Powered By Blogger

শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০১১

কর্মফল

সবাই ইতর নয়;মানুষের যোগ্যতার প্রয়োজন আছে

হাবিলের লাশ কাঁধে ব্যাকুল কাবিল
ক্রুশকাঠ বহনের অপরাধে পূণ্যালোভাতুর মানুষ ক্রুসেডে মাতে
পান্ডবদের শঙ্খের শব্দে কাঁপে আকাশ,পৃথিবী
সম অধিকারের দাবীতে ছাড়ে লিলিথ ইডেন অব গার্ডেনের অফুরন্ত সুখ
আগুনে দরোজা মেলে নরক আহ্বান করে,'আয়।'

সময়ের সাথে বেড়ে চলে পৃথিবীর বয়স,নিস্তেজ চোখে
ঘুম নামে রাত্রির পূর্বেই।অতি সাধের পৃথিবী
জিতে নেয় শয়তান ঈশ্বরের ভুল চালে
স্বজন বধের ভয়ে ধনুর্বান ফেলে অর্জুন,রথের মধ্যে
সারথী শ্রীকৃষ্ণ ভগবান বলেন,'সমস্ত কর্ম ভগবানে সমর্পণ।'

২৫.০৩.১১
পল্লবী,ঢাকা।

যুথবদ্ধ

আমার চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে বান্ধবী ওড়না ছুঁড়ে দিয়ে
নিপূণ শৈল্পিকতায় একে একে খুলে নেয় আমার পোষাক
কোমরের বেল্ট,শার্ট,প্যান্টের জিপার,আন্ডারওয়্যার খুলে
নিজেকে বিবস্ত্র করে বিলাসবহুল পোষাকের ভার থেকে
প্যান্টি,ব্রা'র হুক খুলে মেলে ধরে প্রসাদী ফুলের শুঁচিতায়
গগাঁর নিমগ্নতায় দেখি:সোনারঙগা নিরাবরন শরীর
তার ঘাড়,গলা,বাহু,মসৃন পেট ও নাভী,উন্মুক্ত ঊরু ও জঙঘাদেশ
উদ্ধত,ভরাট বুক,---ঈষৎ হেলানো;নগ্ন নারীদেহ নয়,---যেন
মহান শিল্পীর গড়াঁ অপরুপ এক শিল্পকর্ম

মৈথুনরত সাপের মতো আলিঙগনাবদ্ধ হই
পরস্পরের নিঃশ্বাস শুঁকি চুল,কপাল,বগল,---
মরুর তৃষ্ণার্ততায় শুষি ঠোট নিঃসৃত অমৃত
যোনীর নোনতা স্বাদে ভরে ওঠে মুখ
ভূগোলময় শরীরে মাতালের উন্মততায় দু'হাতে স্পর্শ নিয়ে নেই
তার ঘাড়,গলা,বুক ও পেট,শীতল পশ্চাদ্দেশ
দুই স্তনে মুখ গুঁজে কামোচ্ছ্বাসের উন্মাদনায়,
কামনার লাল ঝড়ে উড়ে যেতে থাকি আগ্নেয়গিরির অশান্ত উত্তাপে
তপ্ত আমরা দু'জন;নির্ভারতার বিশ্বাসে একে অপরের
আবেগের তীব্রতায় গলে যেতে থাকে তিক্ততার যত বিষ
সামুদ্রিক ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ে আমাদের পায়

ফ্লুরেসেন্ট বাতিগুলো নিভে গেলে হৃদয়ের উজ্জ্বল শিখাতে
আলোকিত বিছানায় সুখের শিৎকারে থেমে যায়
সমুদ্দুরের মন্থন,---সৈকতের সিক্ত বালি তেতে ওঠে রৌদ্রে
আউলা বাতাস ছুয়ে ছুয়ে যায় শিরিষের শাখা

২৬.০৩.১১

পল্লবী,ঢাকা।

শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১১

কবির অন্তোষ্টিক্রিয়া

সাদা অফসেট ঢেকে রেখেছে কবির মরদেহ
কালো অক্ষরে সাজিয়ে সাজিয়ে তোলে শোকঁগাথা সন্ত্রস্ত কম্পোজিটর
জ্বলন্ত চিতায় যথাযোগ্য মর্যাদায় অন্তোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন------
আত্মপাসাদে শ্মশ্মাণবন্ধু হুইস্কি গলায় ঢালে

'.....এই কবিতায় কবি বলেছেন..'নিয়মিত ছন্দে
নামতা আউড়ে যান সু-শোভিত অধ্যাপক।

২১.০২.১১
পল্লবী,ঢাকা।

ফিনিক্সিয় কবি

গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত কবি নির্বিকার
মৃতের নির্লিপ্ততায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাড়ি
নেড়ে বললেন,তাড়াতাড়ি বিচারের কাজ শেষ
করে ফেলো আমার অনেক কাজ জমা হয়ে আছে
আর্চ বিশপ আসনে বসলেন কাকের আলখাল্লার
কালো পোষাকে আবৃত হয়ে---হয়তো গোপণে নাড়ি
টিপে দেখলেন ত্রস্ত,চঞ্চল জনগণের অনুভুতি কিংবা সমর্থন
বাদীপক্ষের উকিল কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন
কবিতার ছত্রে ছত্রে  থাকছে ঈশ্বর অবিশ্বাস
আর মহাজাগতিক অলীক বর্ণনা;
যা ধর্মগ্রন্থের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ
বাদীপক্ষের উকিল কঠোরতম শাস্তির জন্যে আবেদন
জানিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন।ন্যায় বিচারের স্বার্থে
আর্চ বিশপ কবিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলে
কবি বলে উঠলেন,'কবিরা সব সময়েই সত্যদ্রষ্টা হয়।'

আর্চ বিশপ কবিকে নির্দ্বিধায় জ্যান্ত পুঁড়িয়ে মারার রায় দিয়ে দেন
মানি না মানি না এই  প্রহসনের বিচার জনতার ক্রুদ্ধ
গর্জনে বিশপ দ্রুত এজলাশ ছেড়ে চলে যান

ওরা জানেনা কবির মৃত্যু হয় না
ফিনিক্সিয় শুদ্ধতায় কবি বারংবার জন্ম নেয়

০৬.০৩.১১
পল্লবী,ঢাকা।


বিষাদের সুর

আলো নেভে উপকূলে আর আর বিষাদের সুর কেঁপে কেপেঁ ওঠে
বিশ্বাসের নৌকা ভেড়ে নির্বাসন দ্বীপে
নূহের প্লাবন থেমে যায় ব্যাবিলনে
সাতশত রুপসীর স্বপ্নে বিভোর কিং সলোমন
ভাবেন,জীবন অর্থহীন।( সুখ গর্দভের উপভোগ্য,মানুষের নয়)

মহাপুরুষের পথে হেঁটে পথ নয় পেয়েছি অন্ধকারের জ্বলজ্বলে অবিশাস
ইন্দ্র আর জিউসের সাহচর্যে জেনেছি,---মানিনি ধর্ষণের শৈল্পিকতা

কোন প্রশ্ন করোনা বরঞ্চ নির্বোধতায় উত্তপ্ত
ভ্রান্ত অবিশ্বাসী ধারা ভেসে যাক জোছনার সোমত্ত প্লাবনে


উল্কাপিন্ড

আকাশের নক্ষত্রেরা কখনোই খারাপ থাকে না
ইতিহাসের পাতায় চাপ চাপ জমে থাকা রক্তে ঘোড়ার ওপর বসে
ভাবি,মাঝে মাঝে বহু উল্কাপিন্ড পৃথিবীতে এসে জ্বলে ছাই হয়ে যায়
অন্তঃত আরেকবার ফিরে এসো বিশুদ্ধ ফলের শুষ্কতায়
মরুদ্যানের কূয়োর পাশে অফুরান স্বপ্নে কেটে যাবে হাজার রাতের
দীর্ঘতায়,দীর্ঘতম রাত ধ্যানমগ্ন ঋষির মতোন চোখ বুঁজলেই
দেখি,পিপঁড়ের সারি চলে যাচ্ছে দেশান্তরে মারী-মন্বন্তরে
কৃষকের গো-শালায় লোলুপ হামলে পড়ে বাঘের নখর

উল্কাপিন্ড পৃথিবীর বাতাসের সংস্পর্শে মুহূর্তে
জ্বলে ওঠে তেজস্ক্রিয়তায়----সেভাবে হলেও এসো

১৩.০৩.১১
পাবনা।

সবুজ পৃথিবী

বিশ্বাসী বন্ধুর চোখ আজ আর কোথাও দেখি না
অবিশ্বাসী ঢেঊ আসে শরীর ভিজিয়ে চলে যায়
বসন্তের বর্ণালীতে বৃক্ষের সবুজ  শাখা আনত গায়ক
পাখিদের নিয়ে নয়,---কাক,চিল আর শকুনের সম্মেলনে পরিণত

সবুজ বনের কাছে সবুজাভ আভা ভিক্ষে চেয়েছি সবুজ হবো বলে
চন্দ্রালোকের মতোন বিষন্নতায় কুঁকড়ে ম্রিয়মান সবুজ বৃক্ষেরা
বলে,'ক্রমেই ধূসর থেকে ধূসরতায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি
বরঞ্চ যা পারো নিয়ে যাও। জমা রেখো অনন্তকালের জন্যে।'

আমার নিজস্ব কোনো পর্বত নেই যে যার গভীর গুহায়
সবুজাভ আভাগুলো জমা রেখে দেবো
যেনো প্রয়োজন হলে অগ্ন্যুৎপাতের মতোন গোটা পৃথিবীতে
মুহূর্তে সবুজ আভা বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারি

১০.০৩.১১
সৈয়দপুর।


শনিবার, ৫ মার্চ, ২০১১

ভ্রান্ত অবিশ্বাস

আলো নেভে উপকূলে আর আর বিষাদের সুর কেঁপে কেপেঁ ওঠে
বিশ্বাসের নৌকা ভেড়ে নির্বাসন দ্বীপে
নূহের প্লাবন থেমে যায় ব্যাবিলনে
সাতশত রুপসীর স্বপ্নে বিভোর কিং সলোমন
ভাবেন,জীবন অর্থহীন।( সুখ গর্দভের উপভোগ্য,মানুষের নয়)

মহাপুরুষের পথে হেঁটে পথ নয় পেয়েছি অন্ধকারের জ্বলজ্বলে অবিশাস
ইন্দ্র আর জিউসের সাহচর্যে জেনেছি,---মানিনি ধর্ষণের শৈল্পিকতা

কোন প্রশ্ন করোনা বরঞ্চ নির্বোধতায় উত্তপ্ত
ভ্রান্ত অবিশ্বাসী ধারা ভেসে যাক জোছনার সোমত্ত প্লাবনে


দুঃখবোধ

অনেক জীবন হেঁটে এসে পৌঁছোলুম
নিরুদ্দিষ্ট সমুদ্রের বালুকা বেলায়
শ্যাওলা জড়ানো মৎস্য কন্যারা সাদরে
আমাকে সাগর বুকে টেনে নিয়ে যায়
এ্যালব্যাট্রস ডানার ঝাপটানিতে স্বাগত বলে উড়ে যায়
ডলফিনেরা শরীর ঘেষে আদরের পরশ বুলিয়ে দেয়

একজীবনের সমস্ত দুঃখ জমা রেখেছি সবুজ বনানীর বৃক্ষতলে
ভালোবাসার পরশ দিয়ে দুঃখ-বেদনাগুলোকে
 গ্রাস করে নিতে চায় নিজের ভেতরে

আমি আর কতটুকু দুঃখ তাদের ভেতরে দেবো

০৬.০৩.১১
পল্লবী,ঢাকা।


হাসানআল আব্দুল্লাহর ‘‌কবিতার ছন্দ’ : একটি পর্যালোচনা।/রবিউল মানিক


হাসানআল আব্দুল্লাহর ‌কবিতার ছন্দ : একটি পর্যালোচনা।/রবিউল মানিক

সংস্কুত শব্দ ছন্দঃ(স)থেকে ছন্দ শব্দটি এছেসে। এর আভিধানিক শব্দ  বেদ। চন্দ কবিতা রচনার একটি শিল্প সুষমামান্ডিত গঠণ কৌশল। ছন্দকে কবিতার ছাঁদ নামেও অভিহিত করেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতার সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক অপরিহার্য়্য ও অবিচ্ছেদ্য। কবিতায় মিল থাকুক বা নাথাকুক ছন্দের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।কবিত একটি অপার্থিব বস্থু। কিন্ত তাকে আয়ত্তে আনার জন্য বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-নির্জনে তপস্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদদের দৈনন্দিন সাংসারিক জীবন তথা প্রকৃতির মৌল পাঠশালায় কবিতার বিস্তর উপাদানে ভরপূর।

ছন্দ অনুধাবন করতে কবিতা ও গান বিশেষতঃ কবিতার পদ বিন্যাসের রীতিতে গতিময়তা থাকে যেটা বোঝা প্রয়োজন---এটা অত্যন্ত জরুরী। ছন্দের প্রত্যক্ষ  আবেদন শ্রুতির ওপর; এক্ষেত্রে কানের ভুমিকা অপরিসীম।

আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবকিছুতেই ছন্দের প্রবাহ রয়েছ। চপলা কিশোরীর বেণীতে, রমণীর টানা কিংবা এলো খোঁপা, উঠোন ঝাড় দেয়া, গোবর দিয়ে চুলা লেপা, স্বাস্থ্য সচেতন অতি বৃদ্ধর প্রাত্যাহিক প্রাতঃ ভ্রমন কিংবা মায়ের দুমুঠো ভাত বা আরেকটুকরো মাছ পাতে তুলে দেয়ার মাঝেও ছন্দের প্রবাহ বিদ্যমান।

ছন্দের সংজ্ঞাঃ
ভাষাবিজ্ঞানী ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,’’বাক্যস্থিত অথবা বাক্যাংশস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটা শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে একটা কাম্যগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয় পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতি কে ছন্দ (বা ছন্দঃ) বলে

‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌৯০ দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি- প্রাবন্ধিক হাসানআল আব্দুল্লাহ বলেন ’.......ভাষায় রুপ দেয়ার জন্যে দরকার শব্দ। বিষয় ও শব্দের মেল বন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইট তৈরীর পূর্বের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হল ছন্দ ।’

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ সভা থেকে সিদ্ধাচার্যের যে খন্ডিত পুথি আবিষ্কার করেছিলেন তা ’চর্যাপদ বা চর্যাগীতি’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে এবং পন্ডিতেরা মোটামুটি ভাবে একমত ভাবে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এগুলোর রচনাকাল মোটামুটি ভাবে ৮ম থেকে ১০ম শতাব্দীকাল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে ছন্দশাস্ত্রের চর্চা শুরু হয় রবীন্দ্রযুগ থেকে। বাংলা ছন্দের চর্চা, পরীক্ষা-নীরিক্ষা,অনুশীলন ও পরিপক্কতা পেয়েছে মুলত: আধুনিক ত্রিশ দশকের কবিদের হাতে। তারপর গত ৮০ বছরে ছন্দ ও ছন্দ শাস্ত্র বিষয়ক গবেষণালব্ধ বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ হাসানআল আব্দুল্লাহ এর গবেষনা লব্ধ বই কবিতার ছন্দ’ প্রকাশ করেছিল। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে হাসালআল আব্দুল্লাহ সম্পর্কিত বিখ্যাত দেশী ওবিদেশী লেখক-কবিদের মন্তব্য উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা ।
শামসুর রাহমানঃ তিনি [হাসানআল আব্দুল্লাহ] কবিতার ব্যাপারে এত নিবেদিত, এত নিষ্ঠাবান যে প্রত্যেক কবির,প্রত্যেক সমালেচকেরই তার এই গুণটির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ আছে ।

জ্যোতির্ময় দত্তঃ হাসানআল আব্দুল্লাহ বাংলার ভুমিজ এক নূতন শক্তি... একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চাষী যেমন পাথর ও আগাছা অগ্রাহ্য করে বলদের লেজ মুচড়ে লাঙল চালান, আব্দুল্লাহ-র কলম তেমনি অপ্রতিরোধ্য.....কখনো বন্ধুর,কখনো সমতল, কিন্তু সর্বদাই গতিময়,দুর্বার,প্রবল শক্তির দ্বারা চালিত। আমি জানিনা, তাঁর প্রজন্মে আর কেউ আছেন কিনা, এমন ধাপে ধাপে সচেতন ভাবে যিনি কবিতার শৃঙ্গ আরোহণ করছেন।

আল মাহমুদঃ হাসানআল আব্দুল্লাহ আমার কবিতারও তীব্র সমালোচক। আমি এই সমালোচনার সব সময় মুল্য দিয়ে এসেছি... আমেরিকার কবিদের সংস্পর্শে তাঁর মধ্যে একটা জগত বাস্তবতার স্বরুপ প্রত্যক্ষ করার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এটা আমাদের কবিতাকে সাহায্য করবে।

শহীদ কাদরীঃ বাংলা ছন্দের সাথে সপ্রাণ পরিচয়ে হাসানআল আব্দুল্লাহর কবিতার ছন্দর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন গ্রন্থ আমার পড়া নেই। ... এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে সাম্প্রতিককালে কবিতাকে যারা ঐশ্বর্যবান করে তুলেছেন হাসানআল আব্দুল্লাহ তাদের অন্যতম।

বেলাল বেগঃ বিশ্ব বাজারে কবি ও কবিতার বিভিন্ন ফোরামে হাসানআল নিজের ও অন্যান্য বাঙালী কবির কবিতা ফেরী করেন।

Stanley H.Barkan: Hassanal Abdullah is my introduction to the land and people of Bangladesh ,to the poetry of Tagore and Nazrul, of which he is a consiserable continuation.

Nicholas Birns : … this volume, Breath of Bengal fo Bengal, reveals his considerable strengths as poet. Abdullah at once manages to maintain a Romantic confidence in the imagination a modernist irony as to the imagination`s limits, and a postmodern sense of the imagination as construct.

কবিতার ছন্দ’ বইটির প্রথম সংস্করন শেষ হবার পর বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ পাঠকের অনুরোধ উপেক্ষা করে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয় নি। সম্প্রতি মাওলা ব্রাদার্স বইমেলা উপলক্ষে কবিতার ছন্দ’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে বিপুল পরিমান পাঠকের চাহিদা পূরণ করেছে।
   বইটিতে দশটি পরিচ্ছেদে ছন্দ সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়াবলীই পুংখানুপু:খভাবে স্থান পেয়েছে। যেমনঃ কবিতা বিষয়ক কিছু প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা’য় অক্ষর,মাত্রা,যতি ও ছেদ,পর্ব,পর্বাঙ্গ,চরণ,পঙক্তি ও লয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা ও উদাহরণসহ সহজ,সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় আলোচনা করেছেনঃ শব্দ যদি ফুল হয় অক্ষর তার পাপড়ি। ধরা যাক ভালবাসা শব্দটির কথা। এটি চারটি অক্ষর বা ধ্বনি সমন্বয়ে গঠিত,ভা,ল,বা এবং সা।ভালবাসা নামের এই ফুলের চারটি পাপড়ি।
কবিতার কথাঃ তিন প্রাকর ছন্দ পরিচ্ছেদের উল্লেখ করেছেন স্বর,বদ্ধস্বর,মুক্তস্বর,মাত্রা,পর্ব,উপপর্ব,অতিপর্ব,স্বরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত,মুক্ত বা নঞ ছন্দ বিষয়ক আলোচনায় উঠে এসেছে বদ্ধস্বরও মুক্তস্বরের সহজ-সরল সংজ্ঞায়িত উদাহরণ।যেমন যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বলা হয়। যেমন কর,ধর,হয়,পাক,থাক,দিন,বীন ইত্যাদি।
যে সব ধ্বনি উচ্চরনের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বলে।যেমন: হা,না,কা,চা,দি ইত্যাদি।

পর্ব,অতিপর্ব,উপপর্ব এবং স্বরবৃত্ত ছ্ন্দঃ
   কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হল পর্ব। পঙক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপবৃ বলা হয় যার মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাগা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমারা তাকে উপপর্ব বলে চিহ্নিত করবো।
   উপরে প্রদত্ত উদাহরণের ছন্দ বিন্যাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই।
যদি কবিতাটি সম্পুর্ণ কারার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্ধিত লাইনেও উপরের লাইনগুলির সমান সংখ্যক পর্ব একই মাত্রায় রাখতে হবে, এবং অতিপর্বেও উপরের লাইন অনুসারে তিন মাত্রা থাকবে। যেমন,
   মামার বাড়ি আর যাব না আর খাবো না মামীর গাল,
   কথায় কথায় আমার পিঠে পড়বে না আর অমন তাল।
   সকাল বেলা জেগে আমি তাই তো গেলাম মায়ের ঘর,
   ভায়ের বাড়ি যাওগে একা, আমার গায়ে ভীষণ জ্বর।’’
তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাড়াবে:
                                   (হাসানআল আব্দুল্লাহ)
৪+৪+৪+৩
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ মাত্রাবৃত্তের ক্রিয়াকলাপ অনেকটা স্বরবৃত্তের মতো হলেও এই ছন্দে বদ্ধস্বর দুমাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর একমাত্রা বহন করতে পারে না । কিন্তু স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরের মাত্রা এক।যেমন:
কবি বন্ধুরা/হতাশ হইয়া/মোর লেখা পড়ে/শ্বাস ফেলে
বলে কেজো ক্রমে/হচ্ছে অকেজো/পলিটিক্সের/পাশ ঠেলে
              (আমার কৈফিয়ত/কাজী নজরুল ইসলাম)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দঃ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো একমাত্রা এবং কখনো দুই মাত্রা বহন করে।যেমন:
হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে/নিশীথের অন্ধকারে/মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;/বিম্বিসার অশোকের/ ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/আরো দুর অন্ধকারে/বিদর্ভ নগরে;
                 (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ)
এখানে কাঠামো ৮+৮+৬।
   তিন প্রকার ছন্দের ভাঙাচোরা পরিচ্ছেদে লেখক এখানে আধুনিক কালের কবিরা যে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ভাঙাচোরা করেছেন কিংবা বলা যায় এদের ব্যবহারে বেশ খানিকটা উদার হয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন।আমি আর এ বিষয়ে কিছু লেখলাম না।
মধ্যযুগের পয়ার ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ পরিচ্ছেদে লেখক বিশদভাবে বিশ্লেষন করেছেন পয়ার ও অমিত্রক্ষর ছন্দের। আমি একটি উদাহরণ করছি:
সুন্দর দেখিয়া গবী/কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী/দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে, এই/বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশ জন্ম/জননী সুরভী।।
              (মহাভারত/কাশীদাসী)
কবিতার মিল পরিচ্ছেদে কবি খুটিয়ে আলোচনা করেছন এবং চিরায়ত প্রথানুযায়ী উদাহরণ  দিয়েছেন যেমনঃ
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পখে 
করিল ডিক্রি সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে
                            (দই বিঘা জমি/রবীন্দ্র নাখ ঠাকুর)
   উপমা অনুপ্রাস ও চিত্রকল্প পরিচ্ছেদে লেখক অত্যন্ত
দুঃসাহস ওনিঃসংকোচে মুখ্য কবিদের সাথে সতীর্থ এ সম-সাময়িক নবীন কবিদের তুলে এনেছেন পাঠকের সামনে,এমন কি নিজের কবিতাও।
উপমাঃদুটি ভিন্ন ধরণের বস্তু,পদার্থ বা বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দেখানোর নামই উপমা।
উদাহরণ ০১.
শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা আসে
            (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ)
উদাহরণ ০৪.
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিলো এই
ভোরকে পাওয়ার
              (তার শয্যার পাশে/শামসুর রাহমান)
উদাহরণ ০৫.
মনে হলো য়েনো নদী নয় এতো সর্প
কেনো মনে হলো পানি নয় এ যে রক্ত
                  (ফেরার সঙ্গী/আল মাহমুদ)

উদাহরন ০৬.
আজকে তাই তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ
তীক্ষ্মহিম ছরির মতো বিধলো যেন বুকে
             (গোলাপের অনুষঙ্গ/ শহীদ কাদরী)
উদাহরন ০৯.
ঠিক সনেটের মতো রুপ, আদলেও সে সনেট
                  (সনেটের বউ/বায়তুল্লাহ কাদেরী)
      
অনুপ্রাসঃ কবিতার মধ্যে একই অক্ষর বা ধ্বনির বার বার ব্যবহারের কারণে যে ধ্বনি সাম্যের সৃষ্টি হয় তাকে অনুপ্রাস বলে।যেমন:
শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভুই আর সবই গেছে ঋণে
বাবু বলিলেন,বুঝেছ উপেন? এ জমি লইবো কিনে।
এখানে দুই-এর সাথে ভুই-এর এবং বলিলেন-এর সাথে উপেন মধ্যমিল বা মধ্যানুপ্রাস রূপে এসেছে। অন্যদিকে ঋণে-এর সাথে কিনে-এর মিল অন্ত্যানপ্রাস বা অন্তমিল হিসেবে কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।কিংবা

নামলো সন্ধ্যা সঙ্গে অপ্রসন্ন বিদ্যু ....      
           (বৃষ্টি,বৃষ্টি/শহীদ কাদরী)
এবং ন্ন অনুপ্রাস সুন্দর বৃত্ত তৈরী করেছে। অখবা
কোটাল পিটায় কপাল নিজের কোথা কোটালের বান।
                (মফস্বলে/বিষ্ণু দে)
এখানে -এর অনুপ্রাস ফিরে ফিরে আসে।কিংবা আবার দেখিঃ
ধীরে ধীরে আস্তে ধীরে সময়ের সুষম বিন্যাস 
ছুড়ে ফেলি  অনর্জিত অনড় অর্থব আস্তাকুড়ে...
(ত্রিবেনী সঙ্গম থেকে আটলান্টিক/নাজনীন সীমন)
প্রথম লাইনে ও দ্বিতীয় লাইনে -এর কবিতাকে বেগবান করে তুলেছে ।
চিত্রকল্পঃ
বাস্তব ও পরা বাস্তবের সংমিশ্রনে কবির সুনিপুণ বর্ণনায় চোখের পাতায় কোনো বস্তু বা বিষয়ের যে চিত্র ফুটে উঠে তাকে চিত্রকল্প বলে।যেমনঃ
যে নদীতে ভাসতো রাজহাসঁ সেখানে ভাসছে
শুধু নিরীহ বাঙালীর লাশ
           (খোকনের সানগ্লাস/হুমাযুন আজাদ)
রাজহাসেঁর স্থলে বাঙালীর লাশ। একাত্তরের পটভুমিতে খোকনের সানগ্লাস দেখে এই বিভ স চিত্র । অথবা
অনন্ত ঘুমের মধে নেছে উঠছ একটি দোয়েল
সাংগীতিক,আজওযত প্রহরার রক্তচক্ষু চিরে
বিপন্ন তাকিযে দেখি, আংঙুলের চঞ্চলতাগুলি....
            (মুখপত্র/রহমান হেনরী)
একটি দোয়েল এ আঙুলগুচ্ছের চিত্র অনন্ত ঘুমের মধ্যে যৌবনের থই থই উম্মাদনা জাগিয়ে তোলে।কিংবা

এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আধাঁরে
যেনো তার জানারার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনে এক নিস্তব্ধাতা এসে।
       (আট বছর আগের একদিন/জীবনানন্দ দাশ)
এক দিকে যেমন উপমা অন্য দিকে চাঁদ ডোবার পরে এক চমকার চিত্রকল্প তৈরী করে নিস্তব্ধাতা আসে উটের গ্রীবার মতো কারো জানালার ধারে। চাঁদ ডুবে চলে যাওয়া, অদ্ভুত আঁধার, জানালার ধারে, উটের গ্রীবা ও নিস্তব্ধতা সবগুলো
উপাদানই যেনো আলাদা চিত্রকল্পত তৈরী করছে ।
সনেটঃ সনেট সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশী পরিচিত। বিশেষভাবে রচিত চৌদ্দ লাইনের বিশেষ এক ধরনের কবিতাকে সনেট বলে। এই পরিচ্ছেদে পেত্রাকান ও  শেক্সপীয়রীয়ান সনেট ও কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ উদ্ভাবিত স্বতন্ত্রধারার সনেটীয় ছন্দের অন্ত্যঃমিল,ছন্দের ব্যবহার ও সনেট লেখার নিয়মও বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
কবিতার ছন্দ বইটিতে বাংলা ছন্দের বিকাশ পরিচ্ছেদে  সুনিপুন ভাবে আলোচনা করেছেন বাংলা ছন্দের আদিপর্ব,মধ্যযুগীয় পর্ব,ক্ল্যাসিক্যাল পর্ব, রোমান্টিক পর্ব, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্বের ছন্দের ব্যবহার।
বাংলা কবিতার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে প্রায়শ:ই হোঁচট খেতে হয় কারণ আমাদের অধিকাংশ অনুবাদকই ইংরেজি ছন্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত নন। অথচ স্প্যানিশ,জার্মান,পোলিশ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত কবিতায় অনুবাদকের ছন্দজ্ঞানের নিপুণতা দেখে। বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় অনেক সময় অনুবাদ উল্লেখ না থাকলে কবিতটি ইংরেজি বলে ভ্রম হবার সম্ভবনা থাকে। হাসানআল আব্দুল্লাহ ইংরেজি কবিতার ছন্দ পরিচ্ছেদে ইংরেজি কবিতার চার প্রকার ছন্দের যথা;
১.Iambic (আয়াম্বিক)
২.Trochaic (ট্রকাইক)
৩.Anapestic ( অ্যানাপেস্টিক)
৪. Dactylic(ডেকটাইলিক)
Iambic:
       যে ছন্দে একটি weak syllable-এর পরে একটি strong syllable বসে foot বা পর্ব গঠন করে তাকে Iambic ছন্দ্ বলে। যেমনঃ
Come live with me and be my love,
And we will all the pleasure prove
( The Passionate Shepherd to his love/Christopher Marlowe)
                    
                       
Trochaic: Iambic-এর বিপরীত প্রকৃতির ছন্দ এটি। অথা  একটি strong syllable-এর পরে একটি weak syllable বসে ট্রকাইক ছন্দের  পর্ব বা foot গঠন করে। যেমনঃ
Tyger!Tyger!burning bright
In the forests of the night.
What immortal hand or eye….
               (The Tyger/William Blake)

Anapestic: পর পর দুটি weak syllable এর সাথে একটি strong syllable বসে Anapestic ছন্দের foot গঠন করে।যথা;
My soul is awakened.my spirit is soaring
And carried aloft on the wings of the breeze;
For.above and around me.the wild wind is roaring
Arousing to rapture the earth and the seas.


Dactylic: এই ছন্দ Anapestic এর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির।উদাহরণঃ
Horse sense would tell them his
Anthropomorphical
Form was the same as a
Yahoo physique

বাংলা ভাষায় ছন্দ বিষয়ক এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বই।এটি সাধারন শিক্ষার্থী, গবেষক ও অনুবাদক সহ সকলেরেই প্রভূত উপকারে আসবে।
কাইয়ুম চৌধূরী দৃষ্টিনন্দন আঁকা প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছেন মাওলা ব্রাদার্স। বইটির মূল্য একশত পঁচাত্তর টাকা।

         

          
                      


হাসানআল আব্দুল্লাহর ‌কবিতার ছন্দ : একটি পর্যালোচনা।/রবিউল মানিক

সংস্কুত শব্দ ছন্দঃ(স)থেকে ছন্দ শব্দটি এছেসে। এর আভিধানিক শব্দ  বেদ। চন্দ কবিতা রচনার একটি শিল্প সুষমামান্ডিত গঠণ কৌশল। ছন্দকে কবিতার ছাঁদ নামেও অভিহিত করেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতার সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক অপরিহার্য়্য ও অবিচ্ছেদ্য। কবিতায় মিল থাকুক বা নাথাকুক ছন্দের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।কবিত একটি অপার্থিব বস্থু। কিন্ত তাকে আয়ত্তে আনার জন্য বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-নির্জনে তপস্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদদের দৈনন্দিন সাংসারিক জীবন তথা প্রকৃতির মৌল পাঠশালায় কবিতার বিস্তর উপাদানে ভরপূর।

ছন্দ অনুধাবন করতে কবিতা ও গান বিশেষতঃ কবিতার পদ বিন্যাসের রীতিতে গতিময়তা থাকে যেটা বোঝা প্রয়োজন---এটা অত্যন্ত জরুরী। ছন্দের প্রত্যক্ষ  আবেদন শ্রুতির ওপর; এক্ষেত্রে কানের ভুমিকা অপরিসীম।

আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবকিছুতেই ছন্দের প্রবাহ রয়েছ। চপলা কিশোরীর বেণীতে, রমণীর টানা কিংবা এলো খোঁপা, উঠোন ঝাড় দেয়া, গোবর দিয়ে চুলা লেপা, স্বাস্থ্য সচেতন অতি বৃদ্ধর প্রাত্যাহিক প্রাতঃ ভ্রমন কিংবা মায়ের দুমুঠো ভাত বা আরেকটুকরো মাছ পাতে তুলে দেয়ার মাঝেও ছন্দের প্রবাহ বিদ্যমান।

ছন্দের সংজ্ঞাঃ
ভাষাবিজ্ঞানী ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,’’বাক্যস্থিত অথবা বাক্যাংশস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটা শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে একটা কাম্যগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয় পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতি কে ছন্দ (বা ছন্দঃ) বলে

‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌৯০ দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি- প্রাবন্ধিক হাসানআল আব্দুল্লাহ বলেন ’.......ভাষায় রুপ দেয়ার জন্যে দরকার শব্দ। বিষয় ও শব্দের মেল বন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইট তৈরীর পূর্বের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হল ছন্দ ।’

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ সভা থেকে সিদ্ধাচার্যের যে খন্ডিত পুথি আবিষ্কার করেছিলেন তা ’চর্যাপদ বা চর্যাগীতি’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে এবং পন্ডিতেরা মোটামুটি ভাবে একমত ভাবে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এগুলোর রচনাকাল মোটামুটি ভাবে ৮ম থেকে ১০ম শতাব্দীকাল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে ছন্দশাস্ত্রের চর্চা শুরু হয় রবীন্দ্রযুগ থেকে। বাংলা ছন্দের চর্চা, পরীক্ষা-নীরিক্ষা,অনুশীলন ও পরিপক্কতা পেয়েছে মুলত: আধুনিক ত্রিশ দশকের কবিদের হাতে। তারপর গত ৮০ বছরে ছন্দ ও ছন্দ শাস্ত্র বিষয়ক গবেষণালব্ধ বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ হাসানআল আব্দুল্লাহ এর গবেষনা লব্ধ বই কবিতার ছন্দ’ প্রকাশ করেছিল। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে হাসালআল আব্দুল্লাহ সম্পর্কিত বিখ্যাত দেশী ওবিদেশী লেখক-কবিদের মন্তব্য উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা ।
শামসুর রাহমানঃ তিনি [হাসানআল আব্দুল্লাহ] কবিতার ব্যাপারে এত নিবেদিত, এত নিষ্ঠাবান যে প্রত্যেক কবির,প্রত্যেক সমালেচকেরই তার এই গুণটির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ আছে ।

জ্যোতির্ময় দত্তঃ হাসানআল আব্দুল্লাহ বাংলার ভুমিজ এক নূতন শক্তি... একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চাষী যেমন পাথর ও আগাছা অগ্রাহ্য করে বলদের লেজ মুচড়ে লাঙল চালান, আব্দুল্লাহ-র কলম তেমনি অপ্রতিরোধ্য.....কখনো বন্ধুর,কখনো সমতল, কিন্তু সর্বদাই গতিময়,দুর্বার,প্রবল শক্তির দ্বারা চালিত। আমি জানিনা, তাঁর প্রজন্মে আর কেউ আছেন কিনা, এমন ধাপে ধাপে সচেতন ভাবে যিনি কবিতার শৃঙ্গ আরোহণ করছেন।

আল মাহমুদঃ হাসানআল আব্দুল্লাহ আমার কবিতারও তীব্র সমালোচক। আমি এই সমালোচনার সব সময় মুল্য দিয়ে এসেছি... আমেরিকার কবিদের সংস্পর্শে তাঁর মধ্যে একটা জগত বাস্তবতার স্বরুপ প্রত্যক্ষ করার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এটা আমাদের কবিতাকে সাহায্য করবে।

শহীদ কাদরীঃ বাংলা ছন্দের সাথে সপ্রাণ পরিচয়ে হাসানআল আব্দুল্লাহর কবিতার ছন্দর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন গ্রন্থ আমার পড়া নেই। ... এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে সাম্প্রতিককালে কবিতাকে যারা ঐশ্বর্যবান করে তুলেছেন হাসানআল আব্দুল্লাহ তাদের অন্যতম।

বেলাল বেগঃ বিশ্ব বাজারে কবি ও কবিতার বিভিন্ন ফোরামে হাসানআল নিজের ও অন্যান্য বাঙালী কবির কবিতা ফেরী করেন।

Stanley H.Barkan: Hassanal Abdullah is my introduction to the land and people of Bangladesh ,to the poetry of Tagore and Nazrul, of which he is a consiserable continuation.

Nicholas Birns : … this volume, Breath of Bengal fo Bengal, reveals his considerable strengths as poet. Abdullah at once manages to maintain a Romantic confidence in the imagination a modernist irony as to the imagination`s limits, and a postmodern sense of the imagination as construct.

কবিতার ছন্দ’ বইটির প্রথম সংস্করন শেষ হবার পর বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ পাঠকের অনুরোধ উপেক্ষা করে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয় নি। সম্প্রতি মাওলা ব্রাদার্স বইমেলা উপলক্ষে কবিতার ছন্দ’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে বিপুল পরিমান পাঠকের চাহিদা পূরণ করেছে।
   বইটিতে দশটি পরিচ্ছেদে ছন্দ সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়াবলীই পুংখানুপু:খভাবে স্থান পেয়েছে। যেমনঃ কবিতা বিষয়ক কিছু প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা’য় অক্ষর,মাত্রা,যতি ও ছেদ,পর্ব,পর্বাঙ্গ,চরণ,পঙক্তি ও লয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা ও উদাহরণসহ সহজ,সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় আলোচনা করেছেনঃ শব্দ যদি ফুল হয় অক্ষর তার পাপড়ি। ধরা যাক ভালবাসা শব্দটির কথা। এটি চারটি অক্ষর বা ধ্বনি সমন্বয়ে গঠিত,ভা,ল,বা এবং সা।ভালবাসা নামের এই ফুলের চারটি পাপড়ি।
কবিতার কথাঃ তিন প্রাকর ছন্দ পরিচ্ছেদের উল্লেখ করেছেন স্বর,বদ্ধস্বর,মুক্তস্বর,মাত্রা,পর্ব,উপপর্ব,অতিপর্ব,স্বরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত,মুক্ত বা নঞ ছন্দ বিষয়ক আলোচনায় উঠে এসেছে বদ্ধস্বরও মুক্তস্বরের সহজ-সরল সংজ্ঞায়িত উদাহরণ।যেমন যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বলা হয়। যেমন কর,ধর,হয়,পাক,থাক,দিন,বীন ইত্যাদি।
যে সব ধ্বনি উচ্চরনের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বলে।যেমন: হা,না,কা,চা,দি ইত্যাদি।

পর্ব,অতিপর্ব,উপপর্ব এবং স্বরবৃত্ত ছ্ন্দঃ
   কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হল পর্ব। পঙক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপবৃ বলা হয় যার মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাগা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমারা তাকে উপপর্ব বলে চিহ্নিত করবো।
   উপরে প্রদত্ত উদাহরণের ছন্দ বিন্যাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই।
যদি কবিতাটি সম্পুর্ণ কারার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্ধিত লাইনেও উপরের লাইনগুলির সমান সংখ্যক পর্ব একই মাত্রায় রাখতে হবে, এবং অতিপর্বেও উপরের লাইন অনুসারে তিন মাত্রা থাকবে। যেমন,
   মামার বাড়ি আর যাব না আর খাবো না মামীর গাল,
   কথায় কথায় আমার পিঠে পড়বে না আর অমন তাল।
   সকাল বেলা জেগে আমি তাই তো গেলাম মায়ের ঘর,
   ভায়ের বাড়ি যাওগে একা, আমার গায়ে ভীষণ জ্বর।’’
তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাড়াবে:
                                   (হাসানআল আব্দুল্লাহ)
৪+৪+৪+৩
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ মাত্রাবৃত্তের ক্রিয়াকলাপ অনেকটা স্বরবৃত্তের মতো হলেও এই ছন্দে বদ্ধস্বর দুমাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর একমাত্রা বহন করতে পারে না । কিন্তু স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরের মাত্রা এক।যেমন:
কবি বন্ধুরা/হতাশ হইয়া/মোর লেখা পড়ে/শ্বাস ফেলে
বলে কেজো ক্রমে/হচ্ছে অকেজো/পলিটিক্সের/পাশ ঠেলে
              (আমার কৈফিয়ত/কাজী নজরুল ইসলাম)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দঃ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো একমাত্রা এবং কখনো দুই মাত্রা বহন করে।যেমন:
হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে/নিশীথের অন্ধকারে/মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;/বিম্বিসার অশোকের/ ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/আরো দুর অন্ধকারে/বিদর্ভ নগরে;
                 (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ)
এখানে কাঠামো ৮+৮+৬।
   তিন প্রকার ছন্দের ভাঙাচোরা পরিচ্ছেদে লেখক এখানে আধুনিক কালের কবিরা যে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ভাঙাচোরা করেছেন কিংবা বলা যায় এদের ব্যবহারে বেশ খানিকটা উদার হয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন।আমি আর এ বিষয়ে কিছু লেখলাম না।
মধ্যযুগের পয়ার ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ পরিচ্ছেদে লেখক বিশদভাবে বিশ্লেষন করেছেন পয়ার ও অমিত্রক্ষর ছন্দের। আমি একটি উদাহরণ করছি:
সুন্দর দেখিয়া গবী/কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী/দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে, এই/বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশ জন্ম/জননী সুরভী।।
              (মহাভারত/কাশীদাসী)
কবিতার মিল পরিচ্ছেদে কবি খুটিয়ে আলোচনা করেছন এবং চিরায়ত প্রথানুযায়ী উদাহরণ  দিয়েছেন যেমনঃ
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পখে 
করিল ডিক্রি সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে
                            (দই বিঘা জমি/রবীন্দ্র নাখ ঠাকুর)
   উপমা অনুপ্রাস ও চিত্রকল্প পরিচ্ছেদে লেখক অত্যন্ত
দুঃসাহস ওনিঃসংকোচে মুখ্য কবিদের সাথে সতীর্থ এ সম-সাময়িক নবীন কবিদের তুলে এনেছেন পাঠকের সামনে,এমন কি নিজের কবিতাও।
উপমাঃদুটি ভিন্ন ধরণের বস্তু,পদার্থ বা বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দেখানোর নামই উপমা।
উদাহরণ ০১.
শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা আসে
            (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ)
উদাহরণ ০৪.
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিলো এই
ভোরকে পাওয়ার
              (তার শয্যার পাশে/শামসুর রাহমান)
উদাহরণ ০৫.
মনে হলো য়েনো নদী নয় এতো সর্প
কেনো মনে হলো পানি নয় এ যে রক্ত
                  (ফেরার সঙ্গী/আল মাহমুদ)

উদাহরন ০৬.
আজকে তাই তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ
তীক্ষ্মহিম ছরির মতো বিধলো যেন বুকে
             (গোলাপের অনুষঙ্গ/ শহীদ কাদরী)
উদাহরন ০৯.
ঠিক সনেটের মতো রুপ, আদলেও সে সনেট
                  (সনেটের বউ/বায়তুল্লাহ কাদেরী)
      
অনুপ্রাসঃ কবিতার মধ্যে একই অক্ষর বা ধ্বনির বার বার ব্যবহারের কারণে যে ধ্বনি সাম্যের সৃষ্টি হয় তাকে অনুপ্রাস বলে।যেমন:
শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভুই আর সবই গেছে ঋণে
বাবু বলিলেন,বুঝেছ উপেন? এ জমি লইবো কিনে।
এখানে দুই-এর সাথে ভুই-এর এবং বলিলেন-এর সাথে উপেন মধ্যমিল বা মধ্যানুপ্রাস রূপে এসেছে। অন্যদিকে ঋণে-এর সাথে কিনে-এর মিল অন্ত্যানপ্রাস বা অন্তমিল হিসেবে কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।কিংবা

নামলো সন্ধ্যা সঙ্গে অপ্রসন্ন বিদ্যু ....      
           (বৃষ্টি,বৃষ্টি/শহীদ কাদরী)
এবং ন্ন অনুপ্রাস সুন্দর বৃত্ত তৈরী করেছে। অখবা
কোটাল পিটায় কপাল নিজের কোথা কোটালের বান।
                (মফস্বলে/বিষ্ণু দে)
এখানে -এর অনুপ্রাস ফিরে ফিরে আসে।কিংবা আবার দেখিঃ
ধীরে ধীরে আস্তে ধীরে সময়ের সুষম বিন্যাস 
ছুড়ে ফেলি  অনর্জিত অনড় অর্থব আস্তাকুড়ে...
(ত্রিবেনী সঙ্গম থেকে আটলান্টিক/নাজনীন সীমন)
প্রথম লাইনে ও দ্বিতীয় লাইনে -এর কবিতাকে বেগবান করে তুলেছে ।
চিত্রকল্পঃ
বাস্তব ও পরা বাস্তবের সংমিশ্রনে কবির সুনিপুণ বর্ণনায় চোখের পাতায় কোনো বস্তু বা বিষয়ের যে চিত্র ফুটে উঠে তাকে চিত্রকল্প বলে।যেমনঃ
যে নদীতে ভাসতো রাজহাসঁ সেখানে ভাসছে
শুধু নিরীহ বাঙালীর লাশ
           (খোকনের সানগ্লাস/হুমাযুন আজাদ)
রাজহাসেঁর স্থলে বাঙালীর লাশ। একাত্তরের পটভুমিতে খোকনের সানগ্লাস দেখে এই বিভ স চিত্র । অথবা
অনন্ত ঘুমের মধে নেছে উঠছ একটি দোয়েল
সাংগীতিক,আজওযত প্রহরার রক্তচক্ষু চিরে
বিপন্ন তাকিযে দেখি, আংঙুলের চঞ্চলতাগুলি....
            (মুখপত্র/রহমান হেনরী)
একটি দোয়েল এ আঙুলগুচ্ছের চিত্র অনন্ত ঘুমের মধ্যে যৌবনের থই থই উম্মাদনা জাগিয়ে তোলে।কিংবা

এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আধাঁরে
যেনো তার জানারার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনে এক নিস্তব্ধাতা এসে।
       (আট বছর আগের একদিন/জীবনানন্দ দাশ)
এক দিকে যেমন উপমা অন্য দিকে চাঁদ ডোবার পরে এক চমকার চিত্রকল্প তৈরী করে নিস্তব্ধাতা আসে উটের গ্রীবার মতো কারো জানালার ধারে। চাঁদ ডুবে চলে যাওয়া, অদ্ভুত আঁধার, জানালার ধারে, উটের গ্রীবা ও নিস্তব্ধতা সবগুলো
উপাদানই যেনো আলাদা চিত্রকল্পত তৈরী করছে ।
সনেটঃ সনেট সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশী পরিচিত। বিশেষভাবে রচিত চৌদ্দ লাইনের বিশেষ এক ধরনের কবিতাকে সনেট বলে। এই পরিচ্ছেদে পেত্রাকান ও  শেক্সপীয়রীয়ান সনেট ও কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ উদ্ভাবিত স্বতন্ত্রধারার সনেটীয় ছন্দের অন্ত্যঃমিল,ছন্দের ব্যবহার ও সনেট লেখার নিয়মও বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
কবিতার ছন্দ বইটিতে বাংলা ছন্দের বিকাশ পরিচ্ছেদে  সুনিপুন ভাবে আলোচনা করেছেন বাংলা ছন্দের আদিপর্ব,মধ্যযুগীয় পর্ব,ক্ল্যাসিক্যাল পর্ব, রোমান্টিক পর্ব, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্বের ছন্দের ব্যবহার।
বাংলা কবিতার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে প্রায়শ:ই হোঁচট খেতে হয় কারণ আমাদের অধিকাংশ অনুবাদকই ইংরেজি ছন্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত নন। অথচ স্প্যানিশ,জার্মান,পোলিশ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত কবিতায় অনুবাদকের ছন্দজ্ঞানের নিপুণতা দেখে। বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় অনেক সময় অনুবাদ উল্লেখ না থাকলে কবিতটি ইংরেজি বলে ভ্রম হবার সম্ভবনা থাকে। হাসানআল আব্দুল্লাহ ইংরেজি কবিতার ছন্দ পরিচ্ছেদে ইংরেজি কবিতার চার প্রকার ছন্দের যথা;
১.Iambic (আয়াম্বিক)
২.Trochaic (ট্রকাইক)
৩.Anapestic ( অ্যানাপেস্টিক)
৪. Dactylic(ডেকটাইলিক)
Iambic:
       যে ছন্দে একটি weak syllable-এর পরে একটি strong syllable বসে foot বা পর্ব গঠন করে তাকে Iambic ছন্দ্ বলে। যেমনঃ
Come live with me and be my love,
And we will all the pleasure prove
( The Passionate Shepherd to his love/Christopher Marlowe)
                    
                       
Trochaic: Iambic-এর বিপরীত প্রকৃতির ছন্দ এটি। অথা  একটি strong syllable-এর পরে একটি weak syllable বসে ট্রকাইক ছন্দের  পর্ব বা foot গঠন করে। যেমনঃ
Tyger!Tyger!burning bright
In the forests of the night.
What immortal hand or eye….
               (The Tyger/William Blake)

Anapestic: পর পর দুটি weak syllable এর সাথে একটি strong syllable বসে Anapestic ছন্দের foot গঠন করে।যথা;
My soul is awakened.my spirit is soaring
And carried aloft on the wings of the breeze;
For.above and around me.the wild wind is roaring
Arousing to rapture the earth and the seas.


Dactylic: এই ছন্দ Anapestic এর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির।উদাহরণঃ
Horse sense would tell them his
Anthropomorphical
Form was the same as a
Yahoo physique

বাংলা ভাষায় ছন্দ বিষয়ক এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বই।এটি সাধারন শিক্ষার্থী, গবেষক ও অনুবাদক সহ সকলেরেই প্রভূত উপকারে আসবে।
কাইয়ুম চৌধূরী দৃষ্টিনন্দন আঁকা প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছেন মাওলা ব্রাদার্স। বইটির মূল্য একশত পঁচাত্তর টাকা।