Powered By Blogger

বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৪

অন্ধ যুবতী

অন্ধ যুবতীর ঘরে আবৃত যোনীর রাত কাঁপে আজন্ম পাপের কূটিল অভ্যাসে খুলে যায় দু'হাতের মুঠো কুটিরে গ্রীষ্মের দাবদাহ পুড়ছে বিছানা 'বৃষ্টি দে,বৃষ্টি দে,' কেঁদে ওঠে জন্মান্ধ রমণী বৃষ্টি নেই উপুড় আকাশে কলঙ্কের আদরিনী নেঘ রজনীফুলের মুখ ভরে আসে পিপাসার্ত ভিতে বুকে তপস্যার মতো ঘন হয়ে ওঠে মেঘ স্বপ্ন ও নিস্তারহীন সর্বগ্রাসী রোদ,রক্তে- ইন্দ্রিয়কামনা গণিকার অসাড় শরীরজুড়ে স্বেদবিন্দুজল হেলে পড়া তালগাছে দুলছে বাবুইপাখির বাসা অন্ধ যুবতী নিঃসঙ্গ বিছানায়....

পান্ডুলিপি আলোচনাঃনা মানুষ/কুহক মাহমুদ ।

লিকলিকে শীর্ণদেহ,উস্কোখুসো চুঁড়াবাঁধা চুল,অযত্নে বেড়ে উঠছে দাঁড়ি-গোঁফ।কী শীত,কী গ্রীষ্ম গায়ে চাদর, কাঁধ থেকে ঝুলছে ল্যাপটপ,ক্যামেরার ব্যাগ । প্রথম নজরেই বলে দেয়া যায় লোকটা উন্নাসিক,ভাবুক - শিল্পসৃষতির প্রয়াসে উন্মুখ ।কাঁটাবন, কনকর্ড এ্যাম্পোরিয়ামের পরিচিত ও প্রিয়মুখ কবি কুহক মাহমুদের কথা বলছিলাম ।চা-সিগারেটের সাথে আড্ডা চলছিল অনুপ্রাণন প্রকাশনীর অফিসে । টেবিলের কাগজ-পত্র নাড়াচাড়া করতে করতে হাতে উঠে এল ষ্ট্যাপলড করা একতাড়া কাগজ।উল্টে-পাল্টে দেখি একটি পান্ডুলিপি,কুহক মাহমুদের 'না মানুষ'। পড়তে গিয়ে একটি কবিতায় চোখ আটকে গেলঃ সুরহীন সুরায় জাহ্নবী দিনের মতো বুঁদ হয়ে আছি দৃশ্যপটটি এখানেই শেষ হতে পারতো হয় নিঃ অবশিষ্ট সংলাপগুলো অবাধ্য বাদুড়ে ডানায় উড়ছে সে-এক কানা বাদুড় আবিষ্কার করতে চাইছে পালঙ্কের ইতিহাস গঞ্জ কী করে হলো,নগর ঔপনিবেশিক বা আবাস (মায়া) কবিতাটি পড়ে মনে হলো ভাববাদী দর্শনের প্রভাব আবছা হলেও আছে এবং ফল্গুধারার মতো তাঁর কবিতার অন্তঃসার - বৈরাগ্যের এক প্রতিভা । তাঁর কবিতার প্রকাশভঙ্গি আবেগময় এবং দূরন্ত বেগের কিন্তু এতে উচ্ছ্বলতা নেই আছে পরিমিতির নিপূণ মাত্রা । তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সার্বক্ষনিক প্রস্তুতির অবস্থায় রাখেন । এ পান্ডুলিপির অর্ধেকেরও বেশী কবিতা প্রতীকধর্মী । প্রতীকবাদ তর্কের যদিও মীমাংসা হয় নি তবুও উপযুক্ত প্রতিভার হাতে প্রতীক স্বার্থক ও জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে । এক্ষেত্রে কুহক মাহমুদের প্রতীকগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলো প্রগাঢ়ভাবে ব্যক্তিগত আর নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ একটি ভাব বা ভাবনা বা আবেগের জন্যে কবি প্রতীক ব্যবহার করেছেন - সে জন্যে কখনও কখনও কিছুটা দূর্বেধ্য মনে হয়েছেঃ .......... .......... .......... হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত,ঘুম ভেঙে আসে চোখের পাতা মা-মাটি নদীর পৈঠায়,দুঃস্বপ্নের চিৎকার ভাসে ভোরের সূর্য পৈঠায়,দুঃস্বপ্নের চিৎকার ভাসে ভোরের সূর্য্য ঢেকে দেয় বাদুড়ের ঝাঁক ধ্বংসস্তুপে শুনি বিড়াল কান্নার দীর্ঘ বিলাপ কাকনের পকেটে প্রশ্ন জাগে কোথাও নেই তুই! (রাজপথ) কুহক মাহমুদ আত্ম-জৈবনিক,রোমান্টিক একজন কবি।আজন্ম শিল্প-তৃষিত কবি শিল্প-চেতনাকেই নান্দনিকতার মূল উৎস বলে মনে করেন।মানবজীবনের মহত্ত্বম উপলব্ধি হছে প্রেম আর তাই তাঁর কবিতায় প্রেমের স্থান অবশ্যম্ভাবী।স্বতন্ত্র, নান্দনিক শৈলী,চেতনা ও নন্দনতাত্ত্বিক দার্শনিকবোধের কারণেই তাঁর কবিতা সৌন্দর্য্য চেতনাকে স্পর্শ করে কাব্যিক চেতনায়,সত্ত্বার গভীরতর আবেগের কল্পনায় সীমার মধ্যে অসীমের স্পর্শ সঞ্চরনশীল;যা প্রেম চেতনার সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের নিবিড় সংযোগে প্রেমকে চিত্রিত করেছেন সর্ব প্রসারীরুপে প্রতীকের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অতি-প্রাকৃত আরেক প্রতীকঃ তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি,কিন্তু ঐ তির্যক চাহনী নির্জন নীরবতায় মৌন পাথর! অপুষ্ট আনি- সেখানে শুধুই শিল্প পেয়েছি নির্নিমেষ তাকিয়ে মাংসের ভেতর ঢুকে স্পষ্ট প্রত্যেকটা হাড়ের সংখ্যা গুনে ভালোবেসেছি মমতার জানালা খুলে ঘরে খিল এঁটেছি আমি এক না মানুষ,নিমন্ত্রণ রাখলাম একদিন এসোঃ পাল তোলা সাম্পানের পাতাতন হবো- (পাঁজরের খোঁড়লে ভালোবাসা) নিরন্তর প্রস্তুতির মাঝে নিজেকে ধরে রেখেছেন কবি কুহক মাহমুদ । সমকালকে তিনি মেপে চলেছেন মহাকালের বাটখারায় তাই তাঁর কবিতায় দেখি সৃষ্টিশীলতার বহুবর্ণা ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে বেড়িয়ে আসে কবিতার লাইন ফুঁড়ে।আত্ম-চেতনা ও সৃষ্টির বিপুল আনন্দে আত্মহারা এ কবি পূর্বসুরীদের গতানুগতিক ভাবধারা সযত্নে এড়িয়ে চলার লক্ষ্যনীয় প্রয়াসে লিপ্ত । প্রথাগত আনন্দের ঝলকানি,বেদনার বিষাদাত্মক যন্ত্রণা কিংবা বাস্তবতার নিরেট পাথরও তাঁর কাছে গুরুত্ব বহন করে না । সৃজনশীলতার চরম উৎকর্ষে থেকে তিনি বিনির্মাণ করেন কবিতা;পৃথক ও স্বাতন্ত্র্যবোধের অভিনব ভাব,ভাষা ও বক্তব্যে উপস্থাপিত দ্বন্দ্বে ভরা এক বৈপরীত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠক হৃদয়ঃ রাতের ঘুম ভাঙিয়ে দিলো জোছনার স্রোত ফিরে চাইতে,তোমার নামে দেয়া অর্ঘ্য । হয়ে ওঠে না কিন্তু মনে পড়ে যায় ছড়ানো ফুল কুড়িয়ে যে যুবকটি পুরুষ হয়ে ওঠে সে বোঝেনি,ঠিক কোন সুরে বেঁধেছিলে মন্ময়?হারানো বিচ্ছেদ । একজন বৃদ্ধ তবু জপে যায় হরে কৃষ্ণ নাম!ঈশ্বরের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকে এক না-মানুষ বিমু রসায়নে উজ্জীবিত বিপর্যস্ত হাইড্রা ফানুস (অভিকর্ষ) উত্তরাধুনিক মানুষ ছুটে চলেছে এক মহাশূন্যাত্র দিকে,অসীমতার দিকে ধাবমান,বিছিন্নতাবোধে আক্রান্ত একদল মানুষ । উত্তরাধুনিক মানুষ তার সীমাবদ্ধতা জানে কিন্তু মানতে চায় না অথচ সীমা লঙ্ঘন তার পক্ষে দুঃসাধ্য । ফলে জন্ম নেয় মনোজাগতিক এক দোদ্যুলময়তা । এর শুরু গত শতাব্দীর দু দু'টো অর্থহীন মহাযুদ্ধ মহাযুদ্ধ মানুষের চিরন্তন মৌল বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে চিন্তা চেতনার জগতে আনে ব্যাপক পরিবর্তন । মানুষ ক্রমেই ঈশ্বরবিমুখ হতে শুরু করে সামাজিক রীতি-নীতি প্রহসনে পরিণত হয়,ভেঙে যেতে থাকে যুথবদ্ধ পরিবার । মানুষ ক্রমেই নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে তদুপরি পুঁজিবাদী সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে মানুষের ব্যক্ত-সচেতনাতা,ব্যক্তি-স্বাধীনতার সমস্যা ও সংকটের যন্ত্রণায় মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবোধে জর্জরিত হতে থাকেঃ ......... ......... ......... বৈশ্বিক বেশ্যা হয়ে তবু আমি সুখী- কচ্ছপের বর্ম বুকে বেঁধে বেঁচে আছি! এক না মানুষ- প্রতিটা রাত শেষের জন্মে পাই সাপের শরীর,সুদেষ্ণার ভাসান তোমরা মানুষ হয়ে থাকো গো রাই,সংসারী রথের উঠোন! (হতে পারতো কিন্তু হয়নি) প্রবল আশাবাদই কবি কুহক মাহমুদের কবিতার উপজীব্য ।প্রেম চেতনার কবিতায় থাকে না কোনো কেন্দ্রীয় উপমা,প্রথাগত চিত্রকল্প । নিপূণ।নিঁখুত শব্দের বুননে নান্দনিক অনুভূতিতে বিনির্মাণ করেন কবিতা;যাতে বাস্তবতাবিবর্জিত,পলায়নী মনোবৃত্তি নয় বাস্তব আশাবাদের অভিলাষ ব্যক্ত থাকেঃ আমৃত্যু শিল্পকলার অহংকার আমি এক মিথ কিংবা না-মানুষ খুব সোজা চলতে চেয়েছি,একবুক অসুখের বারুদ নিয়েঃ মণিবন্ধে রেখেছি কিছু ভুল । ভুলগুলো বিষ বিষগুলো দেহ আক্রান্ত করবার আগেই কালো কায়তনে কষে বেঁধেছি কোমর, সে এক বৈশাখী তুফান; ঝড়ের তাণ্ডবে করতলে কখনোই চাইনি সমাজ বদলানো যাদুর চেরাগ বেয়াল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছি । আর ভুল করবো না (ভাসমান পরিচয়) গোধূলির প্রস্থানে জ্বালাও পূর্ণিমার পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'না মানুষ' প্রকাশের ঊষালগ্নে কবিকে অভিনন্দন ।

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৪

নব্বই দশকের কবিতায় উত্তরাধুনিক চেতনা

।।আয়শা ঝর্ণা ।। মনঋদ্ধ আবেগ ও ভাবনা কবি আয়শা ঝর্ণা এর কবিতায় স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে । তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত নিরবিচ্ছিন্ন ও স্পষ্ট,সুস্থিত বিনির্মাণের ধারা লক্ষ্যণীয়ভাবে অনুভব করা যায় । তাঁর কবিতায় সম-সাময়িক এবং উত্তরাধুনিক সচেতন অনুশীলণের কারণে জীবন দর্শন,প্রতীক,ইতিহাস চেতনা ও ঐতিহ্যবাদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে ।কাল চেতনার প্রয়োগ, সমষ্টিজীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারা এবং শুধু নিজের অস্তিত্বকে অতীতের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন আবার কখনো কখনো সুদূর ভবিষ্যৎকে নিয়ে গিয়েছেন - প্রকৃতপক্ষে প্রচ্ছন্নের সাথে,নিকটকে দূরের সাথে,বর্তমানকে অতীতের সাথে লীন করে দিতে চেয়েছেন আর সৃষ্টি করেছেন পলিমাটি ভরা এক উজ্জ্বল সংযোগ ভূমি। উত্তরাদুনিকতা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আত্মানুসন্ধানের মুখোমুখি।প্রকৃতির পরিপুকতার ধারণা থেকে আত্ম-সম্পূর্ণতার দিকে,স্বয়ম্ভুতার দিকে । আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার নধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভেদ হল একরৈখিকতা ও বহুরৈখিকতা । উত্তরাধুনিকতার মধ্যে মূলে রয়েছে কেন্দ্রকে আঘাত করে বলয় ভেঙে বহুরৈখিকতাকে তেনে আনার সক্রিয়তা । একরৈখিকতার টান যদিও পিছু ছাড়ছে না । কোনো এক কবিতায় কবি একরৈখিক হলেও সমগ্রে দেখা যায় তার বহুরৈখিকতা । এভাবেই একেকজন একেকভাবে তার নিজস্ব আঙ্গিকে জড় হচ্ছেন উত্তরাধুনিকতার বিস্তীর্ণাঞ্চলে : ময়দানের হাওয়া থেকে জেনেছি তারা আসলে নারীভূক,হিংসাতুর তাদের মুখের দিকে মুখ করে বলেছি,'আমার চোখের দিকে চোখ রেখে কতটা অসুখী আমি?' তোমাদের আনন্দ হয় খুব,উল্লসিত হয়ে ওঠো যখন মৃত্যুকালীন সময়ে জীবনের দিকে হাত বাড়াই।তোমরা লেখো কত নারকীয় পূরণো এথিক্স। মুষঢ়ে পড়ি আমিও।সেবার ধর্নশালায় ঠাকুরকে জেগে উঠতে দেখলাম, অসম্ভব রাগী আর ক্ষয়াটে মুখ।মেট্রোতে চড়ে দেখেছি তোমাদের বাড়ি ফেরার ক্লান্তি (ময়দানের হাওয়া) উত্তরাধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতা । আধুনিক কৃষ্ণবিবরে পাঠক ছিল পুরোপুরি লেখকের আজ্ঞাধীন।উত্তরাধুনিক সাহিত্যের ভেতর পাঠক পুরোপুরি স্বাধীন।পাঠকের ভূমিকা এখানে ঊন বা বহিরাগত নয় অন্তর্গতঃ একটি রক্তাক্ত দুপুর,রোদগুলো রক্তের মত গড়িয়ে গড়িয়ে দোরগোড়ায়।একটি আধুনিক অতি আধুনিক যন্ত্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কাঁচের দেয়ালের ওপাশে দু'টো দীর্ঘকায় মানুষ অতি আদিম যৌনতায় রত।হয়তোবা,হয়তোবা না। ( রক্তাক্ত দুপুর) গতানুগতিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে, কবিতার অভিনব মাত্রা সংযোগ করতে তিনি বরাবরই বদ্ধ পরিকর।আবেগঘন,বস্তুনিষ্ঠ নৈর্ব্যক্তিকতা - বাস্তবতা মূর্ত করে তোলেন স্বতঃস্ফুর্ততায় ।আনন্দের জন্যেই কবিতা তবুও তিনি কখনো গ্রহণ করেন না উদ্দেশ্য ও নীতিহীন আনন্দ । গভীর বিশ্বাসবোধ থেকে জারিত - উত্তরাধুনিকতা;তাঁর কবিতার মূল বক্তব্যঃ দুঃখ আর অমানিশা থেকে সেরে ওঠা গেল না আজও। তোমাদের আত্মীয়তা নিয়ে সন্দেহ নয়।এক জীবনে কতো আর পিঁপড়ের সারিতে সার বাঁধা যায় কিংবা কোনো বাতাস তাড়িত শব্দ জলযোগ বিচ্ছিন্নতা ধারণ করা যায় (অলুক্ষণে পেঁচা) দৈনন্দিন ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ কে দেখেন বাস্তবতা বিবর্জিত,রোমান্টিক দৃষ্টিতে নয়,সমাজ সচেতন ও উত্তরাধুনিকবোধাক্রান্ত হয়ে।সামাজিক অনাচারের বিপক্ষে কবি বিষয় ও প্রসঙ্গের সহজ,স্বতঃস্ফুর্ত,স্বাভাবিকতার পাশাপাশি কবিতার ভাষা নির্মাণ ও প্রকৌশলে চিকিৎসক কিংবা বিচারকের দাপ্তরিক ভাষা নয়,নিছক আটপৌঢ়ে ও ব্যকরণ শৃঙ্খলমুক্ত সরল ও সহজবোধ্য ভাষায়,বিভিন্ন আলংকারিক প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতাকে স্বতন্ত্র উচ্চতায় নিয়ে যাবার প্রচলিত প্রচেষ্টারতঃ একুশ বছর একুশ বছর আর যে তিন বছর যুক্ত হয় নি অপরিচিত নিয়ে বসে থাকে ডানে ঘুরি বায়ে হেলে কয়েক পা পেছনে,চুল ছেড়ার ইচ্ছেটা।বমি ভাবতা গলা ঠেলে ধীরে ধীরে উঠে আসে,না ঠেঁকিয়ে রাখি।বেড়ালের পা আর তার শব্দহীনতার কালে আসে ইন্দ্রিয়সমূহ এ্যালার্ট এ্যাতেনশন,মার্চ অন!পার্শ্ববর্তী কুঠুরী নির্গত করে কিছু শব্দ কল্ কল্ শর্ শর্ ফিস,ফিস্-হবে একটা,মেতে ওঠে ষড়যন্ত্রে, ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র অস্তিত্বকে ঘিরে ফ্যাকাসে।সচকিত,অনুভূতিপ্রবণ অনুভূতি বড়ই বিচিত্র (অস্তিত্ববাদ ও আমি) ।।শাহনাজ মুন্নী।। এক একজন কবি থাকেন যাদের কবিতায় প্রকাশ্য বিবৃতি এবং বিষয়কে অতিক্রম করে ছন্দ,ভাষা ও শৈলীর প্রয়োগে জীবনঘনিষ্ট চিত্রাবলী পরিস্ফুট হয়ে ওঠে - আমার দৃষ্টিতে শাহনাজ মুন্নী তেমনই একজন । তাঁকে মহিলা কবির দলে ফেলা যাবে না । গতি ও প্রগতির স্রোতধারায় ভবিষ্যৎমুখীন এ কবি তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আরও বিষাক্ত শর খুঁজে নেন । পূরাতন কবিতার ঐতিহ্য ভেঙে বের হয়ে নূতন এক কাব্য-কলার পরিমার্জনায় যে উচ্ছ্বসিত ভাবাবেগ দেখা যায় তা তাঁর কবিতায় সংহত,ব্যক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা এবং তীক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতি - গভীরতর ব্যঞ্জনা পেয়েছে। রবীন্দ্রযুগের রোমান্টিক ধারার বিরোধিতা করেও তাঁর দৈশিক ও বৈশ্বিক ভাবনা,চিন্তন,মেধা ও মননশীলতা অনুসরণ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু তরুণ কবি নূতন ধারার এক কবিতা চর্চ্চা শুরু করেন;যা আধুনিক কবিতা । এ আধুনি কবিতার ফর্ম বা টেক্সট অর্ধ-শতাব্দীকালেরও কিছু বেশী সময় । তারপর বাংলা তথা বিশ্ব কবিতার ইতিহাস এক দীর্ঘ বাঁক নেয় - এর নাম উত্তরাধুনিকতা । এ উত্তরাধুনিক শব্দটি সম্পর্কে অনেকের দ্বিমত,বিভিন্ন তাত্ত্বিকের নানাবিধ বিশ্লেষণ,এর সার্বজনীন ব্যাখ্যা বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে নানা তর্ক-বিতর্ক প্রতিনিয়ত চলে আসছে এবং তিন দশককালেরও বেশী সময় ধরে এ তর্কের আজও মীমাংসা হয় নি অর্থাৎ কবিতার অবস্থান - আধুনিক না-কি উত্তরাধুনিক?যুগ-মানসের দোদ্যুলময়তায় সন্দিহান কবি শাহ্ নাজ মুন্নী বলেনঃ তীর্থযাত্রীদল খোঁজে পবিত্রভূমি;দ্রুত হয় যুগপৎ শ্বাসক্রিয়া শক্তিগতি;উত্তররুখী ঘরে শীত গায় শীতকাল;চিরকাল ঘিরে ঘিরে বারোটি কুমারী বোন;মাধ্যাকর্ষণ টেনে রাখে উড়ন্ত মানুষ। আমি সেই সতর্ক সিংহ শিকারীকে জানি;অকৃত্রিম আঁধার তার চিবুকে ফিনকি দ্যা রক্ত।কুয়াশায় সিংহের কেশর ভাসে,রোয়া ঝরে এবং চামড়া ছাড়াবার পর মৃত সিংহ হয় আরেকটি নীল কাক ( বিস্তারিত ভাঙচুর ) উত্তরাধুনিক মানুষের হতাশা,জীবন জটিলতা,অস্তিত্বের সংকট,সমাজের সঙ্গে অনন্বয় এবং স্বীয় সত্ত্বার বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বিষাদ ভারাক্রান্ত করে বিচ্ছিন্নতার বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যাপকভাবে;অন্তর্নিহিত বোইপরীত্য ও এটিএম যাতনা থেকে উদ্ভূত জীবনের অর্থহীনতা ,সভ্যতার কপটাচার,তাঁর বিচ্ছিন্নতার জ্বালা মেটতে পারে নিঃ ঘন অরণ্যকে চিনিয়ে দিয়েছি উদাস হওয়ার পথ এবার শুধু সময়-সুযোগ মতো তল্পি-তল্পা বেঁধে বেরিয়ে পড়া এই নিশ্চিতি ছেড়ে একেকবার খুব ঝুঁকি নিতে ইচ্ছা করে তার ইচ্ছা করে মাটির সংসার ভুলে শেকড়-বাকড় উপড়ে কিছুকাল ঘুরে আসে দূরে ডাইনিরা হেসে বলে,ঘন অরণ্য হেঁটে এলে দুর্ভাগ্য পিছু ধরে ( দীর্ঘ শুষ্কতায় ) আমরা বাস করছি উত্তরাধুনিক বিশ্বে । সময়ের সাথে সাথে পালটে গেছে চিরাচরিত লোকায়ত প্রথা,বিশ্বাস ও বিশ্বও ।আমাদের চিন্তা,চেতন ও মননকে নাড়া দিয়ে যায় মিশেল ফুকো,জ্যাক দেরিদা,রোলা বার্ত,লেভি স্ট্রস প্রমুখ চিন্তাবিদদের ভাবনা ও তত্ত্ব।উত্তরাধুনিকতার মূলমন্ত্র হল সৃজন নয়,বিনির্মাণ । উত্তরাধুনিক পূর্বকালে পাঠক ছিল লেখকের আজ্ঞাধীন কিন্তু এখন লেখক নয়,পাঠ ও বিষয় পাঠকের হাতে ।আর এই মনোজগতের নূতন ভাষা ,'পাঠকৃতি';যা গড়ে উঠেছে বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ দ্য সোস্যুরের ভাষাতত্ত্বকে ধারণ করে । একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কেবল অর্থনীতি বা যৌণের দ্বারা শাষিত নয় বরঞ্চ নিয়ন্ত্রিত ভাষার দ্বারাঃ সৃষতিতে ঈশ্বরও নিখুঁত নন মাঝে মাঝে এরকম আশ্বাসে ভয় কাটে নিজের কাজ দেখে চাপড়াই পিঠ বাহ্ বাহ্ বেশ। এই করে এক পথে হাঁটায় ক্ষুধা আর পথে পেম পথে পথে ঋণী করে সুজন মানুষ ঋণেতে সুফল কম ছোটো থেকে জানি (নিখুঁত সংক্রান্ত) নীৎসে ঘোষণা করেছিলেন ঈশ্বর মৃত্যুবরণ করেছেন অর্থাৎ রঙ্গমঞ্চে নায়কের আর প্রয়োজন নেই।দর্শকদের মধ্য থেকেই উঠে দাড়াঁতে হবে নায়ককে অর্থাৎ ঈশ্বরের স্থান পূর্ণ করবে মানুষ,অতি মানুষ।য়্যুরোপে রেনেসাঁর কাল হল মানব জাগরণের, মানবমুক্তির। মানুষ যে শুধু ঈশ্বরকে অস্বীকার করা শুরু করল শুধু তাই নয় তাকে অপ্রয়োজনীয়,বাতিল বস্ততে পরিণত করে মানুষ নিজেকেই ঈশ্বরের স্তরে উপনীত করে ফেলল: কম্পিউটারের যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটি ভালোবেসে প্রতিবার ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছে যে হতভাগী- পানির নিচে ময়নার মতো উত্তেজনা থিতিয়ে এলে তার মনে পড়েছে আমি তো গাছের মেয়ে,গাছ মানবী গাছের ভাগ্য মেনে এই মাঠে একা দাঁড়িয়েছি মরা কার্তিকে ঝরেছে যেসব নীলপাতা সেসবের জন্যে শোক করে লাভ নেই (গাছ মানবী)

প্রতীক্ষার খোলা পথ

অরণ্যশহর ঘিরে মেঠো সমতল পথে এলোমেলোভাবে নির্মাণের যন্ত্রগুলো পড়ে আছে - অশোকের উঁচু দাল থেকে খসে পড়ছে পালক - ভাঙা খোসার পেছনে শরতের নিমন্তণ - যেতে চেয়েছিলাম পাহাড়ে - রাত দ্বি-প্রহরের প্লাবন ঠেলে ঠেলে এই বানভাসি ভোর - মৃত গবাদিপশুর ফেঁপে ওঠা পেট - পুতিগন্ধময় জল - স্বপ্নের ভেতর এক এলোকেশী বাস্তবতা - আমাদের প্রসন্ন উঠোন ঘিরে রাখে খর জলের নিঃশ্বাসে - অন্ধকারের মিছিলে মতিচ্ছন্ন মুখগুলো ফুটে আছে -শ্লোগানের শব্দ মিশে গেলে সমবেত পাঠে জন্ম নেয় অত্যাশ্চার্য এক মাদুলি -সুতোয় বাঁধা - রেল লাইনের ধারে কাটাহাত - হরি ডোম আসে ঐ - সমান্তরালে অস্থিরতা এবং রক্ষিতার রক্তমাখা চোলি - একসাথে ভাসে বিপন্ন নদীর জলে - কলঙ্কধারার নিবদ্ধ জীবন আষাঢ়ে মেঘের নীচে প্রবহমান - বাঁশির মেঠো সুর ও বর্শার গান - একাধিকবার ঐ পাহাড়ে এসে মনে হয়েছিল - নক্ষত্রমন্ডলীর তলায় পড়ে থাকা সজল সময় - গলায় রুদ্রাক্ষমালা-শরীরে লোহার আভরণ - হেতালের লাঠি উঁচিয়ে মৃতদের সব চলাচল বন্ধ রেখে জলপাই বনের আলোর রেখা মুছে দেয় - এবং অতিরিক্ত আয়ু জুড়ে বর্ষার সকালে পরান্মুখ আকাশের ভাঁজে প্রতীক্ষার খোলা পথ -

শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪

নব্বই দশকের কবিতায় উত্তরাধুনিক চেতনা

।।অলকা নন্দিতা।। ভাষা,সম্পূর্ণভাবে যৌক্তিকতা-নিমগ্ন,উত্তরাধুনিক চিন্তা-চেতনার কবি অলকা নন্দিতা বস্তুজগৎটাকে অস্বীকার করেন না বরং বস্তুর প্রতিফলন ঘটায় সৃষ্টিধর্মী পরিকল্পনায়।আত্ম-সমর্পিত কবিতা লেখার প্রবণতার দিকে এগিয়ে থাকা এ কবি কবিতার অবয়ব জিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা,ধ্যান নিমগ্নতা বা নৈসর্গিক সংলগ্নতা এবং তাৎপর্য্যময় আত্ম-কথনের কবিতায় নিত্যদিনের টানাপোড়ন,দ্বন্দ্ব এবং অপেক্ষার ক্লান্তিতে জড়িয়ে থাকা স্বপ্নের গভীর সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পান আনন্দ এবং উজ্জ্বলতা। উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য একরৈখিকতার কেন্দ্রকে গুড়িয়ে দিয়ে বহুরৈখিক কবিতা বিনির্মাণঃ বর্ষা এলে সাপাতঙ্কে কাটে রাত।বাইরে বেরুলেই পিছলে যাওয়ার ভয়।সাপেরা পিচ্ছিল পথ ভালোবাসে।ফণা তুলে অন্ধকার গলি খোঁজে।বর্ষায় রাতও নামে দ্রুত।সন্ধে লাগতেই নিভে যায় আলো।জানলার কাচ ভেঙে বৃষ্টির জল ঢোকে।ভিজে যায় বইপত্র,তোষক চাদর।বসে থাকি হারিকেন জ্বেলে।যদি বৃষ্টি ধরে ঘুমাব এবার। (সাপাতঙ্ক) আধুনিক জীবন খুব বেশী সহজ নয়।পারিপার্শ্বিক আবহমন্ডল ক্রমেই জটিল করে তুলেছে ।যান্ত্রিক সভ্যতা জীবন-যাপনকে জটিল ও নিয়মের শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলতে চাচ্ছে।তাতে করে মানুষের জীবন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়েছে,পড়েছে বর্ণহীন হয়ে।উত্তরাধুনিকেরা সনাতন ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠতে পারেঃ আমি তো ওরাং জাতি,বৃক্ষবাসী বৃক্ষের পাতায় লেগে আমর জন্মের পূর্বে বৃক্ষ ছিল,ফুল পাখি লতা ছিল বিবর্ণ,বন্ধনহীন, মধ্যে আমি প্রত্মজীব) বিনির্মাণ বা de-construction এর নিকটতম শব্দ বিশ্লেষণ বা analysis.জ্যাক দেরিদার বলেছেন,পাঠ প্রকৃতির মধ্যে নিজস্ব নিয়মেই তৈরী হয় তার অনুবিশ্ব এবং সেই অনুবিশ্ব সমগ্রের স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকে যে সব টুকরো টুকরো চিহ্ন বা স্মারক,বিনির্মাণের ধারায় তাদের ওপর সমীভূত হয় মননশীলতার আলো অর্থাৎ এ সব পাঠে আপাত প্রচ্ছন্নতার চূর্ণ ভস্ম থেকে উঠে আসে এক সমগ্রের উজ্জ্বল আলোকিত মিনারঃ এইমাত্র খবর পেলাম অস্ত্রহীন যুদ্ধে তার কেটে গেছে সারারাত।ঝড়ের বেগে কামাল এগিয়ে এলে সহজেই ধরাশায়ী হয় প্রতিপক্ষ।পলিমাখা নদীর সীমানা ভেঙে পড়ে নিমেষেই।লন্ডভন্ড ধানক্ষেত,বন্ধ ঘরের কবাট। (সঙ্গম) সময়ের এক অবাস্তব যাদু দিয়ে গড়া আজকের এ পৃথিবী।বাস্তবতা পেরিয়ে যায় আঙ্গুলের ফাঁক গলে।প্রকল্পনার স্বচ্ছ চাদরে ঢাকা পড়ে যায় যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্ব।কূটাভাস থেকে কূটাভাসেই যায় পরিভ্রমণ।তারুণ্যদীপ্ত অভিজ্ঞানে ছদ্ম এ সময় বিষদাঁত বিধিয়ে রাখে।ঊষর পৃথিবী ধরা দেয় উত্তরাধুনিক চেতনায়ঃ মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিও দ্রুত রং বদলায় বর্ষায় দেখে আসা দুগ্ধবতী সুবলং যেন শীতে শীর্ণ হয়ে আসা এক নারী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে চোখের সামনে নির্বাক,নিশ্চুপ; (শীতের সুবলং)