Powered By Blogger

শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১০

স্বতন্ত্রধারার সনেট-৭

রবিউল মানিক

পুঁজিবাদ কেড়ে নেয় মানুষের বিবেক,চিন্তার
স্বাধীনতা,মৌল নীতিবোধ,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য,বিশুদ্ধ
ভালোবাসা ভূমিষ্ঠের সাথে সাথেই  বিচ্ছিন্নতার
মর্ম বেদনায় জর্জরিত মানব সন্তান আর্ত
চিৎকারে দিগন্ত কাঁপিয়ে তোলে আপন সত্ত্বার
বিচ্ছিন্নতা বোধে ধর্ম;ধার্মিকেরা লোভের উদ্ধুদ্ধ
প্রলোভনে ঈভ স্বর্গচ্যুত ঈশ্বর অবাধ্যতার

অরণ্যচারী মানুষ স্বীয় স্বার্থে বিচ্ছিন্ন লোভের
প্রাচুর্য ও প্রতিপত্তি আধিপত্য অন্তর্দ্বন্দে ক্ষত-
বিক্ষত মানুষ আজ যন্ত্র সভ্যতার নিষ্পেষণে
বিস্মৃত দায়িত্ববোধ চেতনার অস্তিত্বে সমার্ত
এক পৃথিবীর পথে;জাগতিক শূণ্যতা ক্ষোভের
সাথে দু'পায়ে মাড়িয়ে মানব ভালোবাসার মতো
শাশ্বত সুন্দর বুকে জয়ী  পুঁজিবাদের শোষণে

৩১.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

বিপ্লবের মন্ত্র

রবিউল মানিক

রৌদ্রে পোড়ে ফসলী মাঠ,অনাবৃষ্টিতে ছেয়ে আছে দেশ
শুকনো ডালে আর্তনাদে একটানা ডেকে যায় কাক
অভিমানে অজানায় পাড়ি দিয়েছে মেঘ
বৃক্ষনিধন বন্ধ না হলে তারা আর ফিরবে না
মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি গোলাপ
আর সুবাস ছড়াবে না

নিরন্তর ছন্দে বয়ে যাওয়া নদী বলে:
কেন এই শিশুশ্রম,কোথায় শিশুর মৌলাধিকার
দোয়েলেরা অহরহ চিৎকার করে ঘরে ঘরে জানিয়ে দিচ্ছে:
উপড়ে ফেলো অমানবিকতার নিগূঢ় শেকড়
পূর্ণচাঁদ বুকের গভীরে ঢুকে দেখে নেয়
কতটুকু কালিমা ধরে রাখে,মানুষ

থোকা থোকা আগুনরাঙা কৃষ্ণচূড়া নিরন্ন,অনাহারী মানুষকে ডেকে বলে:
বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হও,মানব।

২৭.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

মুঠোফোন কাব্য

কবিতায় কেন এতো দীর্ঘশ্বাস, কেন এতো হতাশা
আর কেনইবা বিদ্রুপের এতো বিষবাষ্প ও ক্ষোভ
আটলান্টিকের ওপার থেকে ভেসে আসে মুঠোফোনে
মুদ্রিত কন্ঠস্বর;আমার কবিতার একমাত্র গুণমুগ্ধা পাঠিকার

জন্মান্ধ পথিক আমি
পথ খুঁজে ফিরি হাতড়ে হাতড়ে
গন্ধ শুঁকে পার্থক্য নির্ণয় করি
চন্দ্রমল্লিকা কিংবা সবুজ বনানী'র
নোনা গন্ধে বুঝি সমুদ্রের খুব কাছে এসে পড়েছি
দিনের সুচনাকারী লাল টকটকে সূর্য্য দেখিনি কখনো
মিহিন বাতাসে ভেসে আসা পাখ-পাখালির ডানার শব্দে
বুঝে নেই রাতব্যেপে অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করা ক্লান্ত সূর্য্য
আড়মোড়া ভাঙছে

ফোটার আগেই বিষাক্ত কীটের দংশনে জর্জরিত হচ্ছে গোলাপ
সামুদ্রিক শব্দোচ্ছ্বাসে শুনি: ধ্বংশোন্মুখ সভ্যতার বিলাপধ্বনি

মুঠোফোনে জলতরঙ্গের রিনরিনে কন্ঠস্বর আবারো বলে:
কবিতায় সুখ-শান্তির উষ্ণতা নেই কেন
কেন নেই নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও স্বাচ্ছন্দ্যজীবন
দুঃসহ নৈঃসঙ্গ ও ঊষর প্রকৃতি কেন বারবার ঘুরেফিরে আসে
কবিতার স্তবকে স্তবকে কেন থাকে না
অভিনব নান্দনিক বাচনভঙ্গি,রুপক আর চিত্রকল্পমুখর
গভীর এক সমুদ্রের কল্লোল

ধীর,গাঢ়স্বরে বলি:
আধুনিক মানুষ ও তার সৃজনশীলতার সংগ্রামই আমার কবিতায় উপজীব্য
সত্য ও সুন্দরের সংগ্রাম নান্দনিক প্রেমের চে' আমার কাছে আকর্ষণীয়
শিশিরপ্রতিম সজীবতায় উত্তর ভেসে আসে:
ভালো থাকবেন,কবি।শুভ কামনা অবিরাম।

২৯.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১০

বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস

বোধিবৃক্ষের তলায় ধ্যানে নিমগ্ন থেকে দেখেছি:
গৌতবুদ্ধ'র বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করেনি
স্বেচ্ছায় করতলে পেরেক ঠুকে দেখেছি:
যীশু'র কোনো কষ্ট-ই আমি অনুভব করিনি

একজীবনের সমস্ত বোধ আবেগানুভূতি বন্ধক রেখেছি
রুপসীর গভীর কালো চোখের মনিতে বন্দী
সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতোন আছড়ে পড়ে ভালোবাসা
নিরন্তর ছন্দে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে বসে শুনি ভাঙ্গনের গান
কল্পনার বজরায় রুপসীকে নিয়ে ভেসে বেড়াই
নিঃসীম,শান্ত নদীর বুকে---চাঁদের রক্তিম আলোয়
রুপসীর রুপ্সুধায় আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকি
আলিঙ্গনাবদ্ধ গোটা রাত;উদ্ধত নগ্নতা নয়
শরৎস্নাত ভোরের তাজা শিউলির স্নিগ্ধ ভালোবাসায়

রুপসীর অবহেলা,অপমানে পড়ে থাকি অনন্ত সমুদ্রের তটে
বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস ভেসে যায় বাতাসে
সাধ-আহ্লাদ কাম আনন্দ বিলীন হয়
সমুদ্রের সফেদ ফেনায়।

২৯.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১০

জ্বলন্ত চোখ

চারিদিকে অশান্তির লেলিহান অগ্নিশিখা
প্রশান্তিহীন রাত কেটে সকালগুলো আসে---
হতাশার কাফন মুড়িয়ে;তপ্ত আগুনরাঙা দুপুরেও
বুকে জমাট হিমবাহ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়
অবসন্ন বিকেলগুলো রাজপথ ভরে ওঠে নিরন্ন,বেকার আর
ন্যুব্জ কাধের কোণঠাসা মানুষের মিছিলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
অনিচ্ছুক ওঠে আকাশপানে

একহাতে টর্চ,আরেকহাতে কোচ নিয়ে মাছশিকারীর চতুরতায়
এনজিও হন্য হয়ে খুঁজে ফেরে হতদরিদ্র---চক্রঋণের ফাদে ফেলার
দারিদ্র জরীপ করে গবেষক,ডক্টরেট ডিগ্রীধারী
ভরে ফেলে ব্যাংকের সুরক্ষিত ভল্ট বিলিয়ন ডলারে
হালের বলদ,ভিটে-মাটি উচ্ছেদ হয়ে কৃষক পরিণত হয় ভূমিহীনে---

অসম বাণ্যিজের ভারে নুয়ে পড়া অর্থনীতি আবদ্ধ হয়
শর্তযুক্ত বৈদেশিক ঋণের জালে,দাতাদের প্রেসক্রিপসনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের
মালিকানা চলে যায় ঋণখেলাপির হাতে,সাম্রাজ্যবাদী জাহাজভর্তি
খাদ্য নয়,ত্রাণ আসে কনডম,জন্ম-নিয়ন্ত্রণ বড়ি,তাঁবু,স্কার্ট...

ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হাড্ডিসার মানুষের চোখ ধ্বকধ্বক জ্বলে

২৫.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।
http://www.bangladeshnews24x7.com/literatare/poetry/3430-2010-12-31-13-52-29.html

শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০

ভালবাসা

ভালবাসা পেলে কবির অকালমৃত্যু ঘটে
কিংবা
'দেহচ্যুত,দেহাতীত প্রেমের রোমাঞ্চ কবিকে স্পর্শ করে না'
এ আমি বিঃশ্বাস করি নাঃ
ভালবাসাই আমার প্রেরণা
ভালবাসাই আমার কবিতা্য উপজীব্য

আজন্ম ভালবাসা প্রত্যাশী প্রেমিক কবি আমি
অকাতরে দু'হাতে বিলিয়ে দিই ভালোবাসা---
অষ্টাদশী যুবতীর পায়ে,ত্রিশোর্ধ রমণীর চিবুকে,
চল্লিশোর্ধ পরস্ত্রীর করতলে কখনো বা গণিকার ঝুলেপড়া স্তনে
বাদামী,পীতাভ,কৃষ্ণাঙ্গী কিংবা শ্বেতাঙ্গী
যে কোন রমণী হৃদয়ই আমার কামনার বস্ত
একনিষ্ট ভক্ত পূজারীর নিষ্ঠায় নিমগ্ন থাকি ভেনাসের আরাধনায়

মানুষ ও মনুষ্যত্বের ভবিষ্যৎ নিক্ষিপ্ত হয় সভ্যতার ঘূর্ণিপাকে
অবসাদ,শূণ্যতাবোধ ও বিষাদাত্মক্তায় আক্রান্ত যৌবন
হোঁচট খায় নিরুদ্দিষ্ট সমুদ্রের তটে
ভুল ভালোবাসা এসে দরোজায় সজোরে কড়া নাড়ে তবুও
সাড়া দিতে ইতঃস্তত করি না কখনো

হৃদয়ের অন্তঃক্ষরণে জ্বলে ওঠে বুক
দাবানলে পুড়ে যাওয়া  পোড়া আর ধ্বংশস্তুপেও বুকের ভেতরে
অটুট থাকে ভালোবাসা,ক্রমেই স্তুপাকার হয়ে ওঠে---
প্রিয়তমা নারীর জন্যে ভালোবাসা।

২৩.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১০

স্বপ্ন

আজন্ম দুঃখের সাগরে বসবাস
বেদনায় গাঢ় নীল সর্বাঙ্গ
তবু ফ্যাকাসে চোখে স্বপ্ন দেখি:
স্বর্ণালী এক আগামী'র
স্বপ্ন ছাড়া কে কবে বেঁচে ছিল
২২.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১০

ভীতু

নান্দনিক গোলাপ না-কি রুটি-সব্জী
কোনটি বেশী প্রিয়---
আজো বুঝে উঠতে পারি নি ঠিক য্যামোনটি
ঠাহর করতে পারি নাঃ
তুমি না-কি কবিতা
কে কতখানি হৃদয়ের জায়গা দখল করে আছে

কৃষ্ণগহ্বরে একে একে বিলীন হয় ছায়াপথ,নীহারিকা,ধূমকেতু
সৌরজগত,আস্ত গ্যালাক্সী
উত্তরাধুনিকতা গ্রাস করে নেয় চর্যাপদের ঐতিহ্য
পদাবলী-মঙ্গল-মহাকাব্যের সুষমায়িত ইতিহাস

আজন্ম সমুদ্রে বাস তবু
সমুদ্রে ভয়---
ঝড়ের আগে ঠিক নিশ্চিত করে্ নিই নিরাপত্তা
আজীবন সঞ্চয়িত ভালোবাসা পেয়েও
চোখের সমুদ্র হ'তে নিদ্রা বিসর্জন দিয়ে
নিরন্তর জেগে থাকি হারাবার ভয়ে

এ্যামোনই ভীতু আমি

২০.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।
https://sites.google.com/site/alasadupura/kabita

বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০

নান্দনিক ত্রাণ

চারিদিকে অথৈ অন্যায়,সীমাহীন পাপাচার
পরস্ত্রীর স্তনে জমে ওঠা পরকীয়া প্রেমের নিষিদ্ধ আনন্দ
ইতি টানে দাম্পত্য কলহে---অমানবিকতার নিগূঢ় শেকড়
শরীরের শিরা-উপশিরা ব্যেপে ছড়িয়ে যায় মহাময়ারী আকারে।

ভালোবাসায় সিক্ত রসালো কোনো ঠোঁট আবেগে এগিয়ে আসে না
বড়ো বেশি মহার্ঘ্য আজ জৈবনিক প্রেম।

আদিম অসভ্য আমি প্রস্ফুটিত যৌবনধারী তরুণীর গর্বোদ্ধত
স্তন-কটি-নিতম্ব লালসার কামদৃষ্টিতে ভস্মীভূত করি
উন্মত ক্রোধে মর্দন করি যুবতীর নিখুঁত নিটোল শাদা নরম স্তন
অন্ধের মতোন হাতড়ে বেড়াই আঘ্রাণাতা-অভঙ্গুর-পিচ্ছিল যোনী।

হিংসার বিষবাষ্পে ভারী বাতাসে মহানন্দে শিকার ধরে চিল,শকুন
আর্তনাদে ডানা ঝাপটায় দোয়েল।
চাঁদহীন মধ্যরাতে শ্মশ্মাণ পেরিয়ে আসে প্রেত্মাত্মা দলে দলে গলিত শবের গন্ধে,
প্রান্তর থেকে প্রান্তর,নিঃসীম আকাশ থেকে নিশিথ বনভূম,
লোকালয় থেকে নির্জন প্রদেশ কেঁপে যায় প্রেত্মাত্মার উত্তাল নৃত্যে---
ত্রস্তা জননী আকড়েঁ ধরে শিশুকে।

চিন্তা শুন্য,চেতনায় খরা মননের মন্বন্তরে নান্দনিক ত্রাণবাহী
কোনো জাহাজ ভেড়ে না আশার বন্দরে।

১৫.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

শনিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১০

বাংলা কবিতাঃআধুনিকতার সুচনা-৩

প্রত্যেক কাল বা দশকে পূর্বকালের মনীষীদের দর্শন পরিমার্জিত বা সংশোধন হয়ে আসছে অনাদিকাল থেকেই।প্রত্যেক কাল বা দশকে পূর্বকালের সাহিত্য, শিল্পকলা কিংবা চিন্তা চেতনার নব নব উন্মেষ ঘটে থাকে।কখনো কখনো সেটা পরিমার্জন বা কখনো কখনো সেটা পুরোপুরি পরিত্যাজ্যা হয়।নিউটনের সূত্র মতে,'বাহির হতে কোনো বল বস্তর উপর প্রযুক্ত না হলে অর্থাৎ বস্তর উপর বলের লব্ধি শূণ্য হলে স্থির বস্ত স্থির এবং গতিশীল বস্ত সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকে' এবং সেই বল সরবরাহ করেন পিকাসো কিংবা জউনুল আবেদীনের মতোন চিত্রকর কিংবা শার্ল বোদলেয়ার বা জীবনানন্দ দাশের মতোন মহৎপ্রাণ কবিরা।কবিতা একটি স্বতঃস্ফুর্ত প্রণোদনা হলেও এতে কবির দীর্ঘ প্রস্ততি ও নিরন্তর সাধনার প্রয়োজন।এ দু'য়ের সমন্বয় সচরাচর ঘটেনা বলেই প্রতি দশকে মহৎ কবিরা জন্ম নেন না।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতাবাদ পাশ্চাত্যের আধুনিক কবিতার চেয়েও বিস্ময় ও বিপর্য্যয়করভাবে আবির্ভূত হয়েছে।যেখানে একজন মহৎপ্রাণ কবির জন্যে দশকের পর দশক,শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয় সেখানে ১৮৯৯-১৯০৯ সালের মধ্যে বাংলা ভাষায় আবির্ভূত হয়েছেন পাঁচ পাঁচজন আধুনিক মহৎপ্রাণ কবি যথাক্রমে জীবনানন্দ দাস(১৮৯৯-১৯৫৪),অমিয় চক্রবর্তী(১৯০১-১৯৮৬),সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০),বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪) ও বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)।অথচ আমাদের পদাবলী সাহিত্যের বড়ু চন্ডীদাস,চন্ডীদাস,বিদ্যাপতি,জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাস--- এ পাঁচজনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে চার শতাব্দীকাল তেমনি মঙ্গলকাব্যের তিনজনের(মুকুন্দরাম চক্রবর্তী,বিজয়গুপ্ত ও ভারতচন্দ্র রায়) জন্যে তিন শতাব্দীকাল,মহাকাব্যের একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রোমান্টিক কবিতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই 'কল্লোলের কাল'ই হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার জন্মকাল। কল্লোলের কাল বলতে এখানে শুধু 'কল্লোল'ই নয়,কল্লোল,প্রগতি এবং কালি-কলম---এ তিন শাখা নিয়েই কল্লোলের কাল।কল্লোলের সুচনা-১৯২৩, কালি-কলমের সুচনা-১৯২৬ এবং প্রগতির সুচনা-১৯২৭ । এই সময়েই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত বলে সবাই একমত হন।পাশ্চাত্যে ১৯২২ সালে টি. এস. এলিয়টের 'The Waste Land' বা পোড়ামাটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ এবং ১৯২৫ সালে রবীন্দ্র কবি জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়েছে 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং বুদ্ধদেব বসু'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মর্মবাণী'তে(১৯২৫) সালে নূতন কবিতার নান্দীপাঠ করেছিলেন। সুতরাং সকল সাহিত্যবোদ্ধারা ১৯২৫ সালকেই বাংলা কবিতার আধুনিকতার সুচনাকাল হিসেবে গণ্য করেন।
আমরা নিঃসন্দেহে এটা বলতে পারি যে,বিশের দশক হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার ভিত্তিস্থাপন বা জন্মের বছর আর ত্রিশের দশক হচ্ছে প্রতিষ্ঠা লাভের বছর।যদিও বিশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার আত্মপ্রকাশে ছিল অসীম সীমাবদ্ধতা।যে সমস্ত তরুণ কবিরা আধুনিক কবিতার নূতন ফর্ম নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সাহস ছিল বেশী কিন্তু বয়সে নবীন।তাঁদের আত্মপ্রকাশে ও আত্মপ্রচারের সুযোগ ছিল কম।তাঁদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র,শিক্ষার্থী কিংবা নব্য বেকার যুবক।সে সমস্ত বিদ্রোহী তরুণ কবিদের প্রতি তখনকার সাহিত্য শাসকেরা প্রসন্ন ছিলেন না এবং এ সমস্ত কবির কবিতার কাব্যরীতি ও নির্মাণশৈলী (যেমন বুদ্ধদেব বসু’র রবীন্দ্র চর্চিত সাধুরীতি,সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নিও-ক্ল্যাসিক্যাল কাব্যরীতি) রবীন্দ্র মনস্ক কাব্য-পাঠকদের অভ্যস্ত রুচির পক্ষে তৎক্ষনাৎ গ্রহনযোগ্য ও অনুকূল হয়ে ওঠেনি।বিশের দশকের সম্পাদক ও প্রকাশকেরাও সাহস ও দূরদৃষ্টি সঞ্চয় করে রবীন্দ্র প্রভাব বলয় ভেঙ্গে বাইরে আসতে চাওয়া এসব নব্য তরুণ কবি যশঃপ্রার্থীদের পত্রিকার দ্বার কিংবা কাব্য প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতা করেন নি। সমাজে প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক সঙ্গতিহীন দুঃসাহসিক এ কবিগণ স্বীয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ থেকে রবীন্দ্র সাম্রাজ্যের মহাপ্রাচীরে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নবীন কবিতার বীজ থেকে চারাগাছ,চারাগাছ থেকে কিছু কিছু ফসলও তুলতে পেরেছিলেন সে সময়েই অর্থাৎ বিশের দশকে।ফলে গোটা বিশের দশকজুড়ে তরুণ এ সমস্ত কবিদের যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের এবং সর্বপ্রভাবব্যাপী রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে এবং সে সংগ্রামে কবিদের ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার চিহ্ন বিশের দশকের কবিতার অঙ্গে অঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়।ত্রিশ দশকের ইতিহাস হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তরুণ কবিদের সংগ্রামে  রবীন্দ্র প্রভাবকে পরাস্ত করে আধুনিক বাংলা কবিতা সুস্থিত হতে পেরেছে।ত্রিশ দশক হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার স্বয়ংবৃত্ত ও দীপ্ততার ইতিহাস।বিশের দশকে  যে নূতন কবিতার বীজ রোপণ করা হয়েছিল মাঠ ভরা তার অতুলনীয় ফলন দেখা যায়। ত্রিশ দশকের কবিতায় বিষয়বস্তর ক্ষেত্রে যেমন নূতন এক অভিনবত্ব এসেছে তেমনি কাব্যশৈলীর ক্ষেত্রেও অপরিমেয় বৈচিত্র এনেছেন তরুণ এ সমস্ত কবি তাঁদের সৃজনশীলতায়।তাঁদের এ সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ইউরোপীয় সাহিত্য মনস্কতার ফল।মন ও মানসে রবীন্দ্র চেতনার দুর্দমনীয় প্রভাব অস্বীকার ও নিজস্ব কাব্যরীতি অনুসরনরত ও পাঁচ মহৎপ্রাণ কবি (পঞ্চপান্ডব) ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যালোকেরই নাগরিক।বিদেশী সাহিত্যের অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান,সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব,পাশ্চাত্য সাহিত্যের নান্দনিকতা এমনকি বিচ্ছিন্নতাবোধও তাদের কইতায় স্পষ্ট রুপে ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রত্তোর বাংলাভাষার শ্রেষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন কীটস,এলিয়টস,বোদলেয়ার এবং তারঁ কবিতায় পরিস্ফুটিতভাবে ফুটে উঠেছে তাদের প্রভাব। কীটস যেখানে লিখেছেনঃ
'Much have I travelled'
জীবনানন্দ সেখানে লেখেনঃ
'অনেক ঘুরেছি আমি।' এবং
Then fell I like some watcher of the skies
When a new plannet swims into his ken
Or like start cortez when with eagle eyes
He star'd at the pacific
জীবনানন্দের কাছে হয়ে যায়
'.........অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে;.......'

শার্ল বোদলেয়ার যেমন চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখেছেন,জীবনানন্দও তেমনি মানুষের স্বভাবে দেখতে পেয়েছেন চিল,শকুন,শুয়োরের স্বভাব।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এলিয়টের রুপক ও চিত্রকল্প দেশীয় আবহাওয়ায় তাঁর সৃজনশীল অনুভব দিয়ে নূতন এক মাত্রা দিয়েছেন। যেমনঃ
"O curley,cry no more in the air
Or only to the water in the west
জীবনানন্দ সেখানে লেখেনঃ
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

বুদ্ধদেব বসু যথেচ্ছভাবে ইংরেজী কবিতার চিত্রকল্প ব্যবহার করে আধুনিক বাংলা কবিতায় নূতন এক স্রোত প্রবাহ সৃষ্টি করেন।রসেটি তাঁর 'Trow Town' কবিতায় লেখেনঃ
Look,I bring Thee carven cup
........
Each  Twin breast is an apple sweet বুদ্ধদেব বসু'র কাছে হয়ে যায়ঃ
হেলেন রচেছে অর্থ নিজের বুকের ছাঁচে
........।
হেলেনের বুকে দুটি পাকাফল ভরেছে রসে।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে চিত্রকল্প ও উপমায় নিয়ে এসেছেন স্বাদেশিক ভাষার নিজস্ব ভাবময়তা।
ভালেরি যখন লিখেছিলেনঃ
All perishes.A thing of Flesh and pore
Am I.Divine impatiebce also dies.
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুরুপভাবে বলেনঃ
মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা
যাতনা শুধুই যাতনা সুচির সাথী।
কিংবা এলিয়টের 'The Burial of the Dead' কবিতায় যখন শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতাকে এভাবে চিহ্নিত করেছেনঃ
April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
বিছিন্নতাবোধের যাতনায় জর্জরিত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁ 'প্রতিপদ' কবিতায় তা বর্ণনা করেনঃ
'সমাপ্ত সংরক্ত রাত্রি।-শ্রান্ত দোলপূর্ণিমার শশী,
....নীড়ে নামে,দেখে,চতুর্দিকে
বাদুড়-পেচাঁর ঝাঁক।অপুষ্পক ত্রিভঙ্গিম নীপ
দুঃস্বপ্নে প্রলাপ বকে,শব-শিবা-সর্পে পরিবৃত।
সমাপ্ত সংরক্ত রাত্রি;চূর্ণমুষ্টি ধূলিধূসরিত।

এলিয়টকে আদর্শ করে বিষ্ণু দে কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন।নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি,ক্লান্ত ও লক্ষ্যহীন জীবন-যাপনে যাপিত এলিয়ট বলেনঃ
What shall we do tomorrow?
what shall we ever do?
The hot water at ten
And if it rains,a closed car at four
And we shall play a game of chass.বিষ্ণু দে'র কাছে তা মধ্যবিত্ত্বের করুণ অবস্থায় পরিবর্তিত হয়।
তারপরে চা এবং তাস
ব্রিজই ভালো,না হয়তো ফ্লাস
ঘোরতর উত্তেজনা,ধূমপান আর্তনাদ,খিস্তি,অট্টহাসি
তারপরে বাড়ি
অম্লশুল আর সর্দিকাশি
এলোমেলো,গোলমাল,ঘেঁষাঘেঁষি,ধোঁইয়া আর লংকার ঝাল।

ইংরেজী সাহিত্যের বিদগ্ধ পন্ডিত অমিয় চক্রবর্তী স্বতঃস্ফুর্ত কবি ভাবনা আমরা দেখি যখন হপকিন্স লেখেনঃ

I caught this morning mornonbg's minion kingdom
Of daylight's dauphin,dapple-dawn-drawn
                                                falcon on his riding
Of the rolling level underneath him steady air and striding
High there,how how he rung upon the rein of a wimpling.
অময় চক্রবর্তী'র কাছে তা হয়ে যায়ঃ
চোঙ।কালো ছলছলে তল,উপরে চাকতি শুণ্যরঙা
ইটের ফাটল লাল জবাফুল সাওঁতাল পিতলের
                                                ঘটি ঘটি রাঙা
গামোছা।গাঁয়ের বউ ছায়ে
কবি কাঁদে কাক ঠোঁট ঘ্যান ঘ্যান দড়ি,যায় ব'য়ে
গ্রীষ্মের কান্নাঃউনোনের রান্না ঘরের জল,ওঁ
চুন সুরকির ভাঙা চোঙ।


সহায়ক গ্রন্থঃ
১.আধুনিক বাঙলা কবিতা-হুমায়ূন আজাদ সম্পাদিত।
২.জীবনানন্দ দাশ মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার-আবু হাসান শাহরিয়ার।
৩.হাজার বছরের বাংলা কবিতা-মাসুদূল হক।
৪.আধুনিক কবিতার মানচিত্র-জীবেন্দ্র সিংহ রায়।


(ক্রমশঃ)


বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১০

সুখী কৃষাণীর লাউয়ের মাচাঙ

এ্যাকদিন ঘাম আর ব্রীজের ধূলো উপেক্ষা কো'রে চলে
গিয়েছিলাম প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে---
প্রথাসিদ্ধ শান্ত নদীর মৃদ্যুমন্দ ঢেউ,দু'ধারে সদ্য ফসল কাটা মাঠ,
দিগন্তজোড়া বিস্তৃত সবুজ,মাথার ওপর অবারিত আকাশ দেখে
আজন্ম নাগরিকা বিস্ময়ে অভিভূতা  চতুর্দশী কিশোরীর মুগ্ধতা
মেলে দেখছিলে হলদে সর্ষে ক্ষেতে প্রজাপতি ডানার সঞ্চা্‌র,
বাঁশঝাড়ে্,গাছে পাখির কলতান,বসন ওড়ানো লিলুয়া বাতাসে
এলোচুলা সুখী কৃষাণীর লাউয়ের মাচাঙ---তোমার দু'চোখে
এনে দিয়েছিল সুখী নীড়ের স্বপ্ন।
ক্লিষ্টমুখ নগরীর বৈকাল এখানে অনুপস্থিত।

আর ফেরা হয় নি,চিরদিন এমনিই হয়:
আমরা ভুলে যাই মাটির কথা,অতিক্রান্ত পৃথিবীর কথা
পেছনে পড়ে থাকে,বাতাসে দোল খায়--সুখী কৃষাণীর লাউয়ের মাচাঙ।

০৯.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১০

শুদ্ধ মানুষ

'লেট নাইট মুভি' শেষ হলে চলে ভালোবাসাহীন দেহজ প্রেমের উৎসব---
যান্ত্রিকতায় শেষ হয় জৈবিক উন্মাদনা
সন্দেহের তীব্র বিষে নীলাভ ভালোবাসা লালসার রক্ত-পুঁজে দুষিত
সংবাদপত্রের হুলদে পাতায় ভয়াবহ প্রতারণা বন্যার মতো ধেয়ে আসে সরল গদ্যে।

তবু দ্বি-চারিণীর বিশ্বাসহীনতার সাঁকো ভেঙ্গে দীর্ঘপথ নগ্ন পায়ে হেঁটে
এসে রাত্রি শেষে অকস্মাৎ সমুদ্দুর দেখে আজন্ম প্রেমিক পুরুষের ইচ্ছে জাগে,
'সমুদ্দুরের জলে সমস্ত গ্লানি-শোক বিসর্জন দিয়ে শুদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠার।'

বড় প্রয়োজন আজ শুদ্ধ মানুষের।

০৭.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।

শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১০

উপেক্ষা

'নগ্ন নারীদেহের চে' মহৎ শিল্পকর্ম এ পৃথিবীতে আর নেই'---
এ আমি বিশ্বাস করি না।
কবিতার নিরাভরণ,অবয়বহীন শরীর
আমার কাছে অনেক অনেক বেশী নান্দনিক,আকর্ষণীয়।

আজীবন সঞ্চিত ভালোবাসা পেয়েও চিতায় তোলা শবের
নির্লিপ্ততায় উপেক্ষা কোরেছি---প্রতিহিংসার আগুনে
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এ আমি।
আটলান্টিকের ঢেউতোলা নিখুঁত ভাজের ছন্দময় শরীরের
আহ্বা্ন দু'হাতে ঠেলেছি--- একদা তোমার দু'আঙ্গুলের
ছোঁয়ায় শিহরিত এ প্রণয়াসক্ত পুরুষ।

চোখের সমুদ্র হ'তে নিদ্রা বিসর্জনে কতোদিন ধ্যানে
নিমগ্ন থেকেছি শিবের বরাভিলাষে---ব্যর্থ প্রার্থনার গ্লানি
একাকী রমণের ন্যায় ক্ষত-বিক্ষত করেছে হৃদয়।

পাথুরে শিবের চেয়েও কাঠিণ্যে ভরা ছিল তোমার হৃদয়।

০৪.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।
http://www.thebengalitimes.ca/details.php?val=2365&pub_no=0&menu_id=11

স্বতন্র ধারার চতুর্দশপদী-৬

একটি বিমান দুর্ঘটনা উন্মোচন করে দেয়
গণতন্ত্রে উত্তরণ পথ;ভাঙ্গা স্যুটকেস থেকে
বের হয় সৌভাগ্যের অনন্ত দুয়ার,হায়েনারা
ফাঁদ পাতে--পুঁজিবাদী পণ্যের ঝাঁঝাঁলো  বিজ্ঞাপনে
লালায়িত নিঃস্ব জন অজান্তে গর্দানে তুলে নেয়
চক্রবৃদ্ধি ঋণের জোয়াল,বলদের মেরুদন্ড বেঁকে
যায় চৈতী চৌচির জমিনে,খাদ্য খোঁজে শকুনেরা

সুফিয়ার সৎকার হয় চাঁদার টাকায়,তত্ত্ব
বোঝে,বোঝায় না কেউ,গলায় ফাঁসও নেয় দেনা
এড়াতে,উচ্ছেদ হয় ভিটে থেকে,দেশান্তরী হতে
হয় কখনো কখনো।ব্র্যাক ফেল মারলে গ্রামীণে
যেতে বাধা নেই,গ্রামীণের দেনা শুধবে নিঃশর্ত--
শর্তহীন(নিয়মিত কিস্তি) আশা,আশার পাওনা
মেটাতে প্রশিকা আছে। আরো কতটুকু চাও পেতে?

০৪.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।
http://www.bangladeshnews24x7.com/literatare/poetry/396-2010-12-04-07-52-26.html

শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১০

জয়তু!মহাসুদখোর মহাজন ডঃ মুহম্মদ ইউনুস

পটভূমিঃচট্টগ্রাম বিশ্ব-বিদ্যালয় সংলগ্ন অখ্যাত 'জোবরা' গ্রাম সারা বিশ্বে খ্যাতি পেয়েছে ক্ষুদ্রঋণের জন্মভূমি হিসেবে আর সুফিয়া খাতুন এ গ্রামেরই এক দরিদ্র  অধিবাসী;তিনিও ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন----প্রথম ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা কিংবা ক্ষুদ্রঋণের প্রথম বলির পাঠাঁ হিসেবে।১৯৭৬ সালে গবেষণা কার্যক্রম হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংক।ডঃ ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য হিসেবে সারাবিশ্বে তুলে ধরা হয় জোবরা গ্রামের সুফিয়া খাতুনকে।বিভিন্ন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় যে,গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণে সুফিয়া খাতুন স্বাবলম্বী হয়েছেন,তিনি পাকা বাড়ী করেছেন।কিন্তু প্রকৃত তথ্য যে,সুফিয়া খাতুন স্বাবলম্বী নয় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান ১৯৯৮ সালে।গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তার লাশ দাফনে্র ব্যবস্হা  করে।
দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে জোবরা গ্রামের সিকদার পাড়ার অভাবী নারী সুফিয়া খাতুনের হাতে প্রথমে ২০(কুড়ি) টাকা ঋণ তুলে দেন তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ মুহম্মদ ইউনুস এবং পরবর্তীতে বেশী ঋণের আশ্বাস পেয়ে নির্ধারীত সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দেন সুফিয়া বেগম এবং নূতন করে ঋণ পান ৫০০(পাঁচশত) টাকা।একসঙ্গে এত টাকা পাওয়ার আনন্দে সুফিয়া খাতুন তা সারা গ্রামে জানিয়ে দেন এবং এর অল্পদিনের মধ্যেই পূরো গ্রাম চলে আসে ডঃ ইউনুস মুহম্মদের খপ্পড়ে অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায়।জোবরার ঘরে ঘরে তখন নগদ টাকার উৎসব।কিন্তু এ উৎসব ফিকে হতে বেশীদিন লাগেনি।সুদে-আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সর্বশান্ত হয়েছেন অনেকে,এলাকা ছেড়েছেন রহিমা ও সায়েরা খাতুনসহ কেউ কেউ।
সুফিয়া খাতুনের দুই মেয়ে হালিমা ও নূরনাহারের দিন কাটে এখন অনাহারে-অর্ধাহারে।গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ঋণ গ্রহীতা সুফিয়া খাতুনের বাড়ীতে পাঁচ কাঠা জমির ওপর হালিমা ও নূরনাহারের পৃথক দু'টো ভিটে।তাদের চাষাবাদযোগ্য আর কোনো জমি নেই।সুফিয়া খাতুনের মেয়ে নূরনাহার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমার আম্মা ( সুফিয়া খাতুন ) ক্ষুদ্র ঋণের প্রথম গ্রাহক।তাকে দেখিয়ে ইউনুস সাহেব দেশে-বিদেশে অনেক নাম করেছেন,কিন্তু আমাদের কিছুই হয় নি।বেতের তৈরি মোড়াসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির ব্যবসা করতে আম্মা ওই ঋণ নেন কিন্তু চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি শোধ করতে আম্মাকে অন্যজনের কাছ থেকে আবার ঋণ নিতে হয়েছিল।'

তখন থেকে এ পর্য্যন্ত সুফিয়া খাতুনের পরিবারের কোনো সদস্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আর ঋণ নেন নি।সুফিয়া খাতুনের দারিদ্র্যতাকে পুঁজি করে দশ-বিদেশে ডঃ ইউনুস অনেক সম্মান ও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছেন কিন্তু সুফিয়া বেগমের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আজ অবধি ঘটেনি।
নোবেল পুরস্কার পাবার পর ডঃ ইউনুস এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেঞ্জোবরা গ্রামে এসেছিলেন। সে সময় অনেক চেষ্টা করেও সুফিয়া খাতুনের পরিবারের সদস্যরা কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে পারে নি।সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য যে,ডঃ ইউনুস নোবেল পুরস্কার পাবার পর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সুফিয়া খাতুনের বাড়ীর পার্শ্ববর্তী পাকা দোতলা দালান (যার মালিক সুফিয়া খাতুনের ভাইপো আবুধাবী প্রবাসী জেবল হোসেন) দেখিয়ে প্রচার করে যে,এটি পরলোকগতা সুফিয়া খাতুনের।
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অবস্থার উন্নতি করতে না পারা আরেকজন জোবরা গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ।তিনি গত ১৯৮৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০০০ (দুই হাজার) টাকা ঋণ নিয়ে একটি গরু কিনেছিলেন কিন্তু নিয়মিত কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সেই গরু বিক্রি করে সাত মাসে ২৮০০ (দুই হাজার আট শ') টাকা পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হন তিনি।(সূত্রঃবিডিনিউজ২৪)।
গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যাঃ
কেস হিস্ট্রি-০১:
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে কিস্তির টাকা দিতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালু মিয়া (৫০)। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করেছে। জানা গেছে, বেগমগঞ্জ উপজেলার গণিপুর গ্রামের খোকা মিয়ার বাড়ির কালু মিয়া চৌমুহনী রেলওয়ে গেইট এলাকায় ক্ষুদ্র চা দোকানের ব্যবসা করতেন। দোকানের পুঁজি কম থাকায় সে গ্রামীণ ব্যাংক চৌমুহনী শাখা থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সে টাকার কিছু অংশ পরিশোধ করলেও সাংসারিক টানা-পোড়েনের কারণে কিস্তির বাকি টাকা ঠিকমতো শোধ দিতে পারছিলেন না।
 আজ সকালে কিস্তির টাকার জন্য ব্যাংকের ঋণ আদায়কারী অফিসার তাকে শাসিয়ে যায়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে কালু মিয়া বাড়ির পাশের জামে মসজিদ সংলগ্ন মক্তবের ঘরের আড়ার সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।খবর পেয়ে পুলিশ দুপুর ১টায় সেখানে গিয়ে গলায় দড়ি পেছানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। নিহত কালু মিয়ার স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে রয়েছে।(সূত্রঃ২৫ ফেব্রুয়ার,শীর্ষ নিউজ ডটকম)
কেস হিস্ট্রি-0২:কলারোয়া উপজেলার জলাবদ্ধ এলাকার পাকুড়িয়া গ্রামের রেখা রানী বিশ্বাস (৪০) কিস্তি দিতে না পেরে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঋণী সদস্য মারা গেলে তার কিস্তি কে দেয়। মাঠকর্মী বলেছিলেন, তার ঋণ মাফ করে দেওয়া হয়। পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ভোরে পাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে কাঁঠাল গাছে রেখা রানী বিশ্বাসের ঝুলন্ত লাশ দেখা যায়।(সূত্রঃ২রা নভেম্বর,১০ দৈনিক সমকাল)
কেসহিস্ট্রি-০৩:অভাব-অনটনের সাথে লড়াই করে হেরে গেলেন হরিলাল। ঋণের দায় এড়াতে উপায়ন্তর না পেয়ে অবশেষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এ ব্যক্তি। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনাটি ঘটেছে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার ছিল ব্র্যাকের ৩০০ টাকার কিস্তি ও আগামী রোববার গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৬৫ টাকার সাপ্তাহিক কিস্তির দিন। গতকাল পর্যন্ত ওই টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে হরিলাল দেবনাথ নিজ ঘরের চালের সাথে গলায় রশি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। হরিলালের স্ত্রী অর্চনা দেবনাথ ও বাড়ির লোকজন জানান, পার্শ্ববর্তী মিরশ্বরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের ফুটপাথে হাতে তৈরি পাখা, ঝাড়ু, কুলা ইত্যাদি বিক্রি করে কোনো রকমে স্ত্রী আর পাঁচ কন্যা সন্তানের সংসার চালাতেন হরিলাল। দুই বছর আগে বড় মেয়ে ফুলেশ্বরী দেবনাথকে বিয়ে দিতে গ্রামীণ ব্যাংক, দারোগারহাট শাখা থেকে ২৯ হাজার টাকা ও ব্র্যাক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা দিতে অপর দুই মেয়েকে চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরিতে দেন। সম্প্রতি তারা চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরে এলে সংসারে ভোগান্তি বেড়ে যায়। এনজিও’র কিস্তি শোধে গ্রামের লোকজন থেকে চড়া সুদে আরো ঋণ নেন তিনি। বহুমুখী ঋণের চাপে আর পরিবারের অনটন সইতে না পেরে অবশেষে হরিলাল আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন তরফদার বলেন, শুধু গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নয়, হরিলাল বিভিন্ন জায়গা থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন। ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম জানান, তিনি সকালে ইউপি মেম্বারের মাধ্যমে হরিলালের আত্মহত্যার খবর জেনেছেন।(সুত্রঃদৈনিক নয়াদিগন্ত,২৪.১০.০৮)
ইউনুস ফাঁদে দরিদ্ররা: সম্প্রতি দারিদ্র দূর করতে বিদেশ থেকে অনুদান পাওয়া কোটি কোটি ডলারের মধ্যে ১০ কোটি অর্থাৎ প্রায় ৭০০কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানোর অভিযোগ করেছে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (এনআরকে)।এ্নআরকে এর প্রামাণ্যচিত্র 'ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে'। ক্ষুদ্র ঋণ কার্য্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের গরীব মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নীচ থেকে তুলে আনাই ছিল এ অনুদানের উদ্দেশ্য। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোনাথন মরডাকের দেয়া তথ্যানুযায়ী,ওই সময়ে ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রায় ১৭.৫ কোটি ডলার পেয়েছিল। ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে' শীর্ষক প্রামান্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়,দারিদ্র্য দূর করার জন্যে ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯৯৬ সালে বিপূল পরিমাণ অর্থ দেয় ইউরোপের কয়েকটি দেশ। নরওয়ে, সুইডেন,নেদারল্যান্ড ও জার্মানীর দেয়া অনুদান থেকে ৭০০ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীন কল্যাণ নামে নিজের অন্য এক প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন ডঃ ইউনুস।বাংলাদেশ নরওয়ের দূতাবাস,নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এ অর্থ গ্রামীণ ব্যাংকে ফেরৎ নিতে চেয়েও পারেনি।খানে উল্লেখ্য,নরওয়ের দাতা সংস্হা ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্য্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে ৪০ কোটি ডলার অনুদান দেয়।১০ কোটি ডলারের মধ্যে ৭ কোটিরও বেশী ডলার ডঃ ইউনুসের গ্রামীণ কল্যাণ নামের প্রতিষ্ঠানেই থেকে যায়। পরে বাংলাদেশ নরওয়ের দূতাবাস,নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালণ করে।আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে,গ্রামীণ ব্যাংকের ওই অর্থ গ্রামীণ কল্যাণের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেয় গ্রামীণ ব্যাংক।
প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতা টম হেইনম্যান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ডেনিশ এ্যাসোসিয়শন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম তাঁকে ২০০৭ সালে বিশেষ পুরস্কার দেয়।প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের জন্যে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন।অর্থ স্থানান্তর ও ঋণের বেড়াজালের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ডঃ ইউনুসের মতামত জানতে প্রায়  ছয়মাস ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও পান নি।ডঃ মুহম্মদ ইউনুস টম হেইনম্যানকে কোনো সময় দেন নি বা দেখা করতে রাজী হন নি।
গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ গ্রামীন কল্যাণে স্থানান্তের বিষয়টি জানতে পেরে নরওয়ের উন্নয়ন সংস্থা 'নোরাড' এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ডঃ ইউনুস এর ব্যাখ্যা দেন।অর্থ সরিয়ে নেয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি ১৯৯৮ সালের ০৮ জানুয়ারী একটি চিঠি লেখেন।অই চিঠিতে বলা হয়,'এর মূল উদ্দেশ্য করের পরিমাণ কমানো এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। এ অর্থ রিভলভিং ফান্ড হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় থেকে গেলে ক্রমেই বাড়তে থাকা কর হারের কারণে ভবিষ্যতে আমাদের বিপূল পরিমান কর পরিশোধ করতে হবে।রিভলভিং ফান্ড থেকে কোনো অর্থ ব্যয়ের পর এর বিনিময়ে পাওয়া অথ আবার একই কাজে ব্যবহার করা যায়। এ তহবিলের ক্ষেত্রে অথ বছর বিবেচিত হয় না।
অর্থ স্থানান্তের ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন ডঃ ইউনুস।নোরাডের তখনকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ১৯৯৮ সালের ০১ জানুয়ারী এক চিঠিতে তিনি লেখেন,'আপনার সাহায্য দরকার আমার।।...সরকার এবং সরকারের বাইরের মানুষ বিষয়টি জানতে পারলে আমাদের সত্যিই সমস্যা হবে।'
নরওয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়াঃটম হেইনম্যানের 'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' প্রামান্যচিত্রটিতে ঋণের জন্যে দেয়া অনুদানের অর্থ অন্যখাতে স্থানান্তরের বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নরওয়ের লেবার ও প্রগ্রেস পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।লেবার দলের সদস্য ক্রিস্টিন হানসেন বলেন,'বিষয়টি আমাদের কাছে নূতন।সব তথ্য-উপাত্ত অবশ্যই উপস্থাপন করতে হবে।এ ধরণের বিষয় গোপন রাখা মেনে নেয়া যায় না।'প্রগেস পার্টির সদস্য মরটেন হগল্যান্ড বলেন,'এ ঘটনার বিষয়ে সংসদে কোনো তথ্য জানানো হয় নি।এটি বিরক্তিকর।পূরো ঘটনা খতিয়ে দেখতে হবে।তদন্তের জন্যে যাচাই-বাছাই ও সংসদীয় কমিটির পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।'
নরওয়ে সরকারের সহায়তা বিষয়ক মন্ত্রী এরিক সোলহেম এ ঘটনায় যে কোনো তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন,'সাহায্যের জন্যে দেয়া তহবিল চুক্তির শর্তের বাইরে অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। মন্ত্রী ১৯৯৮ সালে ঘটনাটি উদঘাটনের পরও তথ্য গোপণ রাখার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন,উন্নয়ন তহবিল কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে বিষয়ে পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকতে হবে।'
ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের গল্পঃ
'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতারা গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোতে গেছেন বেশ কয়েকবার। জোবরা গ্রামে তাদের মধ্যে দেখা হয় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে প্রথম ঋণ নেওয়া সুফিয়ার মেয়ের সঙ্গে। যশোরের 'হিলারি পল্লী'তে তাদের দেখা হয় গরিব মানুষদের সঙ্গে, ক্ষুদ্র ঋণের কারণে তাদের ঋণের বোঝা শুধুই বেড়েছে বলে দেখতে পান নির্মাতারা। ওই পল্লীতে গিয়ে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি তার সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এ সময় ঋণগ্রহীতাদের প্রায় সবার মুখে একই কথা শুনেছেন প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতারা। তারা জানান, প্রত্যেকেই একাধিক ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। সে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সবারই প্রাণান্ত অবস্থা। কেউ বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন ঋণ শোধের জন্য। আবার ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তি শোধ করতে না পারায় কারও ঘরের টিন খুলে নিয়ে গেছে ঋণদাতা ।
১০ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য এমন ৪০ জন নারীর ওপর ডেভিড গিবসন ও হেলেন টডের এক জরীপে দেখা গেছে অই নারীদের প্রত্যেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পূণরায় ঋণ নিয়েছেন।গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে তারা দ্বারস্থ হয়েছে ব্র্যাকের কাছে,ব্র্যাকের ঋণ পরিশোধের জন্যে আশা'র কাছে ঋণ নিয়েছেন,আশা'র ঋণ শোধ করার জন্যে প্রশিকা'র সদস্য হয়ে ঋণ নিয়েছেন,আবার গ্রামীণ ব্যাংক.....অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যংক>ব্র্যাক>আশা>প্রশিকা>গ্রামীণ ব্যংক....আমৃত্যু এক চক্রে আবদ্ধ।
সুদের উচ্চহারঃ২৫০০ জন দরিদ্র মানুষের ওপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদদের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়--- এদের এক তৃতীয়াংশ লোক গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ২৬% থেকে ৩১%।কোনো কোনো ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের  সুদের হার এর চেয়েও অনেক বেশী।গবেষণায় দেখা যায়,সারা বিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদের হার কোথাও কোথাও ১০০% এমনকি ২০০% ভাগও রয়েছে।
টম হেইনম্যানের 'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকের সাক্ষাৎকারও রয়েছে।এঁরা দী্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্র ঋণের বৃহৎ সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন।ডেভিড রডম্যান,জোনাথন মারডক,টমাস ডিক্টার এবং মিলফোর্ড বেটম্যানের মতো সমজবিজ্ঞানীদের সবার একটাই কথা,চালু হবার পর ৩৫ বছরেও এখনো এমন কোন প্রমাণ নেই,যাতে মনে হতে পারে ক্ষুদ্র ঋণ গরীব মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ডঃ ইউনুসের কর প্রদানে অনীহাঃদীর্ঘ কয়েকযুগে গ্রামীণ ব্যাংক একটি শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলেও ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের জারী করা এক অধ্যাদেশ বলে জন্ম নেয়া গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দারিদ্র্যমুক্তির প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে করের আওতামুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন ডঃ ইউনুস। এরশাদের শাষনামাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কোন সরকারই এ প্রতিষ্ঠানের করমুক্তির আবেদন অগ্রাহ্য করেন নি।কালের কন্ঠে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়,৩১ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের করমুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ডঃ ইউনুস সরকারের কাছে পরের দুই বছরের জন্যে করমুক্তি চেয়ে আবেদন করে রেখেছেন।তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর পক্ষে এখন পর্য্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হয় নি।
২০০৬ সালে ডঃ ইউনুস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর নোবেল পুরস্কারের অর্থের ওপর যাতে করারোপ না করা হয় সেজন্যে নানামুখী তৎপরতা চালান।২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ডঃ এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলামকে নোবেল কমিটির পক্ষ হতে এক চিঠিতে ডঃ ইউনুস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যংকের পাওয়া নোবেল পুরস্কারের অথ করমুক্ত রাখার জন্যে অনুধ জানানো হয় যদিও চিঠিতে বলা হয়ছিল, যুক্ত্ররাষ্ট্রেও নোবেল পুরস্কারের অর্থ করমুক্ত নয়।নোবেল কমিটির পর ডঃ ইউনুসও নোবেল পুরস্কারের অর্থ করারোপ না করার জন্যে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ডঃ এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের কাছে আবেদন করেন এবং নোবেল পুরস্কারের অর্থ করমুক্ত করতে সক্ষম হন।
নিয়মনীতি মানেন না ডঃ ইউনুসঃগ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়মনীতি মানেন না ডঃ ইউনুস। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমাল অনুযায়ী এমডি পদের চাকুরীর সর্বোচ্চ বয়স ৬৫ হলেও তিনি সমস্ত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ৭৫ বছর বয়স পার করেও গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ আকঁড়ে ধরো আছেন এবং এমডি পদটি সার্বক্ষনিক হলেও তিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশের বাইরে কাটান ফলে গ্রামীন ব্যাংকের আভ্যন্তরীন কোন সিদ্ধান্তও ঝুলে থাকে দীর্ঘদিন।গত বছর এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালিখি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেও তিনি তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন নি।বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর তাঁকে ডেকেও পান না---এমন অভিযোগও তাঁর বি্রুদ্ধে রয়েছে।
উপসংহারঃঅর্থনীতি কিংবা দারিদ্র্যের ইতিহাসে ডঃ মুহম্মদ ইউনুস চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর অভিনব আবিষ্কারের জন্যে।পশ্চিমা বাঘা বাঘা ডক্টরেট ডিগ্রধারীরা যা পারেন নি আমাদের ডঃ মুহম্মদ ইউনুস তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে,শুধু টাকাওয়ালা ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত্ব শ্রেণীই নয় হত-দরিদ্রেরও কিভাবে শোষণ করা যায় তাদের ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে ফেলে, তাদের ভোগ-লালসা সৃষ্টি করে কিভাবে ২৬% থেকে ৩১% শোষণ করা যায়। তাঁর শোষণের অভিনব ফর্মুলা প্রায় ৩৫ বছর ধরে চলমান। আর কতকাল টিকে থাকবে তা ভবিতব্যই বলতে পারে?
সর্বশেষঃমুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ নরওয়ে সরকার যাচাই করছে বলে বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে।( এ লেখার সময়কালঃ০৩.১২.১০ সন্ধ্যা ০৬.০০ মিঃ)।
http://www.bangladeshnews24x7.com/editorial-page/comments/331-2010-12-03-13-24-16.html

বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১০

নিয়তিবাদী

চৈতী খররোদে পোড়া মাঠে উদাস তাকিয়ে থাকা কৃষকের অক্ষম আক্রোশ আর
সর্বগ্রাসী ক্ষুধা অগ্নশিখার মতোন জ্বলে ওঠা বুকে--কৃষক আজন্ম স্নেহে তবু ছুটে
যায় খরতাপে ফাটা বন্ধ্যা কিংবা বানভাসী জমিতে-- কেননা শুধু কৃষকই জানে
কিভাবে কঠিন মাটিতে বীজ বুনতে হয়,আগাছা নিড়ানী দিতে হয়, কখন সার বা
পানি দিতে হয়।মাটি বড় জেদী,অভিমানী সুন্দরী বধূর মতোন।সময় মতোন সার
বা পানি না পেলে অভিমানে গুমড়ে কাঁদে। কাল পরিক্রমায় আবার আসে খরা,বন্যা,
গোর্কি,সিডর।পরিশ্রমী কৃষক হয়ে যায় অদৃষ্ট,নিয়তিবাদী।

লোনা সমুদ্রের বুকে মোষের দুধের সরের মতোন টলটলে চর জাগে--
কিশোরী য্যামোন দিনে দিনে লাউডগার মতোন বেড়ে ওঠে।চরের পরিধিও
তেমনই বাড়তে থাকে। পলিমাটিতে চর কঠিন হয়--নূতন জাগা চর অবহেলে
পড়ে থাকে--দিনের পর দিন(ততদিনে ভূমিখেকো দস্যু দখল পাকাপোক্ত করতে
প্রতীক সম্বলিত পতাকা পুঁতে রেখে গিয়েছে)।পরিযায়ী পাখিদের কল্যাণে ক্রমে
দু'এক গাছি ঘাস থেকে গোটা চর ঘাসে ছেয়ে যায়--সবুজ ঘাসের বন।

নূতন জাগা চরে দখলবাজ জোতদার অনুগত প্রকৃতির মতোনই উদ্যাম,দুঃসাহসী,
নিঃস্ব, গরীব চাষীরাই গাছপালা,ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রহীন চরে ভাগ্যবিধাতা কেন্দ্রিক
সমাজ ও জনপদের শেকড় ছড়িয়ে দ্যায়।

০২.১২.১০
পল্লবী,ঢাকা।