Powered By Blogger

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

উত্তরাধুনিকতার বিস্তীর্ণাঞ্চলে.....;পর্ব-১

মনোয়ারা মণিঃ

তিন শতাব্দীতে প্রসূত রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালী সত্ত্বা ও বাংলা সাহিত্যে বিশেষতঃ কবিতার সৃষ্টিশীলতায় এক অসামান্য ঐতিহ্য।সময় ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক দ্বন্দ্ব ও মূল চেতনা মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায় নি বরঞ্চ বদলে গেছে পরিপ্রেক্ষিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক ধারা,বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আধুনিক কবিতার সূচনা ও শেষার্ধে উত্তরাধুনিকতার বীজ বপন করা হয়েছিল।একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে সে চারাগাছ থেকে ক্রমে ক্রমে ডালপালা ছড়িয়ে যত বিকশিত হচ্ছে ততই রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক শক্তি ও অসীমতার উপল্বধিজাত অভিজ্ঞান আমাদের চেতনাকে শাণিত করছে। আর তাই শেকড়াশ্রয়ী কবি মনোয়ারা মণি পশ্চিমি ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে আগমনকারী আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণকারী কিংবা মার্ক্সবাদী দ্বন্দ্বময় ইতিহাস অনুধাবনে অক্ষম নন।গত শতাব্দীর পঞ্চাশের য়্যুরোপ-ম্যারিকা'র অবক্ষয়ী আধুনিকতা তিনি মনে-প্রাণে মেনে না নিয়ে নুতন যুগ-চেতনায় আত্ম-আবিষ্কারের পথ খোঁজেন অতীতমুখীন ঐতিহ্যে তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'নিঃশব্দ পথিক ও স্বপ্ন' এ :

গুরুজী শ্রদ্ধাঞ্জলী
আমি জানি তুমি ভালো আছো
তোমার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি
তোমাকে ভালোবাসি এ কথা বলতে লজ্জা নেই
ঈশ্বর তোমাকে আমার জন্যই পাঠিয়েছিলো
নানা কাজে ব্যস্ত থেকে আমাকে পাঠাতে
একটু দেরী করেছে----এ আর  কি এমন দেরী
..............
(রবীন্দ্রনাথকে খোলা চিঠি)

গত শতাব্দীর শেষদিকে বার্লিনের প্রাচীর ভাঙ্গা,দুই পরাশক্তির ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধে বিশ্ব পরিস্থিতিতে উন্মাদনা,পুঁজিবাদী আগ্রাসনে সু পরিকল্পিতভাবে গ্রাস করে গোটা বিশ্বকে।সবশেষে রাশিয়া ও পূর্ব য়্যুরোপে মার্ক্সবাদের ধ্বংশস্তুপের ওপর পূঁজিবাদী পতাকার দন্ড সুদৃঢ়ভাবে শেকড় প্রোথিত করে।মানবিকতার অপমৃত্যু,শূণ্যময়,লক্ষ্যহীন যাত্রায় বিদীর্ণ হৃদয়ে কবি বলে ওঠেনঃ

স্বাধীনতার ঠিক আগে তার জন্ম
এক দেবশিশু বেড়ে উঠে এক দুর্দান্ত বালক হয়ে
প্রকৃতির সাথে অদ্ভুত ভালবাসা তার
গরু ছাগল আর কবুতর---এ নিয়েই যেন জীবন।
বাবার ইচ্ছে ছেলে মস্তবড় সাহেব হবে,
ছেলে তার প্রেম বিকিয়ে দেয় প্রাণীদের মাঝে
নিয়তি হাসে,দ্বন্দ্ব বাড়ে আর বাড়তেই থাকে,
ঘর ছাড়া হয় সে,কথা বলে তার পালা পশু পক্ষীদের সাথে
এমনি করে একদিন মানুষকেও ভালোবেসে ফেলে
যারা ক্ষমতার আর আপনলোভে হিংস্র হয়ে ওঠে
...............................
...............................
(একজন পাগলের গল্প)

সোনম মনিঃ


শুধুমাত্র অভিনবত্বই উত্তরাধুনিকতা নয়।বহুরৈখিকতা বা বহুত্ববাদ এর প্রধান উপাদান।উদ্দেশ্যহীন জীবন স্থির পাথরের মতোন।এতে কোন পরিবর্তন নেই শুধুমাত্র শ্যাওলা জন্মানো ছাড়া।জীবনই জীবনের কাছে আসে পরিবর্তন বা নূতনত্বের কারণে;যা সমান্তরালভাবে দেখা যায় কবিতার ক্ষেত্রে।উত্তরাধুনিকতা স্বয়ং পরিবর্তনকে সনাক্ত করেন যথার্থভাবে।যিনি যতোবেশী সনাক্ত করতে পেরছেন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকতা,দেশজ ও প্রকৃতি,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিধি,স্থানান্তর ও অর্থবোধকতার প্রান্তিকতা;তিনি ততবেশী উত্তরাধুনিক।জ্ঞানতত্ত্ব থেকে নয়,আধুনিকতার বিরোধীতা করে নয়,জীবন-যাপনের স্বচ্ছতা ও অসীমতাকে লঙ্ঘন করেই উত্তরাধুনিকতার আগমন।কবি সোনম মনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'ভালোবাসার প্রবল প্রপাত' এ যেমন বলেনঃ

সূর্যের আলোয় পৃথিবী তখনো দৃশ্যমান,
পশ্চিম আকাশে রক্তরাগ
সাগরে ভাটা লেগেছে,এতো জল কোথায় হারালো?
মরা গাংগে এ যেন স্ফটিক জল!
.........................
.........................
(যেদিন ওরা চলে গেল)

আমরা পথ হাঁটছি এক সংশয়হীন সমাজ,রাষ্ট্রিক,পারিপার্শ্বিক কাঠামোর মধ্যে।আধুনিককালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার করাল থাবা বিস্তার করেছিল ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত।অর্থহীন এ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষ।সামরিক অভিযান চলে তিন মহাদেশ এবং সাগর-মহাসাগরের বিশাল বিশাল এলাকা জুড়ে। দ্বিতীয় এ বিশ্বযুদ্ধে সামরিক-বে সামরিক মিলিয়ে মানুষ মারা যায় প্রায় পাঁচ কোটি।ধ্বংশ স্তুপে পরিণত হয় অসংখ্য শহর-বন্দর-গ্রাম-জনপদ।ক্ষত,অনাহার ও রোগে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ।হিরোশিমা-নাগাসাকি'র ধ্বংশস্তুপ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা আজও দুঃস্বপ্নের ঘোরে চেঁচিয়ে ওঠে।মদমত্ত ক্ষমতাসীনেরা আখ্যান ও দর্শনের দ্বারা এসব হত্যাকান্ডকে বৈধ করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় বিভৎসতা,হত্যাযজ্ঞে পৃথিবীর মানুষের মানবিক মূল্যবোধ,চিন্তা-চেতনার জগৎকে ওলট-পালট করে তোলে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত পরিনাম,টেকনো সায়েন্সের ক্রম-বর্ধমান অগ্রগতি পাশ্চাত্যের সামাজিকতা এবং মানুষের চিন্তার জগৎকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেঃ কান্ট,হেগেল,মার্কসের মতোন দার্শনিকের জন্ম দেয়া জাতির মধ্যে কিভাবে অমানবিকতা,পাশবিক মনোবৃত্তি,ক্রোধ,নিষ্ঠুরতা কিভাবে লালন করে?টলস্টয়,চেখভের মতোন মানবতাবাদীর দেশে কিভাবে হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেল?লিংকনের আদর্শে গড়া মার্কিনীরা কেমন করে হিরোশিমা ও নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মানুষকে পরমাণু বোমায় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে? মানুষের আশা-আকাংখা ও চাহিদা পূরণে ব্যর্থ শেকড়হীন আধুনিকতাকে পদদলিত করে এগিয়ে চলছে উত্তরাধুনিকতাঃ

এ শতাব্দীতে হচ্ছে তত বেশী আর হয়তো আগে হয় নি।
জীবন যদিও স্থবির হতে চায়,তবু চলমান থাকে কি এক মায়ায়?
আমাদের এ কুহকী পৃথিবীতে কত যে মানুষের কষ্ট,কত যে সুখ,কত যে
গুণ
কত যে সাহসী বীর,কত যে কদর্যতা এক নজরেই মনের আয়নার মতোই
চোখের সামনে হাজির হয়।
এ যেন এক মহা সময়ের সর্বোচ্চ এক স্বর্ণ তোরণ খোলে বিজিগীষা।
(স্বর্ণযুগ)

নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনাঃপর্ব-১

Art শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল 'শিল্প।' ল্যাটিন শব্দ Ars থেকে গ্রিক ভাষায় বিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজীতে Art শব্দটি এসেছে। আদিমকাল থেকেই মানুষ নিজের অজান্তেই শিল্প সৃষ্টি করে আসছে।অরণ্যচারী,গুহাবাসী মানুষ শিল্প কি জানত না,বুঝত না শিল্পের স্বরুপ কি।আদিম মানুষ অন্ধকার দেখে,আগুন দেখে ভয় পেত, তেমনি পূর্ণচাঁদের আলো দেখে মোহিত হত,শিকার করা পশুকে ঘিরে গোল হয়ে মনের আনন্দে নেচে চলত।।নিজের বাসস্থান গুহায় এঁকে রেখেছিল কল্পিত দেব-দেবী,শিকার দৃশ্য কিংবা স্বাভাবিক,দৈনন্দিন জীবনের চিত্র। এগুলো সবই শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর যে কোন শিল্পই দৃষ্টিনন্দন বা নান্দনিক। মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ-কর্মে যে সৌন্দর্য্য ফুটে ওঠে তার সবই নান্দনিক। নিজের আলুলায়িত কেশ যখন কোন রমণী পরিচর্যা করে কিংবা ফুটপাথে বে-আব্রু রমণী সর্ব-সমক্ষে স্তন উন্মুক্ত করে তার সন্তাঙ্কে দুগ্ধ পান করানোর ফলে যে সৌন্দর্য্যটুকু ফূটে ওঠে তার সবই নান্দনিক। W.B.Warsfild তাঁর Juddgement in literature বইয়ে স্পষ্ট বলেছেন, 'Arts is an element in the life civilizeds man.' মানুষের জীবন জটিলতম অধ্যায়। জীবনকে সাজাতে হয় নানা প্রকরণে। কারো কারো মতে এই প্রকরণই নন্দন ত্তত্ব।নন্দনত্তত্বের সঙ্গে সৌন্দর্য্যবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকের কাছে নন্দনতত্ত্বই হল সৌন্দর্য্যতত্ত্ব।নন্দনত্তত্বের সংজ্ঞা নির্ণয় খুব সহজ কাজ নয় এর পরিধির ব্যাপক ও বিশালতার কারণে ।J.A.Cuddon তাঁর Penguin Dictionery of literary Terms and literary theory বইয়ে নন্দনত্তত্ব সম্পর্কে লেখেন,
''aestheticism:A complex term 'pregnant' with many connotations.The actual word derives from Greek aistheta 'thing perceptible by the senson':and Greek aisthetes denotes 'one who perceives.'

এই Aesthetics শব্দটি গ্রিক 'aisthesis' থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজীতে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গ্রিক 'aisthesis' শব্দটির অর্থ sense perception বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষতা। অন্য কথায় নন্দনতত্ত্বকে প্রত্যক্ষণ শাস্ত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রাচীন সংস্কৃতে যাকে বলা হয়ে থাকে  'বীক্ষণশাস্ত্র'।বীক্ষণ শব্দের অর্থ বিশেষভাবে দেখা। অর্থাৎ গ্রিক প্রত্যক্ষণ ও সংস্কৃত বীক্ষণ একই অর্থ বহন করে থাকে।
Aesthetics sশব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলেন তার সঠিক কোন হদিস পাওয়া যায় না ।তবে বাউম্ গার্টেন Meditationes philosophicae de nanullis ad poema pertinentibus বইয়ে প্রথম এই শব্দটির ব্যবহার করেন। এরপর ইমানুয়েল কান্ট Aesthetics শব্দটি ব্যবহার করেন ১৭৯০ সালে প্রকাশিত Critique of Judgement বইয়ে। F.T. Vischer তার Aesthetik oder Wissen Schafides Schonen শীর্ষক বইয়ে ১৮৪৩ সালে শব্দটির ব্যবহার করেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত G.T Fechner এর পর Vorschule der Asthetik বইয়েও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। ইউরোপীয় দর্শন চর্চায় Aesthetics শব্দটির অর্থের এই বিশেষীকরণ ব্যাপারটি হেগেল তাঁর Aesthetics বইয়ে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লেসিং,শিমার,গোয়েটে,শেলিং,শোপেন হাওয়ার,হিউম,বার্ক,রাস্কিন,ড্রাইডেন,পোপ প্রমুখ কবি ও দার্শনিক চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করেন। আর ক্রোচে নন্দনতত্ত্বকে দার্শনিক তত্ত্বের রুপ দিলেন তাঁর শিল্পতত্ত্ব ও শিল্পতত্ত্বের ইতিহাস বইয়ে।
বম গার্টেনের মতে,যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের লক্ষ্য সত্য,নান্দনিক জ্ঞানের লক্ষ্য সৌন্দর্য্য।বিচার ও পর্যবেক্ষন দ্বারা উপলব্ধিজাত চরম উৎকর্ষতাই সত্য।সৌন্দর্য্যের লক্ষ্য নির্ভেজাল আনন্দের উদ্রেক।সৌন্দর্য্যের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি প্রকৃতির অনুকরণ।
মেলডেনসন এর মতে,'সৌন্দর্য্যের বিকাশই শিল্প।' প্রকৃত পক্ষে মানুষের রুচিই সুন্দরের স্বরুপ নির্ধারণ করে থাকে।তবে রুচি সম্পর্কিত বিধি-বিধান অলিখিত এবং কোনো আইন-কানুন বা বিধি নিষেধ দিয়ে এর সীমা নির্ধারণ করা যায় না।

ডাচ লেখক হেমস্টার হুইস মনে করতেন,আনন্দ বিধায়ক বস্তুই সৌন্দর্য্য এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রচুর অনুভূতির সঞ্চারক বস্তুই সর্বাধিক আনন্দদায়ক এবং স্বল্পতম সময়ে বৃহৎ পরিমাণ অনুভূতি সঞ্চারক বলেই সুন্দর বস্তুর উপভোগ মানুষের অধিগম্য মহত্তম সংবেদনা।

কাল পরিক্রমায় সৌন্দর্য্যবোধ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে।নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সৌন্দর্য্যের সনাতন ধারণা নয়,মানুষের চিন্তা,চেতনা এবং সৃজনশীলতার ভিত্তিতে যে আনন্দময় অপরুপ এক জগতের সৃষ্টি হয় তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।যখন এই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রচলিত ছিল না তখনো এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও অনুশীলন হয়েছে।

বেনেদিত্তো ক্রোচে শিল্পসৃষ্টি ও নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিষয়ে নূতন বক্তব্য রেখে নান্দনিকতার কেন্দ্রীয় অবস্থানে পরিবর্তন এনে দেন। ''শিল্প মানে প্রকাশ,প্রকাশ মানে সজ্ঞা(ইনট্যুইশন),শিল্প প্রকাশের সমার্থক এবং প্রকাশ আর সজ্ঞা একই।'' শিল্পবোধের সৌন্দর্য্য বিমূর্ত বা মূর্ত নয়,সফল প্রকাশ।শিল্পের এই সফল প্রকাশ সৌন্দর্য্য কিংবা সৌন্দর্য্য ব্যতিরেকে হতে পারে।বেনেদিত্তো ক্রোচে মনে করেন শিল্পের এই সফল প্রকাশই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব এর মূল বিষয়।

বম
গার্টেনের মতে,যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের লক্ষ্য সত্য,নান্দনিক জ্ঞানের লক্ষ্য
সৌন্দর্য্য।বিচার ও পর্যবেক্ষন দ্বারা উপলব্ধিজাত চরম উৎকর্ষতাই
সত্য।সৌন্দর্য্যের লক্ষ্য নির্ভেজাল আনন্দের উদ্রেক।সৌন্দর্য্যের সর্বোচ্চ
অভিব্যক্তি প্রকৃতির অনুকরণ।

মেলডেনসন এর মতে,'সৌন্দর্য্যের বিকাশই
শিল্প।' প্রকৃত পক্ষে মানুষের রুচিই সুন্দরের স্বরুপ নির্ধারণ করে
থাকে।তবে রুচি সম্পর্কিত বিধি-বিধান অলিখিত এবং কোনো আইন-কানুন বা বিধি
নিষেধ দিয়ে এর সীমা নির্ধারণ করা যায় না।


ডাচ লেখক হেমস্টার
হুইস মনে করতেন,আনন্দ বিধায়ক বস্তুই সৌন্দর্য্য এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে
প্রচুর অনুভূতির সঞ্চারক বস্তুই সর্বাধিক আনন্দদায়ক এবং স্বল্পতম সময়ে
বৃহৎ পরিমাণ অনুভূতি সঞ্চারক বলেই সুন্দর বস্তুর উপভোগ মানুষের অধিগম্য
মহত্তম সংবেদনা।


কাল পরিক্রমায় সৌন্দর্য্যবোধ সম্পর্কে
মানুষের ধারণা বদলে গেছে।নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সৌন্দর্য্যের
সনাতন ধারণা নয়,মানুষের চিন্তা,চেতনা এবং সৃজনশীলতার ভিত্তিতে যে আনন্দময়
অপরুপ এক জগতের সৃষ্টি হয় তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।যখন এই Aesthetics
বা নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রচলিত ছিল না তখনো এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও
অনুশীলন হয়েছে।


বেনেদিত্তো ক্রোচে শিল্পসৃষ্টি ও
নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিষয়ে নূতন বক্তব্য রেখে নান্দনিকতার কেন্দ্রীয়
অবস্থানে পরিবর্তন এনে দেন। ''শিল্প মানে প্রকাশ,প্রকাশ মানে
সজ্ঞা(ইনট্যুইশন),শিল্প প্রকাশের সমার্থক এবং প্রকাশ আর সজ্ঞা একই।''
শিল্পবোধের সৌন্দর্য্য বিমূর্ত বা মূর্ত নয়,সফল প্রকাশ।শিল্পের এই সফল
প্রকাশ সৌন্দর্য্য কিংবা সৌন্দর্য্য ব্যতিরেকে হতে পারে।বেনেদিত্তো ক্রোচে
মনে করেন শিল্পের এই সফল প্রকাশই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব এর মূল বিষয়।

প্লেটো শিল্পকে মনে করতেন মিথ্যার জগৎ কেননা শিল্প হচ্ছে,''বিশেষের প্রতিভাসের অনুকরণ,'' বা ''Imitation of Imitation.''

শিল্প
অনড় বা স্থবিরতা থেকে মুক্তি চায়।অনড়ত্ব বা স্থবিরতা থেকে মুক্তিলাভই
হচ্ছে শিল্পের সার্থকতা।যে কোন শিল্পই মানুষের মনে আনন্দের অনুভূতি
জাগায়।কিন্তু প্লেটো মনে করতেন শিল্পের আনন্দ পরিশেষে মানুষকে ভোগের পথে
নিয়ে যায় এবং তাকে নীতিগতভাবে আদর্শভ্রষ্ট বা বিপথে চালনা করতে
পারে।প্লেটো আরো মনে করতেন শিল্প যেমন একদিকে নিছক আনন্দ সৃষ্টি করে
মানুষকে ভোগের পথে নিয়ে যায়,তেমনি শ্রোতা বা দর্শক বা পাঠককে ভাবাবেগে
আপ্লুত করে ফলে সমাজ ও নৈতিক জীবন অবক্ষয়ের পথে যেতে পারে।সে কারণে প্লেটো
শেষ পর্য্যন্ত শিল্পের জগৎকে প্রকৃত reality'র জগৎ বলে মনে করতেন না,মনে
করতেন appearance এর জগৎ।পরিশেষে এই মিথ্যার জগৎ অমঙ্গল্বোধ জন্ম দেয় ফলে
নৈতিকদৃঢ়তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।প্লেটো তাঁর বিখ্যাত 'Republic'
গ্রন্থে কবিদের ধান,দূর্বা ও চন্দনকাঠ দিয়ে নির্বাসন দিতে
চেয়েছিলেন;যারফলে প্লেটোরও ঠাঁই হয় নি কবিতার ইতিহাসে।।প্লেটোর প্রিয় কবি
ছিলেন হোমার।সাফোর কবিতাও পছন্দ করেছিলেন তিনি।প্লেটো নিজেও প্রেমের আবেগে
গদগদ দু'চারটে পদ্য লিখেছিলেন কিন্তু প্লেটোকে একজন ব্যর্থ বা সার্থক কবি
বলা যাবে না কারণ তিনি কবিতার সাধনায় সিদ্ধি খোঁজেন নি।যেহেতু মানুষের
চিন্তারাজ্যে প্লেটোর দর্শন আজও শেষ হয়ে যায় নি আর তাই তাঁর কবিতার পাঠক
এখনো খুঁজে পাওয়া যায়।
(অসমাপ্ত)

সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১.বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্বঃমাসুদুল হক।
২.শিল্পের স্বরুপ/লিও টলস্টয়।অনুবাদঃদ্বিজেন্দ্রলাল নাথ।
৩.সবার জন্য নন্দনতত্ত্বঃহাসনাত আবদুল হাই।
৪.কবিতার বীজতলাঃআবু হাসান শাহরিয়র।
৫.নন্দনতত্ত্বঃডঃ সুবীর কুমার নন্দী।
৬.নন্দনতত্ত্ব এর সূত্রঃ অরুণ ভট্টাচার্য।
৭.নন্দনতত্ত্বঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
৮.নন্দনতত্ত্বে প্রতীচ্যঃ ড.সুখেন বিশ্বাস।
৯.নন্দনতত্ত্বে প্রাচ্যঃড.সুখেন বিশ্বাস।
১০.সঙ্গীত ও নন্দনতত্ত্বঃসুচেতা চৌধুরী।
১১.মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্যবিচারঃঅরবিন্দ পোদ্দার।
১২.নন্দনতত্ত্ব-জিজ্ঞাসাঃতরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
১৩.আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্বঃ জিললুর রহমান।
১৪.A Guide To Aesthetics:Prof.Prabasjiban Choudhury.
১৫.Studies In Comparative Aesthetics: Pravas Jivan Chaudhury.
L

উত্তরাধুনিক বিতর্কঃপর্ব-১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় বিভৎসতা,হত্যাযজ্ঞে পৃথিবীর মানুষের মানবিক মূল্যবোধ,চিন্তা-চেতনার জগৎকে অল্ট-পালট করে তোলে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত পরিনাম,টেকনো সায়েন্সের ক্রম-বর্ধমান অগ্রগতি পাশ্চাত্যের সামাজিকতা এবং মানুষের চিন্তার জগৎকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেঃ কান্ট,হেগেল,মার্কসের মতোন দার্শনিকের জন্ম দেয়া জাতির মধ্যে কিভাবে অমানবিকতা,পাশবিক মনোবৃত্তি,ক্রোধ,নিষ্ঠুরতা কিভাবে লালন করে?টলস্টয়,চেখভের মতোন মানবতাবাদীর দেশে কিভাবে হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেল?লিংকনের আদর্শে গড়া মার্কিনীরা কেমন করে হিরোশিমা ও নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মানুষকে পরমাণু বোমায় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরে 'দি সোসিও লজিক্যাল ইমাজিনেশন' বইয়ে সি.রাইট মিল লেখেনঃযাকে আধুনিক যুগ বলা হয় তার শেষে মানুষ উপনীত হয়েছে।অনন্ত 'পোষ্ট মডার্ন' বা বাংলায় যা উত্তর আধুনিক বা উত্তরাধুনিকতা এর সামনে উপস্তিত আমরা। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবোধ আর শৃঙ্খল্মুক্তি এতোদিন যে উদারতা আর সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে,আজ তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে অসওয়াল্ড স্পেংলার তাঁর ' দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট' বইয়ে লেখেন,পাশ্চাত্যের সভ্যতা আর তার মূল্যবোধ,দায়িত্ব এবং সংস্কৃতি দুর্গন্ধময় পচনে নিমজ্জিত।

এ রকম অস্থিতিশীল সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিস্তিতিতে উত্তরাধুনিকতার উদ্দীপক প্রতিভূ জঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার ' দি পোষ্ট মডার্ন' লিখে ঘোষণা করেন :মহা-আখ্যান ও পরা-আখ্যানের কাল শেষ।ওসব আখ্যানের বৈধতার প্রতিশ্রুতি লুপ্ত ও নির্বাপিত। উল্লেখ্য যে,এ মহা-আখ্যান/পরা-আখ্যান হলো কান্ট,হেগেল,মার্কসের দর্শন।

১৮৭০ সালে ওয়ট কিনস চ্যাপম্যান নামে এক চিত্রকর সর্বপ্রথম'পোষ্ট-মডার্নিজম' শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ফরাসী ইমপ্রেশনিস্ট চিত্র অপেক্ষা আরো আধুনিক,আরো অভাঁ-গার্দ ছবির ক্ষেত্রে এই অভিধা প্রয়োগ করেন। তারওপ্রে ১৯১৭ সালে এসে Rudolf Pannwitz একটি বইতে নিহিলিজম ও সে সময়কার ইউরোপে সব ম,ঊল্যবোধ ভেঙ্গে যাওয়ার বিবিরণ দিতে গিয়ে তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন।'পোষ্ট-মডার্নিজম' বা উত্তর- আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা নিয়ে পাশ্চাত্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে কম আলোচিত। এর উদ্ভব পাশ্চাত্যে এবং সেখানে এর পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। তার অনেক কিছুই আমাদের অজানা।উত্তরাধুনিকতা ধারণা নিয়ে পাশ্চাত্য জগতে বিতর্ক এখন যেমন তীব্র,তেমনি এর বৈশিষ্ট্য,আধুনিকতা,আধুনিকতাবাদের সাথে এর সম্পর্ক বিষয় নিয়েও মতবিরোধ বেশ বড় রকমের। এক একজন যুক্তিগ্রাহ্যভাবে একেক রকম্ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন।
আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদকে কেউ কেউ আধুনিকতাবাদের একধাপ অগ্রসর ভাবছেন।আবার কেউ কেউ আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদকে বিপরীত মেরুতে বসাচ্ছেন।আধুনিকতার সমালোচনা উত্তরাধুনিকতাতেই আছে-----এমোনও বলছেন কেউ কেউ। মার্কিন সাহিত্যতাত্ত্বিক ইহাব হাসান উত্তরাধুনিকতাকে হাজার ভিড় থেকে বেছে নিতে ছন্দ,অলংকার,ভাষা ও সাহিত্যতত্ত্ব,দর্শন,নৃ-বিজ্ঞান,মনোঃসমীক্ষা প্রভৃতি থেকে নূতন লক্ষঙুলোর সাথে তুলনা করে নিম্নোক্ত সারণি তৈরী করেছেনঃ

আধুনিকতাবাদ উত্তরাধুনিকতাবাদ

রোমান্টিসিজম/প্রতীকবাদ প্যাটাফিজিক্স/দাদাবাদ
ফর্ম ক্রীড়া
স্তরবিন্যাস নৈরাজ্য
পান্ডিত্য নিঃশেষ
শিল্পকান্ড/নিখুঁত প্রক্রিয়া/ঘটনা
উপস্তিতি অনুপস্তিতি
সৃজন/সমগ্রায়ন বিসৃজন/বিনির্মাণ
কেন্দ্রিকতা বিকেন্দীকতা
উৎপ্রেক্ষা অনুপ্রাস
নির্বাচন মিশ্রণ
মূল/গভীরতা অনুভূমিক কান্ড/অগভীর
পাঠকেন্দ্রিক লেখককেন্দ্রিক
আখ্যান আখ্যান বিরোধীতা
ধর্মপিতা পবিত্র আত্মা (ইত্যাদি)

(ক্রমশঃ)

কবিতার ফেরীওয়ালা হাসানআল আব্দুল্লাহ

অনুভূতির বাস্তবতাই হচ্ছে সাহিত্যের বাস্তবতা।যা অনুভব করা যায় সেটাই বাস্তবতা-----সাহিত্যের বাস্তবতা।সুন্দর সব সময়ের জন্যেই সুন্দর,আবার যা আনন্দদায়ক, তাই সুন্দর।সুন্দর তর্কের দ্বারা নয়,যুক্তি বা প্রমাণের দ্বারা নয়,উপলব্ধির বোধ দ্বারা,স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বীকার্য্য।প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা জগৎ এবং প্রকৃতির মধ্য দিয়ে সুন্দরকে খুঁজবার এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার নিরন্তর সাধনায় লিপ্ত থাকি।সুন্দরকে পাওয়ার বা তাকে উপস্থাপন করার শুরু সেই গুহাবাসী আদিম সমাজ থেকে----শিল্পের মাধ্যমে।এই শিল্প কাব্য,নাটক,সঙ্গীত,চিত্রকলা,নৃত্যকলা সবকিছুকে ঘিরে আবর্তিত।আর শিল্পের সবথেকে শক্তিশালী শাখা হচ্ছে 'কবিতা';যা কবিতার ফেরীওয়ালা হাসানআল আব্দুল্লাহ তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'ক্যাফের কবিতা'য় সুন্দরের উপলব্ধিজাত অনুভূতিতে স্পষ্টভাবে উচ্চারন করেনঃ
...............................
................................
দ্রুপদের মেয়ে তিনি,জন্ম তার পাঞ্চাল নগরে
সুকৃশ উদর,নিতম্ব সুন্দর;সোনা ঝরে নাকের কন্দরে।
পৃথিবীর প্রথম সুন্দরী সেই দ্রৌপদী ষোড়ষী,
উন্মাদ পড়শী
তার রুপে
চুপে চুপে
কেউ কেউ একে এক নিতে চায় ঘরে;
(হিন্দু মিথ)

নিরন্তর প্রস্তুতিই '৯০ দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ'র কবিসত্ত্বার অবচেতনের অলিন্দে সমকালের সঙ্গে মহাকাল,উত্তরাধুনিক বর্তমান সময়কে বাস্তবতার নিরিখে প্রখরভাবে আশ্র্য় করেছেন।জীবনানন্দ দাশ বোঝাতে চেয়েছিলেন,''শুধু বুদ্ধি কিংবা শুধু ভাবপ্রতিভাতেই সিদ্ধি নয় বরঞ্চ এই দুইয়েরই সমন্বয়ই মহৎ কবিতা জন্ম নেয়।'' সময়ের প্রতিফলন কবিতায় না থাকলে তা হয়ে যায় ভাষাহীন।এই বোধ থেকেই হাসানআল আব্দুল্লাহ'র কবিতা অন্ধকার থেকে আলো জ্বেলে প্রকৃত সত্য বের করে আনেন কবিতায়ঃ

বামচোখে ব্লাইন্ড স্পটের গাড়ি
দেখে মোড় ঘুরে প্রশস্ত পাহাড়ী
পথে অ্যাকসেলেটর চাপি---বাড়িমুখী
গাড়িগুলো পিঁপড়ের সারির মতন সুখী;
হাইবীমে আলোকিত সামনের রাস্তা---
কেউ কেউ যদিও কিছুটা আস্থা-
হীনতায় ভোগে;
কাউকে আবার পায় সেলফোন রোগে
কিম্বা নিয়ন্ত্রণহীন সঙ্গীতের ঘোর
লেগে কেউ কেউ মোড়
ঘুরে খাদে পড়ে যায়;
যান্ত্রিকতার এমন ভ্রুভঙ্গ খেলায়
কেউ কেউ মার্বেলের মতো
রাস্তায় ছড়িয়ে দেয় জীবনের স্বাদ ইতস্তুত

তারপর ফরেষ্ট পার্কের
অন্ধকারে ফের
দেখা হয় রুপসী রাতের সাথে;
গাড়ি থেকে নেমে তার হাতে
হাত শেকে
ভালো করে তাকে আরেকটু দেখে
ষ্টিয়ারিং হুইলে আবার
রাখি হাত;বার বার
মনে পড়ে পিছে ফেলে আসা সময়ের মুখ;
চলাই প্রধান---জানি-- আমাদের প্রকৃত অসুখ
(মুসলিম মিথ)

কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ অতীত ঐতিহ্য 'মহাকাব্যিক মিথ' ব্যাখ্যা করেছেন বর্তমান সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে।ইতিহাস চেতন ও দেশজ প্রেমের কারণে মিথগুলোকে প্রয়োগ করেছেন বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে গভীর এক দায়িত্ববোধ থেকে;নিজের পারিপার্শ্বিক সময়,মহাকাব্যিক জ্ঞান ও সমকালীন অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে সমকালের বাটখারায়  মহাকালকে মাপবার।ফলতঃ তাঁর কবিতায় এক স্বতন্ত্র সুর বেঁজে ওঠে,যখন তিনি বলেন :

অলিম্পাস থেকে আফ্রোদিতির গলার হার পরে
হিরা আইডা পর্বতে এসে জিয়ুসের সাথে,মেঘের চাদরে
বিপুল সঙ্গমে যখন সমান্তরাল
হেকটরের দল রেখে ট্রয়ের সকাল
আস্তে আস্তে পিছু হটে,যদিও অ্যাপোলো
নেমে এসে ষোলো
আনা শক্তি ঢেলে দেন তার গায়ে
(গ্রীক মিথ)

হাসানআল আব্দুল্লাহ'র কবিতায় অস্থিরতা,হতাশা,ক্লান্তি,অনিঃশেষ নিঃসঙ্গতা যুগ মানসের যন্ত্রণার অভিঘাত সামগ্রিক উপলব্ধির চিত্র প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।মানব জীবনের অপ্রাপ্তি ও অসম্পূর্নতা চিত্তকে বিলোড়িত করে।ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় মানুষের হৃদয় থেকে অপসৃত সহমর্মীতার বীজ এবং স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধছে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস।হাসানআল আব্দুল্লাহ দুঃখ করে বলেনঃ

পাবার কথা ছিলো শিল্প মর্যাদা
রাতের বিছানাতে তবু যে বাধ-সাধা
উলটে পড়ে থাকে আমার কবিতারা।
পাবার কথা ছিলো স্রোতের শিরদাঁড়া,
উজানে হেঁটে গিয়ে বৃষ্টি অকাতরে;
পাবার কথা ছিলো স্মৃতির কলস্বরে
সুষম বিন্যাস আশা ও হতাশার।
অথচ আজ দেখি একটি পাখি তার
নিজের ঠোঁট দিয়ে পালক ছিঁড়ছেন।
বাহঅনে চেপে যারা বাসায় ফিরছেন
মাছির মতো,এই করণ সন্ধ্যায়,
এবং ব্যাথা নিয়ে হিসেবী দুই পায়
চাকেও ভিড়ছেন যতোটা সম্ভব
তারাতো পান নাই সেসব গৌরব
যা দিয়ে যায় চেনা কাঁটা ও কাঁটাতার।
পাবার কথা ছিলো গভীরে নামবার
অনেক শক্তি ও সরল সঞ্চয়;
কিছুই পাই নাই,তাই তো ভয় হয়
পাবার কথা শুধু কথার জালটায়
আটকে অযথাই খোলস পালটায়
(খ্রীষ্টান মিথ)

কবিতা শুধুমাত্র Statement বা বিবৃতি নয়।কবিতার ভেতর দিয়ে কবি পথ করে নেন কাল,মহাকাল ও অনন্তলোকের।কবিতার বক্তব্য ও উপস্থাপনের কারণে এটা বিমূর্ত রুপ হয়ে ওঠে।কবিতা তখন আর কবিতা থাকে না,হয়ে ওঠে জীবঞ্চরিত দর্শনঃ

বুঝতে থাকে না বাকী
রাতারাতি বেড়ে ওঠা প্রলোভনের সবই ফাঁকি
লালসালু দায়ী যথারীতি---
ভুলে ভরা বিষাক্ত অধ্যায়---

যারা চায় আমরা সতত থাকি তাদের পায়ের নিচে
সেইসব মহগাপুরুষের পিছে
আহাজারি----অতঃপর
দায়ী ---জানি নিজহাতে
গড়ে তোলা তাদের ঈশ্বর
(ইহুদি মিথ)

মুনীব রেজওয়ানের 'নীলকন্ঠ':বিমুগ্ধ পাঠকের অনুভব।

..............................................
..............................................
রাতে হলে ঢেলে দেই খানিকটা চন্দ্রপ্রভা
খোলা বুকে হুড়মুড় ধুকে যায় রুপালী তারার গন্ধ
অজানা গন্তব্যের জাহাজ ঠিক ভেড়ে স্বপ্নের বন্দরে।
(বাতাসের গান)
 দিগন্ত বিস্তৃতা অপার প্রকৃতি,নিসর্গমন্ডলের রং,ধ্বণি  বা চিত্র নয়,------কবি মুনীব রেজওয়ান তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ্র 'নীলকন্ঠে' স্থান জগতের গতিপ্রবাহকেও বেদনা প্রকাশের ভাষায় প্রকাশ করেন।প্রেম দর্শন ও মহাজাগতিক বোধের অতীত মানসিক অনুধ্যান,জনমানসকে বদ্ধ,নিশ্চল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে যাবার মূল শক্তিই গতিময়তা। আর আবেগের গতিময়তা কবির চিত্তকে করে তোলে প্রাণচঞ্চল ও আবেগময়,সম্মুখধারী।কবি যখন তার বোধের সমীকরন মেলান সৃষ্টিজগতের চিরায়ত গতি প্রবাহের সঙ্গে কিংবা সোজা কথায় বলা যায় কবিতার অস্তিত্বে আবিষ্কার করেন এক নূতন প্রমাজ্ঞান আর এমনই ব্রাম্মমুহূর্তে নূতন নূতন শব্দানুষঙ্গ মিলে সৃষ্টি হয় এক নুতন জীবনপ্রবাহ;যার নাম কবিতাঃ

জীবনের সবক'টি বসন্ত পুড়েছে বেগুনী জ্যোৎস্নায়
প্রতিটা দহনে রক্ত আজ আরো নীল
প্রতিটা চুম্বনে সহস্রবার খুলছে নরকের দ্বার
গভীরতা বাড়াতে আপন,নদীকে দেখেছি
সবগুলো নালা থেকে কেমন শুষছে লালা;
(কাঞ্চন জংঘা)

দ্বান্দিক বরতবাদী কবি নান্দনিক চিন্তা ও শিল্প প্রকরণে উদ্ধুদ্ব যুগের নিষ্পষনে তাঁর কবিসত্ত্বায় সৃষ্টি হয়েছে ুবসাদ,ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতাঃ
কোথাও আকাশ নেই,মাথার উপরে সাজানো শূণ্যতা
একাকী শয্যায় শুয়ে পাতাবাহারের নাচ দেখি
(কোথাও কোনো আকাশ নেই)

কাব্যসাধনার শুরুতেই দেখি শিল্পিত কবিতার পক্ষে কবি মুনীব রেজওয়ান।আর তাই কবিতায় জ্যোৎস্নার শরীরে 'স্বপ্নের বাস্তবে' যাবার বাসনায় শিল্পচেতনার সিঁড়িতে ক্রমাগত বিনির্মাণ করেনঃ
পাতাল খনক,খুঁড়ে আনি অনিমেষ;
ঘুম আর স্বপ্নদের সাজাই তোমার জলপাই চোখে।
নির্ণিমেষে তোমাকে নিমগ্ন করি শরদেন্দু নীলে।
রুপালী নক্ষত্রের ঝালরে জড়াই জোছনা শরীর।
(দিবা নিশি কাব্য)


প্রবল আশাবাদই তাঁর কবিতায় উপজীব্য।প্রেম চেতনার কবিতায় থাকেনা কোনো কেন্দ্রীয় উপমা,প্রথাগত চিত্রকল্প।নিপূণ,নি&খুত শব্দের বুননে নান্দনিক অনুভূতিতে বিনির্মাণ করেন কবিতা;যাতে বাস্তবতাবিবর্জিত,পলায়নী মনোবৃত্তি নয়,বাস্তব আশাবাদের অভিলাষ ব্যক্ত থাকে
.................................
.................................
ঐ দিকে দেখো আঁচল চুঁইয়ে নামছে সোহাগের ঢল
কাঁঠালিচাঁপা ফুটছে তোমার উঠোনে আগের নিয়মেই
প্রতিশ্রুত সন্ধ্যায় তুমি আসনি তবু প্রতীক্ষা রয়েছে জমা
যে কোনো জ্যোৎস্নায় এখনও নিঃশব্দে হাঁটে একটি শাদা পাঞ্জাবী
(নিঃশব্দে হাঁটে একটি শাদা পাঞ্জাবী)

শার্ল বোদলেয়ার ছিলেন প্রথম আধুনিক কবি,যিনি রোমান্টিক কাব্য-চেতনার প্রবল স্রোতের বিপরীতে একটি ভিন্নতর ও অভিনব বাঁধ বিনির্মাণ করেছিলেন;যাতে আশ্রয় করে ইউরোপীয়ান কাব্য চেতনা এক নূতন জগতে প্রবেশ করে।ফলে আমরা পাই ভিন্নমাত্রার এক অনাস্বাদিত কবিতা------আধুনিক কবিতা।বাংলাতে যার সূচনা কাল ১৯২৫।জীবনানন্দ দাশের সংস্পর্শে আধুনিক বাংলা কবিতা ব্যক্তিস্বরুপ্য লাভ করে।আধুনিক কবিদের চিন্তা,মন ও মানসকে শাণিত করে নূতন এক কাব্যালোকের আলোকে নিয়ে গেছেন।প্রথাসিদ্ধ সুন্দর য়ার প্রচলিত ধারণার অ-সুন্দরকে মিশিয়ে অভাবনীয় এক স্পষ্টতা এনে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। গভীর বেদনা,বিষন্নতা ও বিষ্ময়বোধ এক স্বাতন্ত্র্য মহিমা এনে দিয়েছে এক বাংলা কবিতায়।জীবনানন্দ দাশ গভীর বেদনা বিষন্নতা পেয়েছিলেন বোদলেয়ার থেকে।আর উত্তরাধুনিককালে কবি মুনীব রেজওয়ানের কবিতায় গভীর হতাশা ও বিষন্নতা এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকেঃ
হৃদয়ের হ্রদ থেকে কাঁপন শুরু
বিয়াশের ধুবড়ি তরঙ্গ!
গুঁড়িয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ঘর-দোর-জানালা.
তোমার-আমার যুথচারী শব্দের কবিতা প্রসাদ
শব্দরা অতি নিঃশব্দেও ভাঙ্গে বুঝি!
বড়ই কান্নাহীন এ কষ্ট।
(জলতংক)


কবি মুনীব রেজওয়ান দৈনন্দিন ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে দেখেন বাস্তবতা বিবর্জিত,রোমান্টিক দৃষ্টিতে নয়,সমাজ সচেতন একজন নাগরিক হিশেবে।সামাজিক অন্যায় অবিচারে ব্যথিত কবি বিষয় ও প্রসঙ্গের সহজ,স্বতঃস্ফুর্ত স্বাভাবিকতার পাশাপাশি কবিতার ভাষা নির্মাণ ও প্রকৌশলে চিকিৎসক কিংবা বিচারকের দাপ্তরিক ভাষা নয় নিছক আটপৌঢ় ও ব্যকরন শৃংখলমুক্ত সরল ও সহজবোধ্য ভাষায়,বিভিন্ন আলংকারিক প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতাকে স্বতন্ত্র উচ্চতায় নিয়ে যাবা প্রচলিত চেষ্টাকে প্রতিহত করেছেন তাঁর হাস্নাহেনা কবিতায়ঃ

''ছিনাল মাগী
কুলের বদনে চুন কালি
একশ একটা দোররা মারবি
খবিসের খায়েসের মইদ্দে।''

সমকালীন নষ্ট সময়ের সমকালীন কবিদের মতো কপট নন তিনি।অকপটে নিজের বিশ্বাস ও কল্পনা ব্যক্ত ক্রেন তিনিঃ
.......................
.......................
শতাব্দীর সংযম ভাঙ্গি,শুষ্ক কন্ঠে এসো মাধবী সুধা
সংবৃতা জোছনা রাত,এসো ভেজা পরাগের রেণু
উত্থান প্লাবনে ভেসে যাক অয়োমল সন্ধিস্মারক
(বুনো বাতাসের দোল)

গতানুগিতকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন নি তিনি।আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে কবিতায় অভিনব মাত্রা সংযোগ করতে তিনি সবসময়েই বদ্ধ পরিকর। আবেগঘন বস্তনিষ্ঠ নৈর্ব্যক্তিকতা----বাস্তবাতা মূর্ত করে তোলেন স্বতঃস্ফুর্ততায়।আনন্দের জন্যেই কবিতা তবুও তিনি কখনো গ্রহণ করেন না উদ্দেশ্য ও নীতিহীন আনন্দ।গভীর বিশ্বাসবোধ থেকেই জারিত করেন মানবিকতা হৃদয়ে লালন করেন নান্দনিকতা মূল বক্তব্যঃ

আমগাছে লটকে থাকে কাঠাঁল
পুলিশের বড়সাব দিনদুপুরে মাতাল
যৈবতী কন্যার ঘরে তেলহীন কুপি,দাপাদাপি রাত!
গতর খসিয়ে চাঁদা,কুমারী জ্যোৎস্নায় ভাঙ্গে রাতের চৌকিদার
(ঘোরে বন্দী স্বদেশ আমরা)

সময়,পারিপার্শ্বিক ও জীবন ঘনিষ্ট কবিতায় জীবনের আশালোকের ঈঙ্গিত লালনে তিনি একজন সফল শব্দচাষা।কবি মুনীব রেজওয়ান আক্ষরিক অর্থেই একজন কবি,সম্পূর্ণ কবি।সৌন্দর্য্যতার অনুধ্যানে এসে পরিপার্শ্বের অন্যান্য অনুষঙ্গ একীভুত করে নৈরাশ্য,সমাজ,প্রেম,দ্রোহ,দেহ,রিরংসা শিল্পের কেন্দ্রে একীভূত করেছেনঃ

ভয় নেই, ইকেবানা জানি,
জানি কি করে সাজাতে হয় ফুল ও কাঁটা।
বড় যত্নে খুলব মায়াবী মলাট, ধবল জোৎস্নার ফিতে।

কলাবতী চন্দ্ররাত অপেক্ষায় থেকো।
অপেক্ষায় থেকো ঝাউবনে বাতাসের ঢেউ
তুর্ণা নিশীথায় আসব গোধুলির ঠিক আগে।

একটা একটা করে উল্টে যাব কাগজের ভাঁজ
শীতবৃক্ষদের সাজিয়ে দেব সবুজ পাতায়
জীবনের এতোগুলো বসন্ত কুলফি মালাই হয়ে জমে আছে
তোমার উষ্ণতা পেলে ফুল, পাখী আর দক্ষিণা বাতাস হবে।

জলখাবারের টেবিলে বসেই শব্দ চষি আজকাল
ওখানেই তুমি বিছিয়ে দিও আঁকিবুঁকি কাগজের পলি
চাষাবাদে মন্দ নই, রক্তে তুমুল বইছে প্রপিতামহের উত্তারাধীকার।
তাম্রযুগে বসে পালকের ডগায় এঁকে যাব শব্দের মোনালিসা।

এলোচুলে বেঁধে দেব মেঘের আকাশ, মায়াবতী রাত
দূ’চোখের পাপড়িতে মেখে দেব নক্ষত্রের অত্যুজ্জ্বল মায়া
নাকের নোলকে ঘাসফুল ছাবি, দুটি গোলার্ধ নাচবে দুটি কানে
উষ্ণ ঠোঁটে মোহর এঁকে নেমে যাব কবিতার অন্তরাতে—
যেখানে কবির ঠোঁটে  তৃষ্ণা জাগে অবোধ শিশুর মত।
(ইকেবানা!)

উত্তরাধুনিকতা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আত্মানুসন্ধানের মুখোমুখি।প্রকৃতির পরিপূরক্তার ধারণা থেকে আত্ম-সম্পূর্ন্তার দিকে,স্বয়ম্ভুতার দিকে। আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা মধ্যে সবচে' বড়ভেদ হল একরৈখিক্তা ও বহুরৈখিকতা।উত্তরাধুনিকতার মূলে রয়েছে কেন্দ্রকে আঘাত করে বলয় ভেঙ্গে বহুরৈখিকতাকে টেনে আনার সক্রিয়তা। একরৈখিকতার টান যদিও পিছু ছাড়ছে না।কোনো এক কবিতায় কবি একরৈখিক হলেও সমগ্রে দেখা যায় তার বহুরৈখিকতা। এভাবেই একেকজন একেকভাবে তার নিজস্ব আঙ্গিকে জড় হচ্ছেন উত্তরাধুনিকতার বিস্তীর্ণাঞ্চলেঃ


যদি একদিন সত্যি থেমে যায় বৈকাল হ্রদ!
কি হবে যদি সত্যি থামে নাফাখুম  প্রপাতের ধারা?
শুনশান নিরবতায় বৃক্ষগুলো স্থিরপত্র দাঁড়িয়ে।
থেমে আছে নিঃশ্বাস, কন্ঠনালী নীল অজানা বিষে

রাত্রিবাস খুলে আকাশে বাইজী নাচে নটিনী চাঁদ
মৃত জোনাকির গল্পে ভেজে এইসব হরিৎ জোৎস্না
পানপাত্রে জমা হয় আরো কিছু গৌড়ী মদিরা
দূর কাশবনে ফুলে ফুলে কাঁদে বিষণ্ণ পানকৌড়ি

এই যে পাখী---একদিন নিশ্চিত থামবে তার গান।
এই যে  নদী--- সবটুকু জল সহ হতে পারে  উধাও

ফুলেরা সবাই ঝরে
কুসুমের দুষ্ট কীট একদিন সেও যায় মরে

পেয়েছিলে সদ্য জন্মানো দিন, নতুন সম্ভাবনা নিয়ে
কুমারীর কৌমার্যের সুখ-গন্ধটুকু নিয়ে হলে উধাও!
মৃতদের বুক থেকে আজো চুরি হয় প্যাপিরাস, রক্তে প্রত্ন খনন -
নষ্ট ফসিলের মত আমি শুধু বেঁচে আছি মাটির গভীরে।
(মৃত জোনাকির গল্প)

কাব্যপ্রেমীর দৃষ্টিতে কাকলী মুখোপাধ্যায়ের 'ঈহিতা'

ছাগলের দড়ি মাড়িয়েছি
ভুলে ভরা রোদে।
কুকুরটা রাতভর কাঁদে
স্বপ্নে দেখি দাঁত গেছে নড়ে
তাই বুঝি ধার গেছে কমে
হিসেব মেলাতে পারি না যে আর মোটে
(অনর্থ)

 উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতাকে যুগ-সন্ধিক্ষণের নৈরাশ্য,বৈকল্য ও প্রত্যয়হীনতার বৃত্ত থেকে শক্তি,বিশ্বাস ও বাস্তবতার ধ্রুবলোকে প্রতিস্থাপনে কাকলী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঈহিতা'য় দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়েছেন।প্রাগসর চেতনার অধিকারী কাকলী মুখোপাধ্যায় অস্তিবাদে বিশ্বাসী।তাঁর এ বিশ্বাস মনগড়া নয়।তিনি জানেন সময়,দেশ,কাল পারিপার্শিকতার সমস্যা।একক প্রচেষ্টায় শুধু বর্তমান নয়,অদূরেও এর থেকে নিষ্কৃতি অসম্ভব।অসম্ভব জেনে তিনি তাঁর কবিতায় রুঢ় এ বাস্তবতা এড়িয়ে যান নি বরঞ্চ ভাবাতুর পাঠককে প্রবল আশাবাদে উজ্জীবিত করেছেন এভাবে :
.........
.........
জানি না আজও আদৌ এসেছি কোথায়!
পেয়ে যাব জাহাজের টিকেট নিশ্চয়,
সমুদ্র অথৈ নীল,মাছেদের রুপকথা মেখে
চলে যাব তিন নয় দেশ।
পিশাচীর  হৃদয়ের ক্ষত,মুছে দিব হেসে,
মিশে যাব নীলিমায়,বাঁচবার ঝোঁকে।
(পরিব্রাজন)

মননঋদ্ধ আবেগ ও ভাবনা কবি কাকলী মুখোপাধ্যায় এর কবিতায় স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্য মহিমা এনে দিয়েছে,তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত নিরবিচ্ছিন্ন ও স্পষ্ট,সুস্থিত কবিতা বিনির্মাণে :

দেখেছি বড়ড়ষার ফলা,দেখিনি বনতুলসীর পেলবতা।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যান বনদেবী,
ময়ূরপাখা হেসে ওঠে,অসংকোচে নদীটির বাঁকে
দারুণ পাথুরে হাত,ফাগুন কোমলতায়,তার কটিদেশ।
(উন্মুখ)

উত্তরাধুনিক মানুষ ভয়াবহভাবে নিঃসঙ্গ তার অন্তর্গত জটিলতার কারণে অন্যসব মানুষের সঙ্গে সে একাত্ম হতে পারে না :

ইউক্যালিপটাসের রঙ দেখে ভাবি
সাদা কালির কালো মাহুত
এই আমি কেন বর্ণহীন।
বিকারের ঘোরে রচি কাব্য রসাতল।
(রাখী বিসর্জন)
উত্তরাধুনিক মানুষের হতাশা,জীবনে জটিলতা,অস্তিত্বের সংকট,সমাজের সঙ্গে অনন্বয় এবং স্বীয় সত্ত্বার বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বিষাদ ভারাক্রান্ত করে।বিচ্ছিন্নতার বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যাপকভাবে;অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য ও আত্ম-যাতনা থেকে উদ্ভূত।জীবনের অর্থহীনতা,সভ্যতার কপটাচার তাঁর বিচ্ছিন্নতার জ্বালা মেটাতে পারে নি।

''প্রখর স্বদেশবোধ এবং ইতিহাসচেতনা থাকলে মিথের ব্যবহার না করে কবির উপায় নেই''-----গভীর বিশ্বাস থেকে অন্তরের নিগূঢ়ে লালন করেন কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়।সময়ের অনিবার্য্য কারনে সমাজ ও ইতিহাস সচেতন কবি ভারতীয় ইতিহাস ও মহাভারতের মিথ সমান্তরালতায়,তুলনায় অথবা প্রতিকূলতায় নিবিষ্ট তাঁর কবিতায়:

বনবাসে যাব
সীতা নই শূপর্ণখা অসূয়া পিয়াসী
(অসূয়া)

কিংবা

শকুনী মামার পাশা ভেঙ্গে দেয় ঘর
পতিতার ঘর জমে ওঠে
( দ্রৌপদী)

অথবা

চিঠি এসে গেছে জানে ধৃতরাষ্ট্র পিতা
শব্দভেদী বাণে
(শব্দ)

রবীন্দ্রনাথের কাছে ঈশ্বরই ছিলেন কবি।প্রাচ্য-পুরাণে কবি হচ্ছেন সত্যদ্রষ্টা।কবি কেনেথ কোবে মনে করতেন শিশুরাই কবি।যখন কেউ একটা কবিতা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে,সে তখন কবি বলেছেন কার্লায়েল। কিন্তু এতে কবিচিত্র কিংবা মানস পূরোপুরি পরিস্ফুট হল না।কবিতা হচ্ছে বিশুদ্ধ শিল্প। সৃষ্টিকলায় কবি হচ্ছে ঈশ্বরের সমকক্ষ সেহেতু কোন নির্দিষ্ট পরিমাপে কবিকে পরিমাপ করা যায় না।স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালব্যাপী কবির পরিভ্রমণ।চিলির কবি ক্রিয়েশনিজম কবিতা আন্দোলনের জনক ভিসেন্তে হুইদোব্রো'র মতে কবিতার কাজ তিনটি,----সৃষ্টি,সৃষ্টি এবং সৃষ্টি।সৃষ্টির মূলকথা হচ্ছে শৈল্পিকতা। আর শৈল্পিকতা বিচারে হোমার থেকে শুরু করে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায় একই নিক্তিতে পরিমাপযোগ্য:

..........
..........
সতীত্বের বিনির্মাণ ছিল সব পূরাণ কাহিনী
এখনো মাটির অতল
আছে জানি জল ডুববার
আভরণ খুলে গেলে চিরসুখী কুশীলব দেবে ঘৃণা
স্রষ্টার মিথ্যার ঝুলি ভরে
তাই জলে যাব বলে বুকিং করেছি টিকিট।

নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়,জীবনের জন্য শিল্প।গভীর বিশ্বাস থেকেই উচ্চারণ করে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়:

মাঝরাতে মেঘের রজ্জুতে ঝুলে পড়ে চাঁদ।
সুরম্য দেয়ালে ঝোলে,গর্ভবতী টিকটিকি এক।
দেয়ালের ঘেরাটোপে মিথ্যার লালন
সত্যকথা বলতেই টিক টিক টিক।
(চাঁদ-১)

কাকলী মুখোপাধ্যায় জীবন ও প্রকৃতির এক আবেফমদ্রিত আনন্দঘণ প্রতিভাসে বিমূর্ত করে তুলেছেন মানবিক অবস্থা,নিজস্ব আবেগ প্রত্যয়ে জীবনের শিল্পিত ও সানন্দ রুপ।তিনি মনে করেন কবিতা সকল প্রকার দর্শন ভাবনাঋদ্ধ।কবিতার লক্ষ্য সত্য। সে সত্য স্বতঃসিদ্ধ ও আবেগের আন্তরীকতায় দৃপ্ত। আর এ সত্যই আনন্দের বার্তাবহ এবং কবিতার মূল্য এই আনন্দ বিধানে :

..........................
..........................
ক্ষরণে শিকড় কাঁদে,কশ বেয়ে পড়ে খুন নীল,
সবুজ,বেগুনী কিংবা বেনি আসহকলা রঙের
মাঠের বুকের মাঝে,তুলসীতলায় প্রণতি রাধার চোখে
(ধূসর)

নাগরিক সূযোগ-সুবিধা,বিলাস-বৈভব এবং উত্তরাধুনিক এ যুগের মানুষকে অন্তঃসারশূণ্য করে ফেলেছে। এ নির্মম বাস্তবতার বিপর্য্যয় দেখে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকট হয়ে উঠেছে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার ছবি:
নষ্ট ণীরে ভ্রষ্টাচারী আমি
পালাই সাধুর ঘর থেকে
জন্ম-জন্মান্তর ধরে একা।

যুগ-মানসেরত যন্ত্রণায় বিদগ্ধ আত্মা উপায়ন্তরহীন হয়ে কিছু একতা ওবোল্ম্বণ কোড়াড় জোণয়ে ষোড়নাপোণ্ণ হয় অতীত স্মৃতির।সমৃধ স্মৃতির এ্যালবাম আতিঁ-পাঁতি করে খুঁজতে হয় ন্যুনত্ম আশ্বাস।কিন্তু বর্তমান যতোই ভয়াবহ,অতীত যতোই হিরন্ময়ই হোক না কেন বর্তমানকে অস্বীকার কিংবা কিংবা অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।কবির বোধে সেটা আত্মোলব্ধিজাত:

গুহাবাসী শাবকের মুখে লেগে থাকা দাগ বলে
পূরাতন পরিচয় কথা।
মানুষের পূয়াতন বাটী,ফেলে রাখা স্মৃতি,
কাঠঠোকরার ঠোঁটেই,দেখেছি
কাঠুরিয় প্রেত রুপকথা।
পাখিটা এসেছে বুঝি পারস্যের কাঠ খুদে খুদে
বসরাই গোলাপের ঘ্রাণ,
লেগে আছে পিতামহী করে।
আমাদের ইতিহাস প্রেত কথকতা
বোঝে না বনজ পাখি,গুহাবাসী আদমের ব্যর্থ প্রজনন।