Powered By Blogger

শুক্রবার, ২৯ জুন, ২০১২

নিঃস্ব

অত্যুজ্জ্বল অন্ধকারে রোদ মাখানো স্বপ্নেরা সময়ের অবাস্তব চাঁদরে জড়িয়ে
রাখে আপাদমস্তক;মানুষের ইতিহাসে উপমাময় দিনের স্বাক্ষ্য দেয় শুধু
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সু-সংহত বর্ণনায় বসন্ত দিনের গান।এই যে এখন
প্রায় অন্ধকার কিংবা বসন্ত দিনও নয়,আকাশে দিনের সূর্য্য ডুবে গেছে কবে
উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো এক হয়রানিকর,কেবল প্রহেলিকার জন্ম, দিতে থাকে।
শালকী নদীর তীরে সুমুদ্রিত ঘাসগুলো ফাল্গুনের সশব্দ বাতাসে ওড়াওড়ি করে
এটাই এ জীবনের বসন্তের অভিজ্ঞতা ঊষর কৈশোর কালে ছবি এঁকেছিল

ক্রমঃ বিবর্তন মেনে অমিল পয়ারছন্দ থেকে অমিত্রাক্ষছন্দ বা অক্ষরবৃত্ত- এ
থেমে না থেকেই সব চলে যাবে ছন্দহীন উত্তরাধুনিক গদ্য কবিতার রাজ্যে
আধুনিক মানুষেরা ব্যর্থতার বোধে ক্রমে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতরে পরিণত হবে

ভবিতব্য

নীলনদের বন্যার সাথে স্বর্গীয় নক্ষত্র সোথিসের
কি সম্পর্ক মিশরীয় পুরোহিতেরা তা জানতেন
মানুষের কপালে কি লেখা আসিরীয়দের সাথে তা দেখেছিলাম
মহাকাশের নক্ষত্রমন্ডলীর মাঝে আর তারও অনেক আগে
গুহাবাসের সময় থেকে চাঁদের কলার হ্রাস-বৃদ্ধির মতোন
স্পষ্ট ঘটনা এড়িয়ে যাই নি,---
অথচ এখন আমি কোনো তারাই চিনি না

এই শহরের 'পরে কোন আকাশই নেই
কংক্রিটের ছাদে মাথা কুটে মরে সকালের রোদ
কোনো কোনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে
দয়িতার গাঢ় আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে
ঘুমন্ত শিশুপুত্রের মুখে চুমু দেই

এটাই আমার ভবিতব্য

সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

অপরিচিতা

তার চোখের দ্যুতিতে সমুদ্দুরের বিষাদ ঝরে পড়ছিলো
গোধূলির বিষন্নতা কাজলের আলপনা হয়ে ছিল তার
স্বচ্ছ,কালো দুই চোখে ;রক্তের দাগের মতো ক্ষয়াটে,বিবর্ণ
মৃতুর নিস্তব্ধতায় কবরের প্রশান্তিতে গাঢ়,অন্ধকার
ভেজা বাতাসের লোনা চাহনীতে ঝরছিল নিঃসীম শুন্যতা
পাথুরে কাঠিণ্যতায় থমথম করছিল তার চোখমুখ
য্যানো বা ঝড়ের পূর্বে নৈসর্গিক স্তব্ধতায় সমুদ্রের কূল
উপকূলে ঝাউশাখে বাতাসের আর্তনাদে ছন্দিত কান্নার
সুরে উথাল পাথাল উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসে
রক্তের স্ফুরণে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল তার শিল্পিত হৃদয়
গোক্ষুর সাপের কান পাতার উৎকীর্ণতায় স্পর্শ করলাম

খোলা জানালা পেরিয়ে রোদ্দুরের স্বপ্ন
আন্দেজ পর্বতে বাঁদা পেয়ে ফিরছিল
রিক্ততার হাহাকার,একাকীত্বের যন্ত্রণা মিছিলে মিছিলে
উন্মুখর শরীরের শিরা-উপশিরা ব্যেপে ট্রেনের একই
কামরায় সে ও আমি মুখোমুখি সহযাত্রী যোজন দূরত্বে
বইয়ের ফাঁকে চোখ রেখে চোরা চাহনীতে তাকিয়ে ছিলাম
মুগ্ধতায় মোহাবিষ্ট তন্ময় পুরুষ
প্রগাঢ় চোখের ভাষা সরল গদ্যের মতো পড়ে যাচ্ছিলামঃ
অন্ধকারময় শুন্য সুড়ঙ্গে,নি;সঙ্গতায় আবাস গেড়েছে
ধূসর অতীত কোনো;যা হারিয়ে গেছে
কিংবা হারায় নি এখনও সেইসব স্মৃতিগুলো
যাবজ্জীবন মেয়াদে দন্ডপ্রাপ্ত স্মৃতির ভাঁড়ারে
রেল সড়কের পাশে বাবলার বন ভেদ করে
বিকেলের সূর্যরশ্মি মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছিল তার
পোষাকের ভাঁজে ভাঁজে;অবিশ্বাসী বাউল বাতাসে
খসে পড়ছিল তার শাড়ীর আঁচল
তার শরীর নিঃসৃত জৈবনিক ঘ্রাণের সুগন্ধে
আআর বুকের মধ্যে শিষ দিয়ে উঠল দোয়েল
মাঝ সমুদ্দুর থেকে প্রবল উন্মত ঢেউ আছড়ে ফেললো
উপকূলের নরোম,সিক্ত বালুতে মুহূর্তে প্রভাতিক,স্নিগ্ধ
শিশিরের শুভ্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো আমার হৃদয়
চারদিক ভরে গেলো নান্দনিক জোছনার প্লাবনে
এবং শেষ হয়ে এলো বিনিদ্র প্রহর
মনে হচ্ছিলো কাঙ্খিত প্রার্থনার প্রার্থিত মুহূর্ত
সমুপস্থিত এক্ষণে;তার নীরব দৃষ্টিতে আমি দ্রবীভূত
হতে থাকি,---অতঃপর ভালোবেসে ফেললাম অপরিচিতাকে

ছন্দসিক ছন্দে দীর্ঘ রেখা টেনে ছুটে চলে ট্রেন

০১.০৫.১১
উত্তরা,ঢাকা।

চোখের জল

বুকে চিনচিনে ব্যথা
হলুদ শাড়ীতে বেশ মানিয়ে গিয়েছ
বুকে চিনচিনে ব্যথা
মেহেদী রাঙ্গানো হাত দেখে ম্লান গোধূলির আলো
বুকে চিনচিনে ব্যথা
শরতের কাশবন হার মানে খোপায় জড়ানো বেলী ফুলের মালায়

চোখের জলের আর কতটুকু দাম
নোনা স্বাদটুকু ছাড়া

স্বতন্র ধারার চতুর্দশপদী-৬

একটি বিমান দুর্ঘটনা উন্মোচন করে দেয়
গণতন্ত্রে উত্তরণ পথ;ভাঙ্গা স্যুটকেস থেকে
বের হয় সৌভাগ্যের অনন্ত দুয়ার,হায়েনারা
ফাঁদ পাতে--পুঁজিবাদী পণ্যের ঝাঁঝাঁলো  বিজ্ঞাপনে
লালায়িত নিঃস্ব জন অজান্তে গর্দানে তুলে নেয়
চক্রবৃদ্ধি ঋণের জোয়াল,বলদের মেরুদন্ড বেঁকে
যায় চৈতী চৌচির জমিনে,খাদ্য খোঁজে শকুনেরা

সুফিয়ার সৎকার হয় চাঁদার টাকায়,তত্ত্ব
বোঝে,বোঝায় না কেউ,গলায় ফাঁসও নেয় দেনা
এড়াতে,উচ্ছেদ হয় ভিটে থেকে,দেশান্তরী হতে
হয় কখনো কখনো।ব্র্যাক ফেল মারলে গ্রামীণে
যেতে বাধা নেই,গ্রামীণের দেনা শুধবে নিঃশর্ত--
শর্তহীন(নিয়মিত কিস্তি) আশা,আশার পাওনা
মেটাতে প্রশিকা আছে। আরো কতটুকু চাও পেতে?

০৪.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

ব্যর্থ জীবন

আমার শোবার ঘরে ঢুকেই বান্ধবী বলে উঠলো,এ ঘরে
নিদ্রাহীনতার গন্ধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে,ভাঙ্গা স্বপ্নগুলো
বালিশের ওপর কার্পেটে,বিছানার ভাঁজে ভাঁজে
বেদনা করুণ চোখে তাকিয়ে দেখছেঃ

ঘরময় ব্যর্থতার সু-স্পষ্ট,স্পর্ধিত পদচিহ্ন
হতাশা,বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাসে ভারী ঘরের বাতাস
ফ্লাওয়ার ভাস থেকে ভেসে আসছে টাটকা বিষাদের সুর
নোনা ধরা দেয়ালের আস্তরে আস্তরে
ঢেকে আছে জৈব সুখ;উচ্চাকাংখা কোথাও দেখি না।

না,এখানে নয় আকাশের কাছাকাছি কোন গৃহ
হো'ক তোমার ঠিকানা।

নান্দনিক কবি সুমী সিকানদার

কবি সুমী সিকানদার সত্ত্বার গভীরতর অর্থ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থেকে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'নদীটা রেখে যাও' এ মানবিক অস্ত্বিতে এনেছেন অভিনবত্ব ও আত্মপ্রত্যয়জাত স্বাদ।তাঁর এ প্রত্যয়ের উৎস মানবিক প্রেম,স্বদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত সময়,দৈনন্দিন জীবঙ্গাঁথার মধ্যে নিজেকে খোঁজার এবং অনুভূতির সুতীক্ষ্ম বিস্তৃতির ফলেই তাঁর কবিতায় সত্যিকার গভীরতা স্পর্শ করেছেঃ

নদীটা রেখে যাও
মাঝরাত্তিরে ফেরত দেবো।
দেবো ঠোঁট ভেজা ভোর,
বিকেলের নিংড়ানো নয়ন....রাতের রোপণ...সব।
ফিরে যাবে...।
টুকরো টুকরো জোছনায় ঢলে পড়া রুপালী রং প্রেম।
বিবর্ণ বকুলের বাসি প্রাণ......অস্তাভা।
অপেক্ষার আকাশের উড়ন্ত গাংচিলের ছায়া পড়বে
বিষন্ন নদীর গালে।

নদীটা রেখে যাও...
রাত বাড়ছে দেখো!!
হু হু করে বাড়ছে অলভ্য লোভ...ক্ষিপ্ত ক্ষোভ
এখনই ফেরৎ পাবে...
দম্য দরিয়ার ঠিক মাঝ ঘূর্ণনে...
অদম্য দয়িতা তোমার।
( নদীটা রেখে যাও......মাঝরাতিরে ফেরত দেব)

নিরন্তর প্রস্তুতির মাঝে নিজেকে ধরে রেখেছেন কবি সুমী সিকানদার।সমকালকে তিনি মেপে চলেছেন মহাকালের বাটখারায় তাই তাঁর কবিতায় দেখি সৃষ্টিশীলতার বহুবর্ণা  ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে বেড়িয়ে আসে কবিতার লাইন ফুঁড়ে।আত্ম-চেতনা ও সৃষ্টির বিপুল আনন্দে আত্মহারা এ কবি পূর্বসুরীদের গতানুগতিক ভাবধারা সযত্নে এড়িয়ে চলার লক্ষ্যনীয় প্রয়াসে লিপ্ত।প্রথাগত আনন্দের ঝলকানি,বেদনার বিষাদাত্মক যন্ত্রণা কিংবা বাস্তবতার নিরেট পাথরও তাঁর কাছে গুরুত্ব বহন করে না।সৃজনশীলতার চরম উৎকর্ষে থেকে তিনি বিনির্মাণ করেন কবিতা;পৃথক ও স্বাতন্ত্র্যবোধের অভিনব ভাব,ভাষা ও বক্তব্যে উপস্থাপিত দ্বন্দ্বে ভরা এক বৈপরীত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠক হৃদয়ঃ

আঁধারে টুপটাপ টপকায় তস্কর
কুয়াশার আঁকিবুকি কেটে কেটে
ঢুকে পড়ে বর্বর গহ্বরে।
তাড়ি খাওয়া রাত ঢুলতে থাকে
বাড়তে থাকে ত্রিতাল প্রদাহ
খাঁজকাটা নকশায়
এলোমেলো গলা সাধে
উদারা মুদারা তারা তিনবোন।
(নিদ্রাভঙ্গ)

কবি  সুমী সিকানদার নিজের ভেতর থেকেই গড়ে তোলেন বিরল ও সুক্ষ্ম মননের তন্তুজাল আর তা তিনি কখনো ঊর্ণনাভ,কখনো বা গুটিপোকা;যার নিঃশব্দ,একক প্রচেষ্টায় নিজেরই চারধারে বুনে নেন ভাব ও ভাবনার রেশমী জগৎ।আলো ও অন্ধকারের জ্বলজ্বলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গভীরতর সত্ত্বার বোধে লুকিয়ে থাকা স্কাইলার্ক পাখি এক,কখনো নাইটিঙ্গেল;অন্ধকারের মধ্য থেকেও গান দিয়ে নিঃসঙ্গতার লাঘব ঘটাতে সচেষ্ট শৈল্পিক অভিজ্ঞতার প্রগাঢ়তা ও তীব্র সংবেদনশীল,আত্মোপলব্ধিজাত ঈন্দ্রায়ানুভূতিঃ

১৪.
একবার সাহস করে
শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়েই দেখো না,
দেখবে উড়ে উড়ে ভালোবাসতে
কী দারুণ যন্ত্রণা লাগে।
(মনকাব্য)

সুমী সিকানদার আত্ম-জৈবনিক,রোমান্টিক একজন কবি।আজন্ম শিল্প-তৃষিত কবি সুমী সিকানদার শিল্প-চেতনাকেই নান্দনিকতার মূল উৎস বলে মনে করেন।মানবজীবনের মহত্ত্বম উপলব্ধি হছে প্রেম আর তাই তাঁর কবিতায় প্রেমের স্থান অবশ্যম্ভাবী।স্বতন্ত্র, নান্দনিক শৈলী,চেতনা  ও নন্দনতাত্ত্বিক দার্শনিকবোধের কারণেই তাঁর কবিতা সৌন্দর্য্য চেতনাকে স্পর্শ করে কাব্যিক চেতনায়,সত্ত্বার গভীরতর আবেগের কল্পনায় সীমার মধ্যে অসীমের স্পর্শ সঞ্চরনশীল;যা প্রেম চেতনার সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের নিবিড় সংযোগে প্রেমকে চিত্রিত করেছেন সর্ব প্রসারীরুপে প্রতীকের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অতি-প্রাকৃত আরেক প্রতীকঃ

আমি হাঁটছি......
ম্লান নির্জনতার পায়ে পায়ে,
আমার বড্ড ভালো লাগছে।
বেণীতে করে তোমাকে এনেছি চুপচাপ।
সূর্য আর সর্ষে,জোড়া হলুদ ডুবলেই
বেণী খুলে ভাববো তোমায়।।
(নির্জনতার খোঁজ)

সুমী সিকানদার স্বতস্ফুর্ত সৃজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলো ফেলে দৈনন্দিন জীবন-যাত্রা তথা মানব্জীবন ও নিবিড় প্রকৃতির এক আবেগ ও আনন্দঘন মুহূর্তের প্রতিভাস মূর্ত করে তোলেন স্বীয় মেধা ও অভিজ্ঞানে বিশ্ব প্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্য্য ও আনন্দে বিনির্মাণ করেন প্রকৃতি ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের এক ও অদ্বিতীয় বিষয়ে কবিতাঃ

প্রতিদিন ফোঁটা ফোঁটা দুঃখগুলি
মনের কার্নিশ বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে,
কবিতার গাক ছুঁয়ে ছূঁয়ে,আমি এতদিন দেখিনি,
সুখগুলো কেবলি তাড়াহুড়ায়
মেঘদলের দেখানো পথে উড়ে গেল অবলীলায়...
আমি ধরতেও পারিনি।
একগুঁয়ে মেঘ......প্রতিশোধের নেশায়......
আমার ভেজা মন আরো ভেজায়।
বিরহের বিবর্ণ শ্যাওলা জমে জমে
নেশাতুর ভালোবাসা হয়।
এখন বুঝতে পারছি...ভালোবাসার নেশায়
রাত হয়েছে সুন্দরী ।
(রাত হয়েছে সুন্দরী)

সুমী সিকানদারের কবিতার নন্দনতত্ত্বে পরাবাস্তব্বাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।এই পরাবাস্তববাদী নন্সনচেতনা গভীরভাবে অনুধাওবণের ফলে কবিতায় যৌক্তিওকতা,অপার্থিব সৌন্দর্য্যে বিহ্বলতার কারণে চৈতন্যের সংকটে জর্জরিত কবি সুমী সিকানদার কল্পণার জগতে বিচরণ করে,আত্মোন্মোচনের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার প্রকৃত স্বরুপকে উন্মোচন করেন অভিনব শৈল্পিক ভঙ্গিমায়ঃ

জমজমাট দুঃখগুলো
নীলরাতে অলস জ্যোৎস্না পোহায়।
ঘুটঘুটে অন্ধকার টান মেরে জড়িয়ে ধরে,
পিষে ফেলে নির্মম বর্বরতার।
(অলস জ্যোৎস্না)

লৌকিক এবং দিব্য----উভয় সৌন্দর্য্যবোধই  মন-মানসে ধারণ করেন কবি সুমী সিকানদার।সুন্দরের মধ্যে তিনি দেখেন গুণ,পরিমাণ,সম্বন্ধ ও আকৃতি।সুন্দর তাই তার কাছে ধারণামূলক হলেও আনন্দদায়ক,রুচি ও রসবোধে  জারিত রুপের সৌন্দর্যই শিল্পের সৌন্দর্য্যঃ

গাছেদের চিল চিৎকারে যখন জ্বলে উঠেছে দানানল!
তখনই নীল আকাশের রঙ বদলেয় নামল---
অঝোর শ্রাবণ।

ওমনি ফুরিয়ে গেল তোমারত চাওয়া....
ফিরে গেল উদাসী হাওয়া....
কুঁকড়ে গেল লজ্জাবতীর ঝাড়,অপেক্ষার অপমানে
থেমে গেল পাতাদের মর্মর চাহনী....
আমার জন্য জমিয়ে রাখা নিষিদ্ধ ঘ্রাণ....
ও বর্বর ভালোবাসা।
তুমি মুখ ফিরিয়ে রইলে
সর্ষে রঙ হলুদ বসন্তে
আমার জন্য রইল কেবল জলভরা শ্রাবণ...শ্রাবণ।।
(দাবানল)

ফিনিক্সিয় কবি

গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত কবি নির্বিকার
মৃতের নির্লিপ্ততায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাড়ি
নেড়ে বললেন,তাড়াতাড়ি বিচারের কাজ শেষ
করে ফেলো আমার অনেক কাজ জমা হয়ে আছে
আর্চ বিশপ আসনে বসলেন কাকের আলখাল্লার
কালো পোষাকে আবৃত হয়ে---হয়তো গোপণে নাড়ি
টিপে দেখলেন ত্রস্ত,চঞ্চল জনগণের অনুভুতি কিংবা সমর্থন
বাদীপক্ষের উকিল কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন
কবিতার ছত্রে ছত্রে  থাকছে ঈশ্বর অবিশ্বাস
আর মহাজাগতিক অলীক বর্ণনা;
যা ধর্মগ্রন্থের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ
বাদীপক্ষের উকিল কঠোরতম শাস্তির জন্যে আবেদন
জানিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন।ন্যায় বিচারের স্বার্থে
আর্চ বিশপ কবিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলে
কবি বলে উঠলেন,'কবিরা সব সময়েই সত্যদ্রষ্টা হয়।'

আর্চ বিশপ কবিকে নির্দ্বিধায় জ্যান্ত পুঁড়িয়ে মারার রায় দিয়ে দেন
'মানি না','মানি না' এ  প্রহসনের বিচার
জনতার ক্রুদ্ধ গর্জনে বিশপ দ্রুত এজলাশ ছেড়ে চলে যান

ওরা জানেনা কবির মৃত্যু হয় না
ফিনিক্সিয় শুদ্ধতায় কবি বারংবার জন্ম নেয়

০৬.০৩.১১
পল্লবী,ঢাকা।

ভ্রান্তি

এক জীবনের সাধ-আহ্লাদ সেধেছিলাম রুপসীর পায়ের তলায়
প্রাভাতিক ধাতব ঝালরে উদ্ভাসিত সদ্যস্নাতা
ঋতুমতী রমণীর শুঁচিতায় একনিষ্ঠ পূজারী বামুন
অর্ঘ্য ঢেলেছি,য্যানো বা  ফাল্গুনের হলদেটে রোদে

জন্মান্ধ দু'চোখে শুধু ভুল আলোর প্রতিফলন
নিউরোন সেলে স্মৃতির মরিচা জেঁকে বসে

রক্ত-পুঁজে স্বেদাক্ত ভালোবাসায় ছিন্ন-ভিন্ন
এ আমি সমুদ্দুরের অতল তলে ডুবে যেতে থাকি

বহতা নদীর মতো এ জীবন কাঠ-ঠোকরায় ঠুকে ঠুকে খায়

স্বতন্দ্র ধারার সনেট-৭

পুঁজিবাদ কেড়ে নেয় মানুষের বিবেক,চিন্তার
স্বাধীনতা,মৌল নীতিবোধ,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য,বিশুদ্ধ
ভালোবাসা ভূমিষ্ঠের সাথে সাথেই বিচ্ছিন্নতার
মর্ম বেদনায় জর্জরিত মানব সন্তান আর্ত
চিৎকারে দিগন্ত কাঁপিয়ে তোলে আপন সত্ত্বার
বিচ্ছিন্নতা বোধে ধর্ম;ধার্মিকেরা লোভের উদ্ধুদ্ধ
প্রলোভনে ঈভ স্বর্গচ্যুত ঈশ্বর অবাধ্যতার

অরণ্যচারী মানুষ স্বীয় স্বার্থে বিচ্ছিন্ন লোভের
প্রাচুর্য ও প্রতিপত্তি আধিপত্য অন্তর্দ্বন্দে ক্ষত-
বিক্ষত মানুষ আজ যন্ত্র সভ্যতার নিষ্পেষণে
বিস্মৃত দায়িত্ববোধ চেতনার অস্তিত্বে সমার্ত
এক পৃথিবীর পথে;জাগতিক শূণ্যতা ক্ষোভের
সাথে দু'পায়ে মাড়িয়ে মানব ভালোবাসার মতো
শাশ্বত সুন্দর বুকে জয়ী পুঁজিবাদের শোষণে
৩১.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

হৃৎপিন্ড বিভাজন!

কতদিন কবিতা লিখি না গুনে গুনে
একলক্ষ চব্বিশ হাজার দাগে একশ চারটি
জীর্ণ প্যাপিরাস পুঁথি ছুড়ে ভূগোলের চোরাপথে
দেখি দুর্ধর্ষ বেদুঈন সাম্যের পতাকাতলে
নির্ধিদ্বায় মানচিত্র দখলের মহোৎসব
পাকা,সিদ্ধহস্ত ধর্মচ্যুতে
ইতিহাসের পাতায় জমে থাকা চাপ চাপ রক্তের ওপর
স্পষ্ট সতেরো অশ্বের ক্ষুরধ্বনি মদ্যপ নবাব সমর্পিত
অবিশ্বাসী সেনাপতি দাসখত লেখে
সাম্প্রদায়িক বিভেদে নির্মিত বার্লিন প্রাচীরের
মতোন ভূ-খন্ড নয়,হৃৎপিন্ড ভাগ করে

সাম্প্রতিক কবিতাঃরেজওয়ান তানিম

কবিতা হচ্ছে কবিমনের হৃদয়াবেগ-অনুভূতির সুতীক্ষ্ম প্রকাশ,অবচেতন মনের অবিরাম ক্রিয়ার ফল।ব্যক্তিমাত্রেই নিজমনের অবচেতন মনের ভাব জানতে পারেন।মানবীয় অস্তিত্বই অবচেতন মনের সমষ্টি।মানব চেতন মন ন্নিরন্তর প্রস্তুতির মাঝে বিরাজ করে তাহলে অবচেতন মনের প্রধান ও তাৎপর্য্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করলেও করতে পারে।কবি রেজওয়ান তানিম তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'মৌনমুখর বেলায়' ঠিক এমনভাবেই তাঁর অনুভূতিগুলোর অভিব্যক্তিগুলোর প্রকাশ ঘটিয়েছেনঃ

বিষাদের পপলার পাতা গুলো
অশ্রু লুকায়, ঝরে পরে
মুচমুচে পাপড় হয়ে , প্রতিটি
শীতের শিশির আসবার আগে । 

প্রাণের প্রাচুর্যে পূর্ণ হৃদয়,
নি:শেষ হয় একদিন, শুষ্কতার সঙ্গমে ! 
তার পরিনতি বিদ্যমান, ছোট্ট অথচ,
 প্রবাহিত অর্থবহ জীবনে ।
(বিষাদ দিনের কথা)

এটা ঠিক চূড়ান্ত হতাশ নয়,সৃষ্টি করতে না পারার হতাশা।কবি রেজওয়ান তানিম  তাঁর 'জন্ম ও মৃত্যুবিষয়ক' কবিতায় আশাবাদী প্রত্যয়,সৃষ্টিশীলতার আনন্দে ঝলমলে উচ্ছ্বাসঃ

রাত্রি দুটো । বিকাশমান অন্ধকার চিরে,
একটি সার্থক কবিতার জন্মতিথি
অবলোকনেচ্ছায়, সন্ধ্যা লাগার পর থেকে
জানলার ধারে আমার, বসে আছে -
বুড়ো চাদটা ! গগন ছাওয়া অনাঘ্রাতা

শরতের মেঘেরা,তার চোখের উপরে
প্রলেপ দিয়ে দিলেও,মন ছিল উত্তরের জানলায় ।


কানে কানে শুধোয় বারবার,
 উল্লাস আর সুতীব্র চিৎকারে ভরবে কি এ ঘর?
 রোশানাই জলবে কি জন্মোৎসবে, একটি 
 কালোত্তীর্ণ কবিতার জন্মে ?
 নির্বাক আমি, লিখে গেছি আপনমনে ।
পড়ার টেবিলে ছড়ানো কাগজের মাঝে,
ঝরণা কলমের আকি বুকি চলছে নিরন্তর ।
কবি, আমি থাকি পাশে মৌনতা ভঙ্গ হয় না আমার । দৃষ্টি চলে যায় 
টেবিলের পাশে ওয়েস্ট বাস্কেটে ।
আমায় অনুসরন করে পঞ্চমীর চাদ ।
চন্দ্রালোক ছড়িয়ে পরে মুঠি মুঠি 

করে ফেলে দেয়া শক্ত অফসেটের উপর । 
ক্রন্দনরত অন্ত সত্ত্বা আমার,
বলে ধরা গলায়- দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়া,
অগ্নিস্পর্শে ভষ্মীভূত হয়ে যাওয়া এই সব কাগজেরা ;
সদ্য মৃত এক একটি কবিতার লাশ বহন করে ।
এখনো দেহে তাদের মৃত্যু যন্ত্রনার ভয়াল ছাপ ! পুড়ে  

অঙ্গার হয়ে যাওয়া- এ অস্থি,
চর্মহীন রক্তাভ দেহের পদ্য গুলো ; ব্যর্থতা আমার ।
এরা কবিতা নয় ! এরা আমার সন্তান ।
তবু নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করেছি আমি ।  
মৃত্যু নিশ্চিত করেছি- শ্বাসরোধ করে
করা মৃত্যুপথযাত্রী ঘো ঘো
শুয়োরের- কসাইছুরির তলে যে কর্ণবিদারী আর্তনাদ,
তার থেকেও প্রবল মরণ যন্ত্রণার অশেষ চিকার
আরো নির্মম করেছিল আমায়,  
এখনো কানে বাজে- করুণ আর্তিটুকু !
এর পরেও হে সৌম্য সুন্দর চাদ
অদ্ভুত আনন্দ ভরা জন্মোৎসব,
দেখতে চায় স্নায়ু তোমার ?
কুহকী চন্দ্রকিরণ ম্লান হয় ।
নিশ্চুপ আমাকে ফেলে, চলে যায় কিছু না বলে !
আবার ডুব দেই মগ্নতায় ।
নগ্ন নির্জনতা- আগুন ধরায়- দেহে মনে ।
মাথায় শুরু হাজার শব্দের বিভীষিকা, যুদ্ধ !
পঙতির পরে পঙতি, শব্দের বুকে শব্দের মিলন,
অণুরণন তোলে সাইক্লোনের মতন ।
চোখ দুটো বুজে আসে ব্যাথার তীব্রতায় ।
মস্তিষ্কের ছোট্ট গ্রন্থিটা এখন দারুণ সচল ।
ঢেলে দিচ্ছে সঞ্চিত জ্ঞাণের সবটুকু ।  
আযানের ধ্বণি, বেজে ওঠে হঠাৎ ভোরের পূর্বাভাস ।
কবিতা বেড়োয় সদ্য 

মাতৃ জঠর ছেড়ে ।
আশ্রয় নেয়,শক্ত সাদা কাগজের জমিনে ।
অতৃপ্ত কবি হয় শান্ত; কবিতা জন্ম নিয়েছে বলে ।
বিশ্ব চরাচর মগ্ন ঘুমে চাদ নেই আকাশের কোনখানে ।
অদ্ভুত শূন্যতা, গ্রাস করেছে সব,
কেউ নেই জন্ম সংবাদ দেবে তাকে ।

একাকীত্ব ও শূন্যতার হাহাকারে জর্জরিত আধুনিক বিদগ্ধ মানুষ।পরিবার,স্বজন ও প্রেম বিচ্ছিন্নজাত যন্ত্রণা কবি মানস কুঁরে কুঁরে খায়।সভ্যতার ক্রম-বিবর্তনে সৃষ্ট শ্রম ও জীবন  ধারণের জটিলতা মানুষকে করেছে সমাজ,পরিবার ও প্রেম থেকে বিচ্ছিন্নঃ

.................................
কি যে লিখুম তোরে, বুঝবার পারতাছি না !
চিডি লিখতে বইলেই,
তোর কথা মনে আহে খালি । মাথার মইদ্যে
কেবল, পাক মারে ভালবাসার চক্কর ।
সারাডা দিন তোরে দেখবার মন চায় ;
ছয়..ডা মাস ! তোরে দেহিনা চোহের দেহা-
দেহিনা তোর হাসি । ভাবতেই খা খা কইরা উডে,
পাষাণ বুক খান আমার । তুই,
কেমন আছস রেবতী?পিয়ারী আমার,
(রেবতী, আমি আইতাছি এই ঈদে)

নিমূর্ত প্রেম আর মানবীর প্রতি প্রেমে কবির হতাশা,বেদনা,নৈরাশ্য,গ্লানিতে কবি জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।বিচ্ছেদ যন্ত্রণা,অপ্রাপনীয়তার হাহাকারে কাতর কবির সত্ত্বাকে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছে।নিঃসীম শূণ্যতা,একাকীত্বের জ্বালা,যুগ-মানসের সংকট,প্রেম-বিচ্ছিন্নজাত অভিঘাতে কবি গেয়ে ওঠেনঃ

................................
আমার রক্তের প্রতিটি শ্বেত কণা, অণুচক্রিকার প্রাত্যহিক প্রার্থনা বেদনার মঞ্চে। ভ্রান্তিবিলাসী হয়ে ছটফট করি প্রতিফলিত সূর্যালোকের রাতে, হেমন্তের উর্বর গর্ভবতী বিকেলে! আমি কাঁদতে থাকি ঝুমবরষারয়, মৌনতার অদ্ভুত মুখরতায়। স্মৃতির পাতারা, তোমরা আমাকে পূর্ণ করেছ জমাট কষ্টের সিম্ফনী দিয়ে। কোন সুখ, কোন আনন্দ এমনকী জনাপাচেক লোকের কোলাহল উপভোগের সুখটুকু, বিনষ্ট করেছ ফালি ফালি করে কেটে। এখন আমার আর দু:খ চাষের কোন বর্গা জমি নেই, তাই বলছি তোমাকে- বেচে থাকাটা খুব সহজ, যন্ত্র হয়ে, শাদা কালো স্বপ্ন বিসর্জনে, আলো-ছায়া আবেগ ছাড়া জড় দেহের পার্শ্বস্থ বৃদ্ধি নিয়ে। 
(বিচ্ছুরিত বিষাদ কণা)

কবির হৃদয় হচ্ছে উর্বরা ফসলী জমি।পূর্বসুরী কোনো কবির লেখার একটি বাঁ দু'টি লাইন বাঁ স্তবক যখন অন্য একজন কবির মনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বণিত হতে থাকলে অনেক সময় সেই অবচেতন-অনুকম্পন থেকে শুরু হয় নূতন একটি কবিতার বীজ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার,জন্ম নেয় নূতন একটি কবিতাঃ

এই খানে নেমে এসেছে, শশ্মানের শব পোড়ানো রাত্রির মতন-
অদ্ভুত ক্লান্ত নিস্তব্ধতা । মৃত্যু এখন তার শীতলতা নিয়ে;
হয়ত ঘুরছে আমাদের আশেপাশে। হয়তবা দেহান্তরের খেলায়,
লীন হবে পরম সত্ত্বা কোন। অন্ধকার আমাদের অবসন্ন করে,
নিয়ে যাবে বিনাশের কাছে । ভূষা কালি বা কয়লার মতন
অসভ্য এই রাত; কিশোরীর ঢেউ খেলানো খোলাচুল কিংবা
উঠতি বুকপাহাড়ের খাজের মতন দৃষ্টি সুখের নয়।
(মৃত্যু)

অন্তর্গত উত্তাপধারী কবি রেজওয়ান তানিম নমনীয়,সর্বজনবোধ্য ভাষাতেই কবিতার দৃঢ় বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনঃ

জমাট নির্জনতায় জড়ানো আজকের এই
নিশীথের শেষ প্রহর । ভূতুড়ে কেমন এক  
অনুভূতি ছড়ায় এই আমাতে।  
বসে আছি আমি পার্কের বেঞ্চিতে
কৃষ্ণপক্ষের গোল রূপোলি চাঁদ-আমার পানে চেয়েছে
বিষন্ন দৃষ্টি মেলে। অবাক হয়েছে হয়তবা
উদভ্রান্তের মত নিজেই আমি নিজেকে দেখছি বলে।
ওতো জানে না হিংস্রতা আমার
ঢেকে গেছে জ্যোছনাধারার স্নিগ্ধতায় !
ঘুমিয়ে পড়েছে যান্ত্রিকতা যত শহরের,ব্যস্ততার মুখোশ 
ঝেড়ে ফেলে শান্ত এখন ঢাকা ।
ঘুমন্ত গাছেরা এখন, স্বপ্নে হয়ত আকঁছে
অব্যক্ত কথার ব্যক্ত চিত্র রূপ,সুর ভাজে নতুন গানের।
(আজ রাত্রে)

ভাববাদী দর্শনের প্রভাব এবং ফল্গুধারার তানিকবি রেজওয়ান তানিমের কবিতার অন্তঃসার।তীক্ষ্ম ইন্দ্রিয়বিলাসী কবির কবিতায় বিলাস প্রকটভাবে ফুঁটে উঠেছে।শব্দ-রুপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ তাঁর কবিতার অবয়বে আভা বিজাড়িত হয়ে রয়েছে।তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে প্রস্তুত করে ধরে রেখেছেন যেন কোন মুহূর্ত বাদ না পড়ে।দিন-রাতের মুহূর্তগুলো তাঁর কবিতার বাগানে বিচিত্র বর্ণ ফুল হয়ে ফুঁটে উঠেছে দূরন্ত আবেগ প্রকাশের পরিমিতির পবিত্রতায়।মর্ত্য প্রীতির আসীম কামনার বিহবল সৌন্দর্য্যবোধ চরমভাবে বিকশিত তাঁর কাবিতায়ঃ

নির্লিপ্ত আহ্বান করে যায়, আমাদের ক্লান্ত কটি প্রাণ !
বিশ্ব চরাচর অন্ধকার হয় তাই, নিকষ রাত্রির মাঝে ।
চলে নিদ্রায়জন, দিবা নৃত্যের শেষ মুদ্রা, ভুলে যায়
মানবেরা। বিছানায় পতন ঘটে নিদ্রালু সব জড় দেহের,
জেগে থাকে বুড়ো পৃথিবীটা তবু। অবাক প্রত্যাশা তার
ক্লান্তি হীন, সূর্য উদয় দর্শনে। রাতজাগা শ্রমিকের
দল, সদা ব্যস্ত নিশাচরের মত। অসামাজিক কত
হায়েনাদের ভিড়ে, হারিয়ে যায় যত রক্ষীর দল। নিভে
আসে ম্লান লণ্ঠন তাদের। বিশাল আয়োজনে রাতের,
 শ্বাপদেরা নিশ্চুপ, নির্ঘুম ।
                 মৃত্যু শাশ্বত তাই, ঘুম নয়;
উপলব্ধি আমার। ঝুলে থাকা হিম রক্ত, দেয়াল বাসী
হলদে প্রাণীটিও সম্মতি জানায়, চিরচেনা টিকটিক শব্দে ।
রাত্রিকালীন সভায় মত্ত হয়, পাড়াতো সারমেয়োর দল ।
চালায় অন্বেষণ রাতের খাবারের, দু শূড়ো আরশোলার
দল । হয়ত বাছারা জানতে চায়, শুধু খাবারের সন্ধান ।
না পেলেও ক্ষতি নেই, খেতে দেবে নিজের কাইটিন খোলস ।
সব শেষে নীরব চারপাশ ; শব্দের খেলায় মত্ত কবির দল,
ডোবে নিস্তব্ধতায় । এই অদ্ভুত শব্দহীন রাত, ভয় জাগায়,
মনে হয় মৃত্যুর আদি দশা । ঘুম তাই মৃত্যুর পদধ্বনি নিয়ে
আসে। টুকরো মৃত্যুরা নিয়ে যায় পরম বিনাশের কাছে ।
(রাত্রির কবিতা)

সম-সাময়িক হলেই উত্তরাধুনিকতা হয় না।সম-সাময়িককে উপলক্ষ করেই আয়ত্ব করতে হয় আরেক মাত্রা।সময়ের বাঁক-স্পন্দনের পরশ ছুঁইয়ে দিতে হয় সব সময়ের প্রশ্নকে।সময়কে ছুঁইয়ে সময় পরিচ্ছিন্ন স্বাবলম্বন অর্জনের মধ্যেই থাকে উত্তরাধুনিকতা;যার সন্ধান সহজ নয় অথচ তার সন্ধান অন্বেষণই কবির কাজঃ

নিজেকে এখন গুটিয়ে নিয়েছি আমি,
ইদানীং বড্ড একঘেয়ে লাগে-
বন্ধু কিংবা চেনা জানা মানুষের ভীড়ে ।
এখন একা থাকি মাঝে মাঝেই, স্বেচ্ছা নির্বাসনে !
এই যেমন গত পাচ দিন ;
ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ি নিরুদ্দেশ যাত্রায় ।
কানাগলি পেড়িয়ে রেললাইনের ধার,
হাটতে হাটতে উপশহরের ছোট্ট কোন পার্ক,
কাদা জল মাখা গ্রামের পথে হেটেছি,
রোদ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে । কোথায় ছিলাম
এতদিন, তাই বলা মুশকিল । এমনি করেই
হারিয়ে যাই বারংবার । আবার ফিরে ফিরে আসি !
তখনি ফিরে আসে লুকিয়ে থাকা
ইচ্ছেরা, আমার ভাললাগার নুড়ি পাথর গুলো-
তখনি মনে হয়, শুরু করি অধিকারের লড়াই ;
বুঝে নেই আমার প্রাপ্য টুকু কড়ায় গন্ডায় ।
ঢেকে দেই ব্যথর্তার কালি, উড়াই বিজয় নিশান ।
হা হা হা অর্থহীন সবকিছু ; তবু ভাল লাগে
এই লুকোচুরি । মূল্যহীন এ জীবনটা, মূল্যবান করার
প্রচেষ্টা চলে তখন ক্লান্তি হীন ।
..............................
..............................
এগিয়ে যাক সে ।পলি পরে
থেমে যাওয়া তার চরাচর উন্মুক্ত হোক
ভালবাসার পরশে ! আমি আছি এখনো
ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ স্বপ্ন নিয়ে । হয়তবা
একদিন শেষ হবে নিজের থেকে নিজের
পালিয়ে বেড়াবার খেলা ।
(নষ্ট ছেলের ইতিকথা)

বিশ্ব-প্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্য্য ও আনন্দ তথা প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক কবিতার এক ও প্রধানতম বিষয় কবি রেজওয়ান তানিমের।অপরাপর মানুষের জীবন ও প্রকৃতির এক আবেগমন্ডিত,আনন্দঘন প্রতিভাস মূর্ত করে তুলে ধরেন তাঁর কবিতায়ঃ

মায়াবী ভ্রমে মজে থাকা
ভ্রান্তিবিলাসী যুবক এক; লাল নীল
প্রজাপতির পাখনার নীচে
করেছিল রক্তবীজের
নীল নকশার সন্ধান ।
ডিম্ববতী মথেরা যখন, ডিমে তা দেয়;
প্রজাপতি পাখা মেলে ওড়ে
যুবকের মাথায় ঘোরে উড়বার
আরো প্রবল নেশা

অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে;
সে একদিন রূপান্তরিত হয় ।
দিঘীর জলে পা ফেলা শান্ত শাদা বকে ।
জীবনের জাগতিক যন্ত্রণার বিনাশ
তাকে মুক্ত করে । অপস্রিয়মাণ আলোয়
কুঁকড়ে যাওয়া শতপদীর
দু ফুট পথ অতিক্রমণ, আটকে
যায় সসীম-অসীমের দান্দ্বিক
বেড়াজালে পথের শেষ কোথায় ?
অমীমাংসিত অমূলদ সংখ্যার মত
সময়ের পূর্ণতা অপেক্ষমাণ মস্ত মৃত্যুর
হাতে । অদ্ভুত জীবনেরা তাই
আয়োজন করে পরম বিনাশের
চর্চিত অনুপান । অগোচরে টুকরো টুকরো
ক্ষয়, প্রোথিত করে- মহীরুহের বীজ ।
(অপেক্ষা)