতা অনুসরণ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু তরুণ কবি নূতন ধারার এক কবিতা চর্চা শুরু করেন;যা আধুনিক কবিতা ( যার সূচনাকাল ১৯২৫ সাল)।এ আধুনিক কবিতার ফর্ম বা কনটেক্সট তড়তড়িয়ে এগিয়ে চলে অর্ধ শতাব্দী কালেরও কিছু বেশী সময়। তারপর বাংলা তথা বিশ্ব কবিতার ইতিহাস এক দীর্ঘ বাঁক নেয়;এর নাম উত্তরাধুনিকতা।এ উত্তরাধুনিক শব্দটি সম্পর্কে অনেকের দ্বিমত,বিভিন্ন তাত্ত্বিকের নানাবিধ বিশ্লেষণ,এর সার্বজনীন ব্যাখ্যা বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে নানা তর্ক-বিতর্ক প্রতিনিয়ত চলে আসছে এবং প্রায় তিন দশক কালেরও অধিক সময়ব্যাপী হয়ে এল এ তর্কের মীমাংসা এখনো শেষ হয় নি অর্থাৎ আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি কবিতার অবস্থান। আধুনিক না-কি উত্তরাধুনিকতায় অবস্থান;যুগ মানসের এ দোদ্যুলময়তায় সন্দিহান কবি অমিতাভ দাশ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'একমনা রোদ' এ বলেন:
নির্জনতারও এক ছায়া আছে জানো ?
একলা রাস্তার,যে ছায়া মাটির গভীরে প্রোথিত
পাথরে পাথরে ? সেই তার মতো!
(নির্জনতার ছায়া)

সময়ের পাগলা ঘোড়া অবিরাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সর্বনাশা যমুনার একপাড় যখন পলিমাটিতে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে অপর পাড়ে তখন চলছে ভাঙ্গনের প্রলয় নাচন।রাক্ষুসী যমুনা গিলে খাচ্ছে নদীতীরের উদ্যমী সাহসী কৃষকের শেষ সম্বল বাস্তভিটে,হাট-বাজার,উপসানালয়,পাঠশালা।ভাঙ্গাগড়ার এ খেলার নামই কি জীবন।মানুষের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করলে দেখতে পাই ভাঙ্গা-গড়ার অপরুপ চিত্র।যে সময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত,সময়াজতন্ত্র বিপর্যস্ত ধনতান্ত্রিকতায় ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধে সংকটগ্রস্ত বন্ধ্যা পৃথিবীতে উত্তরাধুনিকতার বীজ রোপিত হয়েছিল।সেই পাতার ফাঁকে ফাঁকে খেলা করছে চিকচিকে রোদ্দুর,রং-বেরঙএর পাখ-পাখালির কল-কাকলীতে মুখর বৃক্ষের ডালগুলো:

ঢেউয়ের ওপর ঢেঊ উঠেছে
চোখের পলক চিবুক ছুঁইয়ে
আকাশকে সম্রাট করেছে
রাম-ধনুকের রঙ ফুটেছে সলাজ আভায়
এক সমুদ্র ভালোবাসায় তীর ছুঁয়েছে.....
(এক সমুদ্র ভালোবাসায়)

উত্তরাধুনিকতা একটি বাস্তবতা। উত্তরাধুনিক কবিগণ মেধায় ও মননে বলিষ্ঠ। প্রথাবিরুদ্ধ ও শেকড়াশ্রয়ী কবিতা নিনির্মাণে চষে বেড়ান ইতিহাস,বেদ,পূরাণ,মহাভারত,চর্যাপদ,মধ্যযুগীয় গীতিকবিতা কিংবা পূর্বসুরীদের কাব্য:

পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়ী চোখ আছে যার---
সে যখন
এমন আপন করে;
দারুচিনি পাতা মোড়া রিনরিন রিনরিন সুরে
বাঁশিতে বলেন----
''এতোদিন কোথায় ছিলেন?''
(এতোদিন কোথায় ছিলেন)

উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য একরৈখিকতার কেন্দ্রকে গুড়িয়ে দিয়ে বহুরৈখিক কবিতা বিনির্মাণের প্রয়াসে কবি অমিতাভ দাশ সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন :

..........
আর বাংলা থেকে বহুদূরে এক আশ্রমে সারাদিন ধরে ঝরে পড়ে
টূপ টূপ টূপ--হলুদ গুলমোহর ফুল।এক শ্বেত পাথরের বিছানায়
শুয়ে আছেন চুপ দুই জ্যোতিষ্ক---শ্রী অরবিন্দ আর মাদার
ফিরতে ইচ্ছে করে না,শরীর ফিরলেও---মনের গভীরে যাবার
নিজেকে জানার,নিজেকে খোঁজার আধ্যাত্মিকতার আলের উত্তরাধিকার
(উত্তরাধিকার)

উত্তরাধুনিকতা বাংলা কবিতার নূতন দিগন্তের দরোজা মেলে ধরেছে।দু'শো বছরের ব্রীটিশ বেনিয়া আর চব্বিশ বছরের পাকি শাষণের বেড়াজাল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নূতন এক বিশ্বাসের ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই নূতনের আয়োজন শুরু হয়েছে সবার অলক্ষ্যে।জন্মলগ্নেই উত্তরাধুনিকতাবাদ উপহার দিয়েছে ব্যক্তি-স্বাত্নত্র্যবাদ,শেকড়ের অন্বেষণ।উত্তরাধুনিকতাবাদীরা ষ্পষ্টতঃ দু'টি ধারায় বিভক্ত।একপক্ষ কবিতায় মানুষকে বাদ দিয়ে কবিতা রচনা শুরু করেন। তারা বলেনঃকবিতার কোন বিষয় থাকবে না;তা হবে শেকড় বিহীন পরগাছার মতোন।কবিতা হবে দুর্বেধ্য।কবিতার ভাষা হবে দুর্বেধ্য ও অপ্রচলিত শব্দে। আরেকদলের মতে কবিতার নির্দিষ্ট বিষয়বস্ত থাকবে,থাকবে মানুষ ও মানুষের ইতিহাস, কবিতা বিনির্মাণ হবে দেশজ,সহজ কিন্ত সস্তা নয় ও প্রচলিত শব্দের বহুমুখী রুপে। কবি অমিতাভ দাশ দ্বিতীয় পক্ষে :

বৃষ্টিতে হেঁটে যায়
স্বপ্ন ভাঙ্গা সে এক যুবক
বড় ক্লান্ত,বড় বেশী ক্লান্ত লাগে তাকে
(শ্রাবণঘন গহনমোহে)

কিংবা

একটি নিঃসঙ্গ নারী,তার নিঃসঙ্গ ঘরে নিঃসঙ্গ হয়েই
ছিল।তার নিঃসঙ্গ দুপুরের নিঃসঙ্গ পুকুরে
খট খট ক'টি নিঃসঙ্গ শব্দ ঢেউ উঠল---
(নিঃসঙ্গ)

আধুনিক জীবন খুব বেশী সহজ  নয়।পারিপার্শিক আবহমন্ডল এক ক্রমেই জটিল করে তুলছে। যান্ত্রিক সভ্যতা জীবনকে জটিল ও নিয়মের শৃংখলায় বেঁধে ফেওলতে চাচ্ছে। তাতে করে মানুষের জীবন বৈচিত্রহীন হয়ে পড়ছে,পড়ছে বর্ণহীন হয়ে। উত্তরাধ্নিকেরা সয়াতন ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠতে পারে :

বৃষ্টি এলে শ্রাবণ আসে?
না,শ্রাবণ এলে আসে বৃষ্টি
কিছুতেই মনে পড়ে না আজ!

গন্তব্যে হারিয়ে গেছি যে ।
(গন্তব্যে হারানো)

কিংবা

সন্ধেবেলার ঘুন,---কেমন গভীর এক বিষন্ন বিপন্ন অন্ধকারে
ঘুম ভেঙ্গে ওঠা!জীবনটা কি হয়ে গেল হাসপাতাল এক
দেখতে-এল-না-এল-না কেউ এমন বিকেলে?
কেমন জানি ছল সূর্য্যাস্তটা ?
(সন্ধেবেলার ঘুন)