Powered By Blogger

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

উত্তরাধুনিক বিতর্কঃপর্ব-১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় বিভৎসতা,হত্যাযজ্ঞে পৃথিবীর মানুষের মানবিক মূল্যবোধ,চিন্তা-চেতনার জগৎকে অল্ট-পালট করে তোলে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত পরিনাম,টেকনো সায়েন্সের ক্রম-বর্ধমান অগ্রগতি পাশ্চাত্যের সামাজিকতা এবং মানুষের চিন্তার জগৎকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেঃ কান্ট,হেগেল,মার্কসের মতোন দার্শনিকের জন্ম দেয়া জাতির মধ্যে কিভাবে অমানবিকতা,পাশবিক মনোবৃত্তি,ক্রোধ,নিষ্ঠুরতা কিভাবে লালন করে?টলস্টয়,চেখভের মতোন মানবতাবাদীর দেশে কিভাবে হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেল?লিংকনের আদর্শে গড়া মার্কিনীরা কেমন করে হিরোশিমা ও নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মানুষকে পরমাণু বোমায় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরে 'দি সোসিও লজিক্যাল ইমাজিনেশন' বইয়ে সি.রাইট মিল লেখেনঃযাকে আধুনিক যুগ বলা হয় তার শেষে মানুষ উপনীত হয়েছে।অনন্ত 'পোষ্ট মডার্ন' বা বাংলায় যা উত্তর আধুনিক বা উত্তরাধুনিকতা এর সামনে উপস্তিত আমরা। আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবোধ আর শৃঙ্খল্মুক্তি এতোদিন যে উদারতা আর সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে,আজ তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে অসওয়াল্ড স্পেংলার তাঁর ' দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট' বইয়ে লেখেন,পাশ্চাত্যের সভ্যতা আর তার মূল্যবোধ,দায়িত্ব এবং সংস্কৃতি দুর্গন্ধময় পচনে নিমজ্জিত।

এ রকম অস্থিতিশীল সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিস্তিতিতে উত্তরাধুনিকতার উদ্দীপক প্রতিভূ জঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার ' দি পোষ্ট মডার্ন' লিখে ঘোষণা করেন :মহা-আখ্যান ও পরা-আখ্যানের কাল শেষ।ওসব আখ্যানের বৈধতার প্রতিশ্রুতি লুপ্ত ও নির্বাপিত। উল্লেখ্য যে,এ মহা-আখ্যান/পরা-আখ্যান হলো কান্ট,হেগেল,মার্কসের দর্শন।

১৮৭০ সালে ওয়ট কিনস চ্যাপম্যান নামে এক চিত্রকর সর্বপ্রথম'পোষ্ট-মডার্নিজম' শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ফরাসী ইমপ্রেশনিস্ট চিত্র অপেক্ষা আরো আধুনিক,আরো অভাঁ-গার্দ ছবির ক্ষেত্রে এই অভিধা প্রয়োগ করেন। তারওপ্রে ১৯১৭ সালে এসে Rudolf Pannwitz একটি বইতে নিহিলিজম ও সে সময়কার ইউরোপে সব ম,ঊল্যবোধ ভেঙ্গে যাওয়ার বিবিরণ দিতে গিয়ে তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন।'পোষ্ট-মডার্নিজম' বা উত্তর- আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা নিয়ে পাশ্চাত্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে কম আলোচিত। এর উদ্ভব পাশ্চাত্যে এবং সেখানে এর পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। তার অনেক কিছুই আমাদের অজানা।উত্তরাধুনিকতা ধারণা নিয়ে পাশ্চাত্য জগতে বিতর্ক এখন যেমন তীব্র,তেমনি এর বৈশিষ্ট্য,আধুনিকতা,আধুনিকতাবাদের সাথে এর সম্পর্ক বিষয় নিয়েও মতবিরোধ বেশ বড় রকমের। এক একজন যুক্তিগ্রাহ্যভাবে একেক রকম্ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন।
আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদকে কেউ কেউ আধুনিকতাবাদের একধাপ অগ্রসর ভাবছেন।আবার কেউ কেউ আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদকে বিপরীত মেরুতে বসাচ্ছেন।আধুনিকতার সমালোচনা উত্তরাধুনিকতাতেই আছে-----এমোনও বলছেন কেউ কেউ। মার্কিন সাহিত্যতাত্ত্বিক ইহাব হাসান উত্তরাধুনিকতাকে হাজার ভিড় থেকে বেছে নিতে ছন্দ,অলংকার,ভাষা ও সাহিত্যতত্ত্ব,দর্শন,নৃ-বিজ্ঞান,মনোঃসমীক্ষা প্রভৃতি থেকে নূতন লক্ষঙুলোর সাথে তুলনা করে নিম্নোক্ত সারণি তৈরী করেছেনঃ

আধুনিকতাবাদ উত্তরাধুনিকতাবাদ

রোমান্টিসিজম/প্রতীকবাদ প্যাটাফিজিক্স/দাদাবাদ
ফর্ম ক্রীড়া
স্তরবিন্যাস নৈরাজ্য
পান্ডিত্য নিঃশেষ
শিল্পকান্ড/নিখুঁত প্রক্রিয়া/ঘটনা
উপস্তিতি অনুপস্তিতি
সৃজন/সমগ্রায়ন বিসৃজন/বিনির্মাণ
কেন্দ্রিকতা বিকেন্দীকতা
উৎপ্রেক্ষা অনুপ্রাস
নির্বাচন মিশ্রণ
মূল/গভীরতা অনুভূমিক কান্ড/অগভীর
পাঠকেন্দ্রিক লেখককেন্দ্রিক
আখ্যান আখ্যান বিরোধীতা
ধর্মপিতা পবিত্র আত্মা (ইত্যাদি)

(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন