Powered By Blogger

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

কাব্যপ্রেমীর দৃষ্টিতে কাকলী মুখোপাধ্যায়ের 'ঈহিতা'

ছাগলের দড়ি মাড়িয়েছি
ভুলে ভরা রোদে।
কুকুরটা রাতভর কাঁদে
স্বপ্নে দেখি দাঁত গেছে নড়ে
তাই বুঝি ধার গেছে কমে
হিসেব মেলাতে পারি না যে আর মোটে
(অনর্থ)

 উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতাকে যুগ-সন্ধিক্ষণের নৈরাশ্য,বৈকল্য ও প্রত্যয়হীনতার বৃত্ত থেকে শক্তি,বিশ্বাস ও বাস্তবতার ধ্রুবলোকে প্রতিস্থাপনে কাকলী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঈহিতা'য় দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়েছেন।প্রাগসর চেতনার অধিকারী কাকলী মুখোপাধ্যায় অস্তিবাদে বিশ্বাসী।তাঁর এ বিশ্বাস মনগড়া নয়।তিনি জানেন সময়,দেশ,কাল পারিপার্শিকতার সমস্যা।একক প্রচেষ্টায় শুধু বর্তমান নয়,অদূরেও এর থেকে নিষ্কৃতি অসম্ভব।অসম্ভব জেনে তিনি তাঁর কবিতায় রুঢ় এ বাস্তবতা এড়িয়ে যান নি বরঞ্চ ভাবাতুর পাঠককে প্রবল আশাবাদে উজ্জীবিত করেছেন এভাবে :
.........
.........
জানি না আজও আদৌ এসেছি কোথায়!
পেয়ে যাব জাহাজের টিকেট নিশ্চয়,
সমুদ্র অথৈ নীল,মাছেদের রুপকথা মেখে
চলে যাব তিন নয় দেশ।
পিশাচীর  হৃদয়ের ক্ষত,মুছে দিব হেসে,
মিশে যাব নীলিমায়,বাঁচবার ঝোঁকে।
(পরিব্রাজন)

মননঋদ্ধ আবেগ ও ভাবনা কবি কাকলী মুখোপাধ্যায় এর কবিতায় স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্য মহিমা এনে দিয়েছে,তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত নিরবিচ্ছিন্ন ও স্পষ্ট,সুস্থিত কবিতা বিনির্মাণে :

দেখেছি বড়ড়ষার ফলা,দেখিনি বনতুলসীর পেলবতা।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যান বনদেবী,
ময়ূরপাখা হেসে ওঠে,অসংকোচে নদীটির বাঁকে
দারুণ পাথুরে হাত,ফাগুন কোমলতায়,তার কটিদেশ।
(উন্মুখ)

উত্তরাধুনিক মানুষ ভয়াবহভাবে নিঃসঙ্গ তার অন্তর্গত জটিলতার কারণে অন্যসব মানুষের সঙ্গে সে একাত্ম হতে পারে না :

ইউক্যালিপটাসের রঙ দেখে ভাবি
সাদা কালির কালো মাহুত
এই আমি কেন বর্ণহীন।
বিকারের ঘোরে রচি কাব্য রসাতল।
(রাখী বিসর্জন)
উত্তরাধুনিক মানুষের হতাশা,জীবনে জটিলতা,অস্তিত্বের সংকট,সমাজের সঙ্গে অনন্বয় এবং স্বীয় সত্ত্বার বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বিষাদ ভারাক্রান্ত করে।বিচ্ছিন্নতার বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যাপকভাবে;অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য ও আত্ম-যাতনা থেকে উদ্ভূত।জীবনের অর্থহীনতা,সভ্যতার কপটাচার তাঁর বিচ্ছিন্নতার জ্বালা মেটাতে পারে নি।

''প্রখর স্বদেশবোধ এবং ইতিহাসচেতনা থাকলে মিথের ব্যবহার না করে কবির উপায় নেই''-----গভীর বিশ্বাস থেকে অন্তরের নিগূঢ়ে লালন করেন কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়।সময়ের অনিবার্য্য কারনে সমাজ ও ইতিহাস সচেতন কবি ভারতীয় ইতিহাস ও মহাভারতের মিথ সমান্তরালতায়,তুলনায় অথবা প্রতিকূলতায় নিবিষ্ট তাঁর কবিতায়:

বনবাসে যাব
সীতা নই শূপর্ণখা অসূয়া পিয়াসী
(অসূয়া)

কিংবা

শকুনী মামার পাশা ভেঙ্গে দেয় ঘর
পতিতার ঘর জমে ওঠে
( দ্রৌপদী)

অথবা

চিঠি এসে গেছে জানে ধৃতরাষ্ট্র পিতা
শব্দভেদী বাণে
(শব্দ)

রবীন্দ্রনাথের কাছে ঈশ্বরই ছিলেন কবি।প্রাচ্য-পুরাণে কবি হচ্ছেন সত্যদ্রষ্টা।কবি কেনেথ কোবে মনে করতেন শিশুরাই কবি।যখন কেউ একটা কবিতা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে,সে তখন কবি বলেছেন কার্লায়েল। কিন্তু এতে কবিচিত্র কিংবা মানস পূরোপুরি পরিস্ফুট হল না।কবিতা হচ্ছে বিশুদ্ধ শিল্প। সৃষ্টিকলায় কবি হচ্ছে ঈশ্বরের সমকক্ষ সেহেতু কোন নির্দিষ্ট পরিমাপে কবিকে পরিমাপ করা যায় না।স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালব্যাপী কবির পরিভ্রমণ।চিলির কবি ক্রিয়েশনিজম কবিতা আন্দোলনের জনক ভিসেন্তে হুইদোব্রো'র মতে কবিতার কাজ তিনটি,----সৃষ্টি,সৃষ্টি এবং সৃষ্টি।সৃষ্টির মূলকথা হচ্ছে শৈল্পিকতা। আর শৈল্পিকতা বিচারে হোমার থেকে শুরু করে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায় একই নিক্তিতে পরিমাপযোগ্য:

..........
..........
সতীত্বের বিনির্মাণ ছিল সব পূরাণ কাহিনী
এখনো মাটির অতল
আছে জানি জল ডুববার
আভরণ খুলে গেলে চিরসুখী কুশীলব দেবে ঘৃণা
স্রষ্টার মিথ্যার ঝুলি ভরে
তাই জলে যাব বলে বুকিং করেছি টিকিট।

নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়,জীবনের জন্য শিল্প।গভীর বিশ্বাস থেকেই উচ্চারণ করে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়:

মাঝরাতে মেঘের রজ্জুতে ঝুলে পড়ে চাঁদ।
সুরম্য দেয়ালে ঝোলে,গর্ভবতী টিকটিকি এক।
দেয়ালের ঘেরাটোপে মিথ্যার লালন
সত্যকথা বলতেই টিক টিক টিক।
(চাঁদ-১)

কাকলী মুখোপাধ্যায় জীবন ও প্রকৃতির এক আবেফমদ্রিত আনন্দঘণ প্রতিভাসে বিমূর্ত করে তুলেছেন মানবিক অবস্থা,নিজস্ব আবেগ প্রত্যয়ে জীবনের শিল্পিত ও সানন্দ রুপ।তিনি মনে করেন কবিতা সকল প্রকার দর্শন ভাবনাঋদ্ধ।কবিতার লক্ষ্য সত্য। সে সত্য স্বতঃসিদ্ধ ও আবেগের আন্তরীকতায় দৃপ্ত। আর এ সত্যই আনন্দের বার্তাবহ এবং কবিতার মূল্য এই আনন্দ বিধানে :

..........................
..........................
ক্ষরণে শিকড় কাঁদে,কশ বেয়ে পড়ে খুন নীল,
সবুজ,বেগুনী কিংবা বেনি আসহকলা রঙের
মাঠের বুকের মাঝে,তুলসীতলায় প্রণতি রাধার চোখে
(ধূসর)

নাগরিক সূযোগ-সুবিধা,বিলাস-বৈভব এবং উত্তরাধুনিক এ যুগের মানুষকে অন্তঃসারশূণ্য করে ফেলেছে। এ নির্মম বাস্তবতার বিপর্য্যয় দেখে কবি কাকলী মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকট হয়ে উঠেছে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার ছবি:
নষ্ট ণীরে ভ্রষ্টাচারী আমি
পালাই সাধুর ঘর থেকে
জন্ম-জন্মান্তর ধরে একা।

যুগ-মানসেরত যন্ত্রণায় বিদগ্ধ আত্মা উপায়ন্তরহীন হয়ে কিছু একতা ওবোল্ম্বণ কোড়াড় জোণয়ে ষোড়নাপোণ্ণ হয় অতীত স্মৃতির।সমৃধ স্মৃতির এ্যালবাম আতিঁ-পাঁতি করে খুঁজতে হয় ন্যুনত্ম আশ্বাস।কিন্তু বর্তমান যতোই ভয়াবহ,অতীত যতোই হিরন্ময়ই হোক না কেন বর্তমানকে অস্বীকার কিংবা কিংবা অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।কবির বোধে সেটা আত্মোলব্ধিজাত:

গুহাবাসী শাবকের মুখে লেগে থাকা দাগ বলে
পূরাতন পরিচয় কথা।
মানুষের পূয়াতন বাটী,ফেলে রাখা স্মৃতি,
কাঠঠোকরার ঠোঁটেই,দেখেছি
কাঠুরিয় প্রেত রুপকথা।
পাখিটা এসেছে বুঝি পারস্যের কাঠ খুদে খুদে
বসরাই গোলাপের ঘ্রাণ,
লেগে আছে পিতামহী করে।
আমাদের ইতিহাস প্রেত কথকতা
বোঝে না বনজ পাখি,গুহাবাসী আদমের ব্যর্থ প্রজনন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন