Powered By Blogger

শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৪

আশ্লেষ জীর্ণ পৃথিবী

বুকের উপান্ত থেকে বের করো অস্থিরতা
ঝেড়ে ফেলো অশরীরী মূর্খতা শরীর থেকে
অভিসারের মুহূর্তে জয়চিহ্ন আঁকা ঠোঁটে
আমার আশ্লেষ জীর্ণ পৃথিবীকে দ্বি-খন্ডিত করে নাও

কোরকে কোরকে ঢেকে গেছে সমস্ত সবুজ ঘাস,ফুল ও সকাল
প্রসারিত বুকের ভেতর তিমিরের ফেনা ভেঙে
বিচলিত বাঁকে চঞ্চল খেয়ার নৌকা

বিপরীত জলে নাড়া দিলে ভেসে ওঠে বুকের আকাশ
পানাপুকুর,হরিতকির মাঠ,প্রাকৃতিক মন

চোখের প্রপাতে ডুবে যায় পৃথিবীর কিনার অবধি

অকাতরে ভেসে গিয়েছি সহজতর স্রোতে
মৃত্যুর প্রসন্ন মুখে ডান হাত ছুঁয়ে

এ তো ঠিক জন্ম নয়--ভুলে গেছি শেষ কবে সঙ্গমের আনন্দে মেতেছিলাম
আবর্ত পথের চারিদিকে উঠে আসছে লবণজল
আজ ও অতীত ধূয়ে মিশে যাবে দক্ষিণ সমুদ্রে

বিচ্ছিন্ন অথচ দেখো মেঘভারে করোটি কেমন ভরে আছে
সপ্তর্ষিসীমার থেকে শব্দেরা তাকিয়ে আছে স্তব্ধতার মধ্যে
কত ভুল,কত অপমানের ক্ষতের দিকে
শষ্পমূলের আদরে আজ তুমি আমার আশ্লেষ জীর্ণ পৃথিবীকে দ্বি-খন্ডিত করো
 

চতুর্দশপদী-৮

যারা জীবন দেখেনি তারা বলে,'এ শুধু প্রতীক।'
চিতার আগুন পাশে ফেলে স্বচ্ছন্দে নেমেছি জলে,
দুই কূল ভেঙে ভেঙে---সহজ সাঁতারে,অবিরাম
দিনে সূর্যপোড়া ছাই ঢেকেছিল সমস্ত আকাশে
ছত্রিশ ব্যঞ্জন আর স্বরধ্বনি।নিমগ্ন আবেশে
তামসীক সত্য ভুলে কাঁপালো অপরিচিত গ্রাম।
করোটি কংকালকীর্ণ,জীর্ণ সাপের খোলস ফেলে
রৌদ্র প্রতিহত পথে--অগ্নিমাতালেরও অধিক

নদীর স্রোতের মুখে শোনো,কালো শক্তির জরায়ু
সালাংকরা এ শরীরে ঢেউ,স্খালিত ডিম্বানু ফেটে
শরীরে আগুন জ্বলে।যে অরণ্যপথে মাঝে মাঝে
ঝলসে উঠত আভা,তোমার পায়ের খাঁজে খাঁজে
সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে অবিরল যদি বন কেটে
ঘর ছেড়ে নেমে আসে---লেখো জ্বরা,মৃত্যু,প্রেম আয়ু।

প্রশ্নাতুর জীবন

সূর্যপোড়া ছাই এসে লাগে মুখে
আমি দশদিক চোখ মেলে দেখিঃ
আবৃত পরিধি,--
পাষাণ পাপড়ি ঢেকে আছে সমস্ত বলয়
অগ্নিজোড়া ছড়ানো চত্বরে পাথরের পায়রারা খুঁটে তোলে লৌহবীজ
কালো অপশক্তির জরায়ু,
চোঁয়ানো রক্তের নীচে চাঁপা পড়ে আছে নিরন্ন পুরুষ
রক্ত ঠেলে ঠেল উঠে দাঁড়াচ্ছে,---বাজনা বাজে
অন্ধকার খানার তলায়

রেল লাইনের ধারে কাটা পড়ে আছে দু'টি দেহ,নারী ও পুরুষ
তাদের দু'হাত বাঁধা জড়িসুতো দিয়ে
এসব শুকনো মরা ভালোবাসা জঙ্গলে জঙ্গলে পড়ে আছে স্তুপের মতোন

বহুজনমুখর প্রান্তর থেকে আমার করোটি ভরে আসে
ধর্মের ভেতর বেজে ওঠা ধ্বনিপ্রতিধ্বনি
হিন্দু,মুসলিম,জৈন,পারসিক,ইহুদি,খ্রীষ্টান অস্তিত্বশীল স্বরবিক্ষেপে
অন্তর্গত অন্ধকারের ভেতর পরিশ্রান্ত ভাষার অনির্বাচিত শ্লোকে

প্রাত্যহিক দিনযাপনে জীবন ভরে দিতে চেয়েছি অথচ
অস্বচ্ছ দিনান্তে মেঘ থেকে ছিন্ন বৃষ্টি এবং ঝড় মহাশ্বেত ঘোষণার মতো
নীলান্তের এই শহরে ;যেখানে ঘর নেই কিন্তু ঘরের নৈরাশ্য আছে
আবিলতায় আচ্ছন্ন কৃষ্ণ চোখে প্রশ্নাতুর করে তোল জীবনকে

বসন্তের গান

ঘৃত প্রদীপের আলো থেকে উঠে আসে
মসলিন স্বপ্ন।শিখরে পাষাণ নিয়ে জেগে আছে
শ্মশান বন্ধুরা সব।জ্বলন্ত ভস্মের সরা হাতে ফিরে যাবে।
আজ রাতের বৃষ্টিতে ডুবে যাবে অরণ্যের সব গাছ,নদী,জলাশয়।
ঘুমের ভেতর গত বর্ষায় যে সব মানুষেরা ভেসে গিয়েছিল দক্ষিণ সমুদ্রে,
হাঁটুজল ভেঙে সেই পথে এইবার বসন্ত আসবে,স্বচ্ছতায় নীল।
গত বর্ষাপথে যে গহ্বর রেখে গিয়েছিল-রক্তে তা ভরেছে,
পাথরের মুখচ্ছবি নেই কিন্তু নিঃস্বপ্ন প্রতিমা?
আজ দেখো,গেয়ে ওঠে বসন্তের গান।

বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

সমসত্ব তরল দ্রবণ

মগজের কোষে
মৃত জোনাক,তাতারপাখি
বাঁকা হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণায়
জলকলহের চিতায় চোঁয়ানো রক্ত,জ্বলে কাঠ
শুয়ে আছ শব হয়ে;--বিভ্রমের ভেতর এখন যেতে চাও
নীল সরোবরে-ট্রেন ছেড়ে গেছে,পেছনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ,কুন্ডলিত ধোঁয়া
আমাদের শান্তি নেই,নূতন কবিতা নেই,যৌন অতৃপ্তির বিছানায় রোজ শুনি
দাম্পত্য কলহ, মুখে স্তন চেঁপে ধরে একদিন সব দুধ টেনে নেব
কোনো কোনোদিন স্তবের মুহূর্ত ফেটে গেলে বেরে হয়ে আসে
মোহঋতু,লতার নিঃশ্বাসে শোনো নিঃস্বন রাতের
গহ্বর-ভেতরে ছদ্মঘুম ও কবর
সমসত্ব তরল দ্রবণে
কেমন মিশেছে

সৌরধূলো

বোন রে কোথায় তুই

তোর শরীরের ছাল খুবলে নিয়েছে জানোয়ার
তোর কুমারী স্তনের তাপে আগুন জ্বালিয়ে ওরা সারারাত মচ্ছবে নেচেছে
তোর রজঃস্রাব ওরা চেটে খেয়েছে ইন্দ্রের অমৃতের মতো

তারপর একে একে উঠে গেল সব পাহাড়ে ঝোলানো সরু সেতু দিয়ে
আর তুই অশুঁচি শরীর নিয়ে ডুবে গেলি যমুনার কালো জলে
জল তোকে নিল না,উগড়ে দিল বালুচরে
সাদা হাড়ের কংকাল ক্ষয়ে ক্ষয়ে অবশেষে সৌরধূলো হয়ে
আকাশের দিকে মিশে গেল

সেই থেকে
অরুন্ধতী নক্ষত্রের সাথে ভেসে ভেসে
পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকিস

শরাহত পৃথিবী

দিনে দিনে বুকের ওপর জমিয়েছি পাথর,অস্তুতি ঘট
সেই বুক ভেঙে আকাশের দিকে উড়ে গেছে রাজহংসী
তার ছড়ানো পালক পড়ে আছে,শূণ্য ঘর
জল,মাটি,উঠোন অবধি,গণনাঅতীত

মতিচ্ছন্ন মুখ ফুটে আছে চালচিত্র ভেঙ তার চিহ্ন
মুছে যায় নি---আগুন
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
যমুনার জলপলাশের সব কোরকের সমর্পণ সমুদ্রের দিকে
রক্তে মিশে যায় নীল বিষ

একেকজন প্রেমিক এসে শুয়ে থাকে জলে,--
দ্বিতীয় মৃত্যুর পূর্বকাল পর্য্যন্ত,যখন
মাথার ভেতর কাঁশবন জেগে ওঠে,শরাহত
পৃথিবীর নষ্ট হবার সমস্ত পথ খোলা রেখে
পাপ পূণ্য রৌদ্র ছায়া অন্ধকার বাঁয়ে রেখে
অনন্তকাল হাঁটছে,প্রেমিকেরা
বুকে--ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকা,সুখস্মৃতি

মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৪

কবিতার পাশে কবিতা,ছন্দের পাশে ছন্দ

আলস্যমথিত অন্ধকারে সমস্ত রাতের প্রেত নিয়ে জেগে আছে শালবন
কান পেতে শুনছি চিৎকার,হাঁকডাক
শেকড়,ব্যাথিত শিরা ছুঁয়ে দেখি উষ্ণ ধানক্ষেত অতল,উৎসার
পলির প্রসাদে ঢেকে আছে লাল মাটি

সাঁকো নেই,ভেঙে গেছে বহুদিন
শরীরের ছায়া ফেলে আজানুলম্বিত বটঝুরি ধরে
উঠে যাব মেঘের মন্ডনে
প্রতিভার মরাডালে ঝুলিয়ে কংকাল

নিচু হয়ে ছিলাম অপমানের ঘাত-প্রতিঘাতে
পায়ে শত্রু,সন্দেহ,কাঁকর
কাদামাখা জামা,পোড়াভাত,বিষাদ,কবিতা
বাড়ির কূয়োর মধ্যে বালতি নামিয়ে তুলে এনেছি শব্দের শব
কবি জীবনের মরুভূমিতে সমস্ত বেলা কেটে গেছে
মরুদ্যান খুঁজেছি,পাই নি
কবিতার পাশে কবিতা,ছন্দের পাশে ছন্দ আমার নিখোঁজ শব ঘিরেছিল
তোমরা ছিলে না

সাপের ফণা

তোমার দুধের গ্লাসে রক্ত।তরকারির বাটিতে,---
বাটি কই,ওটা তো করোটি।
মেলে আছে সাদা আত্মা---ভাতের থালার পাশে।
শ্মশান ভূমির মাঝখানে চিতা,তার ওপর শোয়ানো শব
তারও ওপর খাবারের আয়োজন,
নীচে,পাথুরে চত্ত্বর।

মাঝরাত পার হয়ে আসে ক্ষীণ পতঙ্গ ও কীট
মুখে রত্নশর,লালামাখা ঠোঁটে চিতার তলায় খোঁজে নীল মণি।
গহ্বরের পর গহ্বর ছাড়িয়ে
অরুন্ধতী আর স্বাতী নক্ষত্রের উর্ধ্বতনে উঠে
মানুষ হবার যজ্ঞে।

হাড়ে-হাড়ে সংঘর্ষ,বাতাসে পাপবোধ,ব্রতকথা,
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সৌরবল।
শূণ্যে ফেটে গেছে আদর,আকাশজ্যোতি
কালরাত্রি দেহে কেবল খালের ধারে জেগে আছে সাপের ফণারা।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

শিল্প ও শৈল্পিকতা

অনুন্নত রাত
কোনো কোনো এ রকম রাতে
অন্ধকারের ওপর সালংকারা আলো
সোনার তরবারির মতো অজ্ঞাত সময়ে জ্বলে
চোখের সামনে থেকে সরে যায় এনামেলের ভিক্ষার বাটি
পথভাঙা পটভূমি--ঝাপসা চোখের নীচে একাকার হয়ে আছে দিন
ও রাতের স্তব্ধ প্রান্ত-প্রতিবিম্ব সরে গিয়ে সুন্দরের সমন্বয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে
কবরখানার পাশে,শ্মশানে,সন্ধ্যাবেলার ম্লান ইশারায় কেঁপে ওঠে
আমাদের ইহলৌকিক,পারলৌকিক এবং ভবিতব্যরেখা,--
যা ভাঙবার নয়;ভেঙে পড়ছে কঠিণ শিলাখন্ড
ছেনী ও হাতুরী শিল্পে নিঁখুত বুননে
জেনেছি শিল্প ও শৈল্পিকতা
ভরা অন্ধকার


চতুর্দশপদী

।।সাত।।

যত্নে জন্মানো এ ফুল কিভাবে ভাসিয়ে দেব তামসীক জলে
খালপারে বসে আছি,নিদ্রামগ্ন।বালুকণা,ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ
এবং জলজ শ্যাওলা আমাকে জানিয়ে দেয় ফুলের আস্লেষ
থেকে মুক্ত এ প্রান্তর আর জগৎ সংসার,জলপোড়া দেহ,
অনুশোচক করোটি,তার অন্তিম গহ্বরে রক্ত,প্রেম,স্নেহ,--
পালাবার পথ বন্ধ।সব রহস্য হারিয়ে এবং অবশেষ
সবাই নেমেছি পথে।শব্দের প্রকৃত বোধে অনায়াসে কেউ
ভাসে বারোমাসি স্রোতে,শূণ্যের অভিবাসনে,পাহাড়ের ঢালে,--

পরিত্রাণের শাবল,দিকচক্রবাল বাস,আপাত সম্পৃক্ত
আমাদের বেঁচে থাকা।দৃঢ়, প্রসারিত হাতে পিশাচিনী ছায়া।
অনধিকার জীবন,তাল সুপারীর বনে পাপীয়সী জ্যোৎস্না
আমার মুখের সাথে মিল খুঁজতে এসেছ?বাগানের হাস্না,
চন্দ্রমল্লিকা,মালতী,রক্তজবার সিঁদুর,অভিশাপ,মায়া
মঙ্গলঘট ভরেছে আর আমাদের হাতে ধ্বংসবীজ,রক্ত।


শূণ্য ছায়াচিত্র

হরিতকি মাঠ,জামের বনের ছেলেবেলা

ঝলকে ঝলকে উঠে আসে রক্তপথ বেয়ে
উড়ে যায় সব রঙিন পালক

অনেক পাঁকের নীচে আধপোড়া খড় ও বালির স্তর
ঠেলে ঠেলে আগুনে শরীর দেখে তারাখসা
অচেতন গ্রামের ভেতর দীর্ঘাকার প্রভা

তার বৃত্তপথ থেকে দূরতম শূণ্যে ছায়াচিত্র
জ্বলতে জ্বলতে পৃথিবীর কাছাকাছি ছাইভস্ম
উড়ে এসে গায়ে পড়ে
ওখানে দিন ও রাত নেই,শুধু জমে থাকা

যারা পরে এসেছিল,দেখেছে আমূল মূর্তি
কাঁধে বৈঠা,বাঁকানো দু'হাত
পুড়ে গেছে সর্বাঙ্গ,দাঁড়িয়ে আছে তবু
জ্বলন্ত সূর্যের দিকে মুখ
পায়ের তলায় পৃথিবী কাঁপছে

পবিত্র দুধের গন্ধ

পাখির কংকাল পড়ে আছে জলার ধারে,--
যারা দেখেছিল তুলে এনেছে রঙের ছাপচিত্রে
আগুনের নদী থেকে চুন-লবণের খাদ,---পৃথিবীর কিনার অবধি
পাখির পালকে ভরা
গাছের পাতায় মৃত পশুদের লোম
ডাল থেকে ঝুলছে চামড়া

শরীরে ছত্রাক,শূণ্য চোখের কোটর
পথে নেমেছে মানুষ---গাছে গাছে মৃত্যুফুল
এই মৃত্যু লেখা ঝাউগাছে,সৈকতে,সূর্যাস্তে
শুধু কুমারীর বুক জুড়ে পবিত্র দুধের গন্ধ

শান্তচারী

তোমাদের সমর্থন ভুল
তোমাদের সামাজিকতা লৌকিক
সৌরস্বভাব,শব্দের বোধ
অপব্যবহারী ক্ষমতা,ঝর্ণার জলে রক্ত,---

আজ এই চরাচরে কালো বাতাসের দাপাদাপি
প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্যনীয়ের অভিমানে ছেয়ে আছে বুক
তোমাদের ফেরার সময়ে শুধু শোনা যায় অদ্ভূদ পায়ের শব্দ

এছাড়া অশান্তি কিংবা শান্তি কোনোটাই নেই
তোমরা এমন,শান্তচারী

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

অজচ্ছল শব্দ

সকাল বেলার মুখে তোমার স্থলপদ্মের দীপ্তি

অজচ্ছল শব্দে ভেসে যেতে থাকে
একদিন ভুলে যাবে কোথায় ছিলাম

তোমার গলার শঙ্খদাগ,নাকছাবি,--
আজো মুছে যায়নি বৃষ্টির ঘরপোড়া শব্দে
হিম গিরিখাতে পিচ্ছিলতার পেছন দিকে চোখেমুখে উদ্ভাসিত বালুচর

চোখের তারায় ছিল সর্বনাশ
আলে থেমে থাকা জলে ডানকানা মাছের মুখের প্রতিবিম্বে
এক বৃত্ত বিন্দু জলের ছায়ায় ভেঙে পড়েছিল বাঁধ

জল গড়িয়ে যাবার আগে আরুণিকে ডেকে নাও

অপ্রাকৃত তোমার ভাষার মর্মে কালপিপাসার গান
হাতের রেখায় নগ্ন নির্বাসন
শুয়ে আছ ইমনকল্যাণ পাশে রেখে
তার সুরের ছায়ায় জেগে আছি বিষাদ জড়িয়ে
দরোজার বাইরে বেড়াল,এঁটোকাটা চোখের ভেতর

বানানো সভ্যতা

অন্ধকার কোণে একাগ্র মাকড়সার জাল বোনা দেখি
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যতটুকু
কপালে উল্কির ছাপ,দু'হাতে অমাঙ্গলিক বালা
শ্মশানে চন্ডাল বসে আছে,খুঁরি ভর্তি মদ

আমার পাঁজর ভেঙে সেই হাড়ে মশাল জ্বালিয়ে
ধুনুচি নাচছে--এক যুগ অন্ধকার থেকে আরেক যুগের অন্ধকারে
হাত,পা ও পায়ের আঙুল থেমে নেই
সুপেয় জলের মগ,কংকনবাদিনী---
গভীর অন্ধকারের বাষ্প ভরে রাখে

যেতে চেয়েছিলাম অমরাবতী নদীতীরে
(এক বৃত্ত ক্ষিপ্ত জলে করপুট ভরে নেব)
ধানুকী নেমেছে পথে হাতে তীর,পিঠে ধনুর্বাণ
লোকালয়ে বুনো শুকর,ইস্পাতশব্দে ওড়ে ভীত গ্রামবাসী
টিন,ঢ্যাঁড়া পেটায়,টুকরো পাতা মানতের পত্রের মতোন ভাসে

আদতে শিকারী
কখনো কখনো পরিণত শিকারে,ঐ,---
সবুজের সমারোহ থেকে অগ্নিকুন্ডে
ঘুরে ঘুরে পড়তেই থাকে বানানো সভ্যতা

সংঘাত

শিরার ভেতরে নৌকা-নদী,সংঘাতে সংঘাতে ঠিক পথ খুঁজে নেবে

আমার যাবার পথ আমাকেই খুঁজে নিতে হবে
জল ভেঙে,পথ কেটে,কাটাঝোঁপ,পাথর এড়িয়ে

নষ্ট হবার সমস্ত গুণ বুকে ঘুমিয়ে পড়েছি
সুযোগের পাশাপাশি বিপরীত জলে
লুকিয়ে রয়েছে মাটি ছোঁয়া সুখ,সাজানো জীবন

নাড়া দিলে জেগে ওঠে তোমারই ঠোঁটের ফসিল
চোখ থেকে উড়ন্ত ভস্মের কণা মুছে ফেলে,---
দীর্ঘ চলাচল থেমে থাকে শ্মশানের মাঝামাঝি
ছিন্নভিন্ন আধপোড়া কাঠ,মাছির প্রপাত,ধূপাধার

ডানায় রক্তের দাগ,ঠোঁটে মাংসকণা---যৌনগন্ধের শরীর
স্বপ্নের ভেতর শুনি আত্মঘাতকামী চিৎকার
নখরাঘাতে বেজে ওঠে কাড়া বা নাকাড়া
বুকেপিঠে ঠোকাঠুকি---প্রতিটি অক্ষরে পদপাত
গূঢ় লৌকিকতা নিয়ে ঝুঁকে আছে আমার শরীরে

পাহাড়ের ঢাল;যেখানে প্রদীপ নিভে গেলে
কেঁপে ওঠা অবৈধতা ঘিরেছিল
মিলিত শরীর

বাতাস ও জোয়ারের টানে ঘাটে লাগে টান
ভাঙা পাটাতনে বৈঠা শুয়ে

মল্লার ঘুমিয়ে---মনে হয় জাগবে না,কোনদিন

শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৪

একমুঠো আড়াল

বালতির জলে অপর্যাপ্ত স্নান
শীতের সকালে গেয়ে যাচ্ছ দৃশ্যজগতের গান
আলো-অন্ধকার স্নান ঘরে
সাবানের ফেনা,খসে পড়ে তোয়ালে,কাঁচুলি

উঠোনের রোদে মুঠো খুলে দেখি
কররেখা ভরে নিষ্ফলতা
জলের ওপর বাস ছিল
নিবিড়ের সজলতা ভেঙে দু'হাতে তুলেছি আলো,প্রণত বিশ্বাস
আত্মাভিমানে বাড়িয়ে দিই নি বুকের চরাচর
আজ মনে হল সময় হয়েছে বীজ ছড়ানোর

আমি পৃথিবীর কাছে একমুঠো আড়াল চেয়েছিলাম

ষাটতম জন্মদিনে

আগুনের সর্বস্বতা জ্বলে যাচ্ছে,কাঠে
দুঃখ কি পুড়ছে শেকড়বাকড় সমেত গাছেরা
আত্মাহুতি দিয়ে প্রশ্ন করে আজ এই ষাটতম জন্মদিনে
আমি দশদিক দায়হীন তাকিয়ে দেখছি সব নদী স্থির হয়ে আছে
ধ্বনিপ্রতিধ্বনিময় ছায়া,চোখের পাতার স্মৃতি মিশে যায় ধুনুচির অন্ধকারে
আরতির ধোঁয়া,গ্রামের সীমানা ঘেঁষে কেঁপে উঠছে উপুড়করা প্রদীপের দুঃখ
ভুল পথ আজ অভিশাপ দেয় জন্মহীন মহাশূণ্য পরিভ্রমণের
মাথা পেতে অভিশাপ নিই,--পাথরের,লোহার,কাঠের
লোহা এসে বিধঁছে পাথরে,জলপোড়া নারীদেহ
প্রকৃত শরীর নিয়ে উঠে আসে চরে
বলে,শুভ জন্মদিন,বুড়ো

স্বতন্ত্র সনেট

।।বিশ।।

তোমরা সবই ভোলো,ভুলে যাও নিসর্গের গান,
অশ্রু,রক্ত ও কবিতা এমনকি দেশ,গণতন্ত্র।
শহর নিলাম হলে বলি,'ফিরে নাও অধিকার,
ঢেকে ফেলো অগৌরব।'নির্বিকার সাড়ে তিন হাত
ভূমি পেলে উষ্ণ অনুরাগ,ফোয়ারা,বাগান
যতোই উদাস হও প্রান্তরে আঁকোনি ছবি,মন্ত্র
কঁড়ি,সাপুড়ের বাঁশি--পাথর উঠেছে বুকে আর

প্রতারত হাতছানি।মুখের মাংসপেশীতে চাঁদ
লেগে আছে,দ্বাদশীর।যে কোন সময়ে খসে যাবে,
খসে যেতে পারে। দিন ও রাত্রির মাঝখানে ছায়া
জলে,রৌদ্রে,আয়নায় বাকা হয়ে কাঁপে প্রণিপাত।
রেখার সারল্য থেকে রঙের অন্তিমে পাতা ফাঁদ,
প্রতিফলনের মতো যাপিত জীবন ভুল ভাবে
ভুল পথে ভুল থেকে শুরু এ শরীর,মায়া।

স্বতন্ত্র সনেট

।।ছাব্বিশ।।

মৃত মানুষের চোখে আমি দেখেছি শিখর থেকে
আরেক শিখরে লাফ দেবার মুহূর্তে চন্দ্রাহত
কবি কেমন নিঃসীমে ডুবে গেল।ধ্বংসের অতলে
প্রহরে প্রহরে প্রশ্নঃনিষ্ঠাবান কবি ধ্বংসবীজে
শেকড়েবাকড়ে বেঁচে থাকা?উজান নদীর দিকে
নটেশাক,বুনোওল---পায়ের তলায় যাত্রাক্ষত
নিরামিষাশীর মুখ ডুবে গিয়েছে উৎসের জলে।

অগ্নিমান গাছ,পাতা যতটুকু শব্দ ও সন্ত্রাস
গত এক শতাব্দীতে ছড়িয়ে দিয়েছে,পৃথিবীতে
ব্যভিচার,পাপ,হিংসা--কে বাঁচতে পেরেছিল,কবি?
ফিরে যাবে এই ভেবে প্রবল বর্ষণে ভিজে ভিজে
গিরিখাত,পথশ্রম?সমারোহ শব্দের বিন্ন্যাস
বুনন ও গাঁথুনিতে ফাঁক নেই,সমুদ্র সৈকতে
মশাল জ্বেলেছি,দেখো,কাঁপে আলেয়ার প্রতিচ্ছবি।

চতুর্দশপদী-৬

খরতর স্রোতে ভাসে আদম শরীর,বুকে দাহ
জালে তুলে এনেছিল মধ্যবিত্ত্বের ভাঁওতা আলো,
বুকের প্রপাত ঝরে,চিবুকে পাষাণ।খুঁড়ে খুঁড়ে
হলুদ রঙের আলো আর পাঁজরের হাড় ফুঁড়ে
বেরিয়েছিল অশ্বত্থ--তার নিবিড় ছায়ার কালো
অন্ধকার গায়ে মেখে পরমার্থ ঘাট,নদীতীর,---

জল নিতে এসেছিল কাঁখে কলস,গাঁয়ের বধূ
নামে নি গভীর জলে মনে ভয়,এখনও আছে
সহজ স্রোতের টানে নীল জলে অর্ধনগ্ন বুক
বুদবুদে ঢেকে ফেলে। বালির আড়ালে এই মুখ,
ভদ্রতার এ লৌকিক পরিক্রমা সভতার কাছে
জেনে নিতে প্রশ্ন করিঃকলংক রেখায় বিষ,মধু?

চেয়ে থাকো খোলা বুকে জীবনের সব অসাড়তা
লুকিয়ে রয়েছে।সারা শরীরে অঘ্রান,অনন্যতা।

শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৪

কবির সমর্পণ

চোখে উড়ে এসেছিল বালি---
লোনাজল মিশছে বাতাসে
একদিকে পৃথিবী,আরেক দিকে আমরা হাঁটছিলাম
পাপ-পূণ্যের গোপন অন্ধি-সন্ধি আপাতত পড়ে থাক
আমাদের দুঃখ,শ্রম,প্রেম,ঈর্ষা বা ভাবাগ্লুপতা
কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়

পাহাড়ের ওপর সূর্যাস্ত দেখো,সেখানে আগুনে হাহাকার
কবিদের জীবন যাযাবরের
ঈর্ষার ছুরিতে বুক চিরে দেখো
রক্ত নেই---শব্দের কল্লোল স্রোত

বিরহের আগুন জ্বালিয়ে দেখো
পুড়বে না,শুধু ছুঁয়ে যাবে তাপ,একটু উষ্ণতা
কি প্রত্যাশা কবিদের কাছে

অন্বেষণ আলোর ভেতরে নয়,অন্ধকারে
জ্যোৎস্নার আলোতে উন্মুখর নদী ভেসে যায়,সমর্পণ সমুদ্রের দিকে

বোধ ও শব্দের দিকে কেবল কবির সমর্পণ

সমর্পণ,প্রতিবাদ

ফেটে পড়া অরণ্য,কলজে---গাঢ় সবুজের যৌন অন্ধকারে
ঝর্ণার গলায় হেসে উঠেছিলে
রক্তস্রোত ছুঁয়েছিল গোড়ালি,পায়ের পাতা
প্রথম,দ্বিতীয় সব মিলে মিশে একাকার মিলণের প্রখর নখরাঘাতে
পিঠ জ্বলে উঠেছিল রক্তজবার জ্বলন্ত ক্ষতে

আমাদের সব সমর্পণ,সব প্রতিবাদ
একরোখা নদী থেকে দুঃখস্নানে দুঃখস্নানে ভেসে যেতে যেতে
উঁকি দেয় জলের তলার থেকে
আর আমরা রাত্রির স্তবে মেতে উঠি

আমাদের হাত ভরে উঠে আসে পলি,অনুচ্চার শব্দের ভেতর মুক্তি
পরিত্রাণের নৌকায় নদী ভাসে,অবাধ পারাপারের অপেক্ষায়
ঠিক তখনই মনে হয় ভ্রষ্ট এ জীবন,প্রতিটি মুহূর্তে বাঁক বদল,পরিবর্তন

হাত থেকে ফেলে দিই পূরাণো কুঠার
আয়ূরেখা পার হয়ে কেঁপে ওঠে গাছ

আমাদের শরীরের শব মাঝরাত ঘুরে ফিরে আসে চিতা থেকে

চতুর্দশপদী-৫

একদিন ছুঁয়েছিল গানের গভীর থেকে উঠে,
শুক্ল মহিমার রাত---স্পষ্ট স্বরে অবিমৃশ্য ঝড়
প্রসারিত দুই হাতে জলময় আঘাত।নিমগ্ন
রক্তনদী,জেগে ওঠে প্রার্থনার ত্রোস্ত,চতুর্বেদ।
ছত্রখান দুই চোখে গলিত শরীর।মজ্জা মেদ
ভাসে বারোমাসি স্রোতে।ঠিক মৃত্যুর আগের লগ্ন
এসে গেলে উড়ে যায় স্থিরতা,সংসার,পাতা,খড়।

জ্যোৎস্নাময়ী সিঁথি ছেড়ে আমি কি শূণ্যের অধিবাসী,
দূরাতীত মেরুপ্রান্তে?স্ফীত মাটির আড়ালে ঘাস।
সাঁকোর তলায় খড় ভাসছে,ঐ খড় প্রবাহিত
পূর্ব বা পশ্চিম পাড়ে,কোন কৃষকের সমুস্থিত
শীতার্ত দুঃখের সঙ্গী।দু'তীরে যাদের বসবাস,--
দেখো,কত দীন,কত মলিন তাদের চলা,হাসি?

চতুর্দশপদী-৪

নিজের হাতের দিকে ঘাস,---সবুজ,হলুদ পাতা
মাটি ফুঁড়ে,জল ভেঙে ডালপালার কোটর থেকে
শিল্পের গভীর অর্থে প্রতিবিন্দু আনন্দের জল
আজ অভিশাপ দেয়।কবিতার বিনিদ্র প্রহরে
জেগে ওঠে বালুচর,মরুভূমি,শব্দের জোয়ারে
মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু ভেসে যাওয়া,অন্তিম ঢল,
জলস্রোতে ছায়া,অগ্নি থেকে জল সেঁচে,বালি ছেঁকে
তুলে দু'একটি শব্দ ভরে নেই কবিতার খাতা।

আজ যে কোন আঙুলে পরিত্রাণ,চোখে পড়েছিল
দিন যাপণের রক্ত?গোপণ আদরে শরীরের
পরস্পর ভিন্নতায়--জেগে ওঠে নীল গলা,বুক।
একরোখা ধমনীর নীল স্বৈরাচারে জ্বলে মুখ,
শস্ত্রময় ঘাতকের শিল্পে আর মল্ল আষাঢ়ের
ঢলে নিজেকে ভেঙেছি---ঘাস,পাতায় কবিতা ছিল।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

লোভনীয় পৃথিবী

সমুদ্রের জলের ভেতর থেকে কতটা গোলাপী,লোভনীয় মনে হয় পৃথিবীকে
আমি জানতে পারি নি;যারা জেনেছিল সভ্যতার পাপে পুড়ে গেছে

সৎকারহীন সে ভস্ম থেকে হাড়ে হাড়ে শেকড় গজিয়ে গড়ে উঠছে নগর

মড়কের পর মারী
পেছনে পেছনে চিল
তারপর আসে অসুখী শকুন
গো-ভাগাড়ে কেটে গেল দিন

আমার স্তব্ধতা দেখে পাশ থেকে
'চর্যাপদ' উঠে গিয়েছিল
আমি নিষেধ করি নি
ভালোবাসার বদলে চেয়ে নিয়েছি আঁকর,বর্শা,শকট ও শস্যবীজ
এবং সর্বোপরি যুগপোযোগী ঘৃণা ও এক ফুসফুস ভর্তি হিংসা

আমি কি কখনো খালপারে একতারা বাজাতে পারব
বাউলের সাথে স্নান
উৎসবের বালুচরে কেউ আর ডাকে না,সবাই বলে,
'ও তো অন্য লোক,
অন্য গ্রহের বাসিন্দ।'

আমি মিশে যাব অন্তহীন শূণ্যতায়,শূণ্যতাবিহীন
কেউ-ই আমাকে মনে রাখবে না

চতুর্দশপদী-৩

গাছের জীবন তার,শেকড়ে-বাকড়ে জন্ম,ফল,
ফুল,পাতা ও বীজের বরাভয়,ঘূণ ও পচন ধরে
আছে সমস্ত শরীরে।ভাপ ওঠে প্রাচীন জঠরে
মাটি,বালি ও পাথর ফেটে জীর্ণ রৌদ্রনভস্তল।

হাড়ের ভেতর নুন,মাথা থেকে পা,অনিশ্চয়তা
ঘূর্ণ্যমান মরুভূমি;অশালীন জীবাণুবিস্তার,
আমার যাবার কথা বেশ্যাপাড়া কিন্তু এ নির্ভার
পায়ে যাত্রাক্ষত,রক্ত,পুঁজে অচল পায়ের পাতা।

আমি খুঁড়িয়ে হাঁটছি।অত্যাধিক ভালোবাসি এই
নিরক্ষর বেশ্যাদের।স্তনময় শরীর,দু'চোখে
বিল্লোল কটাক্ষ--হাসে,গায়,কাছে আসে।শৈলমুখে
একে ওকে প্রশ্ন করি,কোথায় থাকিস তোরা,তুই?

রক্তমাখা চাঁদরের নীচে হেসে ওঠে বাজপাখি
বেশ্যাদের শোভাযাত্রা,অগনন শব দেখি।

অন্যরকম,চতুর্দশপদী

পূরাণো গাছের গুঁড়ি ঘূণে ধরা,শেকড়ে শেকড়ে
জ্বরা,পাথর সময়ে মনে হয়েছিল,'জলাধারে
এই সব ঋণ,দেনা আদি সময়ের রক্তস্রোত
বিশালাক্ষী অন্ধকারে অনায়াসে তুলে নেব বুকে।'
রক্তক্ষরণের দিন সমাগত।অন্তঃস্থল জুড়ে
কালো মেঘে এসেছিল বাষ্পভার,এই খালপারে
দেখো,পড়ে ছিল এই শুক্ল মহিমার রাত।

প্রাচীণ ঝর্ণার ধারে শুয়ে আছি,ঘুমহীন চোখ,
নিজের ছায়ার মধ্যে বসে দীর্ঘ অপেক্ষার ফাঁদ।
জল কাছে ডাকে,রক্ত,---তার দাবী উষ্ণতা।মানি নি
শরীরের পিছুটান।বিশ্বাসের সমারোহ থেকে
তুলে এনেছি করবী।চেনা আয়নায় ভাঙা মুখ,---
ঝরে পড়ে ধূলিকণা,বাষ্প।সামনে গভীর খাদ।
শীতে কাঁপছি ভীষণ,খোঁজো,খড়-কুটোর জ্বালানী।

বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৪

দুপুরের নোংরা উঠোন

এই পথে কুকুরের চলাচল,রক্তমুখো ছুঁচো আর শ্বাপদের

হিংসার আবর্তে স্রোত,নির্দিষ্ট রঙের স্থির প্রতিচ্ছবি,ধূপছায়া
শীর্ণ হাত শূণ্যে উঠে যেতে চায়;যেখানে মাকড়সার নিরুদ্বিগ্ন জাল

কবি ও গায়ক যারা প্রবাসে ভিক্ষুক হয়ে ঘোরে
আমি তাদের দেখেছি
প্রদীপের গোপণ সংকেতে ঘরে ফিরে যেতে

চক্ষুষ্মান পুরুষের মতো দু'হাত বাড়িয়ে আছি,পথে
সকলের চেনা এই বিরান প্রান্তরে গান ছিল দৃশ্যজগতের,পরাবাস্তবের
পৃথিবীকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে আছি,টিকেটঘরের অন্ধকারে
নৌকা নেই শূণ্য ঘাট

বাড়ি ফিরে দেখি আলপনাহীন
দুপুরের নোংরা উঠোনে হলুদ পাতা পড়ে আছে
ঘরের ভেতর জ্বরে পুড়ছে মানবী
আমার ক্ষিধের অন্ন,গামছা,সর্ষের তেল কোথাও পাই না
সারারাত জেনেছি,নিয়তি---ফিরে আসবার

লোকে ভুল করে পথে নামে
আমিও চৈত্রের দুপুরের পথে অগনন মানুষের ভীড় থেকে পালিয়ে এসেছি
স্বপ্ন বিপর্যয়ে,পত্রস্নানে শুধু আমার হিরের আঙটি জ্বলজ্বল করে
মরুভূমিবোধে,তৃষ্ণায় উতঙ্ক মেঘ নেমে আসে
অমৃতের জল ঢেলেছি পায়ের ফাঁকে
দূরে,দাঁড়িয়ে দেখেছে ইন্দ্র

চতুর্দশপদী-২

মিলিত দ্বৈরথ,প্রেম,মন্দিরের ত্রিশুল ফুঁসছে।
জন্মদিনের উৎসব ভেঙে প্রদীপ বসানো দুঃখে
খরার প্রতীক নিয়ে বলেছিলে,'সমর্পিত সুখে
আমাকে ভাসিয়ে নাও।ভেসে যাও;যা আমার আছে

তাই নিয়ে।'ধ্বংসনদী,পোড়া ভিটে মাটি কেঁপে ওঠে
মাঠের কিনার ঘেঁষে মৌসুমী বাতাসে প্রেতনাচ,
জোনাক পোক্র আলো-------এইসব ভেবে সাতপাঁচ
সমূহ শব্দের কাছে ঋণ বাড়ে।আধভাঙা ঠোঁটে

ধারারক্ত,অন্ধকার।চিতাভস্মে জেগে ওঠে হাড়,
রক্তক্ষরণের এই দিনে,এইসব অন্ধ রাতে
পেছনে জটিল পথ আর শোনো নগ্নতার শ্বাস।
নিয়ত উত্থানে চর,আমাদের স্বেচ্ছা বনবাস
সারাৎসার উড়ে যায়,মিশে যায় জলের প্রপাতে।
বুনো বীজ বুনে প্রতীক্ষায় বসে থাকছি নির্ভার।

স্বপ্নের ভেলা

সকাল দুপুর সন্ধ্যা অলকানন্দা নদীর তীরে
অসুখী মেয়েটি ভাঙা ঠোঁটে রজনীকান্ত,রবীন্দ্র,
অতুল প্রসাদ গায়।আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি সেই
সুর,সেই গান আর কখনো কখনো উঠে আসে
সব হারানোর ঘাট থেকে।দেখিঃচোখের কিনারে
জল চিকচিক করে,তার চুলের ভেতর সান্দ্র
মেঘের অবাধ আনাগোনা,হাতে মুঠো ভর্তি ঢেউ।

পায়ে ঘাসের ঘুঙুর;চারপাশ কালো করে ঝরে
নির্জনতার সন্ত্রাস।প্রবাসী নৌকার সারি,জলে
অমোঘ মাটির থেকে কয়েকটি নিরিবিলি শিলা
ছুঁড়ে ফেলে জলে যেন বেদনাগুলো না ভেসে
ডুবে যায়।স্বপ্ন ছিল,উড়ে যাবে দূর-দূরান্তরে
চোখে স্বপ্ন ছিল ভেসে যাবে টিলা,পাহাড়ের ঢালে,
নদীর অবাধ স্রোতে ভাসে সমস্ত স্বপ্নের ভেলা।

চতুর্দশপদী

গোধূলি পাগল নারী হাঁটছে,নদীর তীর ধরে।
পেছনে পেছনে রাত ভাসে অর্গলহীন আনন্দে
সূবর্ণ আলোর ছটা,মৃত্যুর অধিক তৃষ্ণা,ডোবে
তমসা নদীর জলে।'কবিতা বোঝে না,নারী তবে
অন্ধকার কররেখা থেকে তুলে আনে গান,ছন্দে
ভাসে,ভেসে যেতে চায় রক্তধারা,সমস্ত শরীরে,--

প্লাবন,আলোভাসান--সমর্পণ সমুদ্রের দিকে।
রাত্রির জঠরে ফোটে ক্লান্ত স্বপ্ন,গানের প্রহরে
লবণ ও ঘাস,জল পঞ্চাশমারির ঢেউ,স্রোত,
নৌকা,চর,কাঁশবন,জেগে ওঠে জেলেপল্লী,বুকে
জরাজটিল জীবন।পায়ে ঝুরি,অজস্র শেকড়ে,
রক্তাক্ষর পথে পথে ভাঙা শকট,অর্ণবপোত।

বন্দরে বন্দরে ভীড়,উৎকট জাহাজ,চিনি,মদ
এবং তামাকের গুঁড়া,মিহি বাতাসে মেরুবিচ্ছেদ।




মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৪

অন্তহীন বিমুখতা

শান্ত হয়ে চলে যাব,এত সুবোধ ছিলাম না-কি?
ভাত দিবি,জল দিবি,কোড়া পাখার বাতাস দিবি,
দোক্তা দিয়ে পান দিবি,হাড়ের মশাল জ্বেলে পথ
দেখা ও আবাগী,বেটি--জন্ম দিয়েছিস ক্যান,বল
খরায় পুড়েছে মাঠ,ঘরে চাল বাড়ন্ত,শালকী,--
শালকীতে জল নেই,খরা রাক্ষুসী আর কি খাবি
সে বার হালের গরু,এবার হাঁসুলী,বিছা,নথ

স্মৃতি শুধু ইতিহাসে,অরুন্তুদ ভাগ্যবিপর্য্যয়ে
অস্তীতির ঘট ভেঙে শরীরের কোষে আলো জ্বেলে
অন্ধকারে পথ খোঁজা,প্রতিধ্বনিবিহীন শূণ্যতা
সেটাও কি মুছে যাবে কালো করে যমুনার জল
ইতিহাসও এগিয়ে যায়,স্থির সময়ে ও অসময়ে
শুধু ঘাসের জঙ্গলে প্রতি পথের চলাচলে
আমাদের পড়ে থাকা এই অন্তহীন বিমুখতা

পুঁথি,পূরাণ ও পাঁজি

বিপন্ন মাঠের প্রজাপতি ধরে আছ সমারোহে
সবুজ রঙ,হলুদের,নীলের পেছনবেলা।গাছ
দেয়ালে বাঁকানো বট,সমকালীন ঝুরির মধ্যে
মিশে আছে মহাকাল।অন্তরালে সাজানো জীবন।
চারিদিকে শুধু জল,কবিতায়,সঙ্গীতে,আবহে,
নাচের মুদ্রায়,---সুখময় কাছিম,হাঙর ও মাছ
জাল বেয়ে উঠে আসে।ভূর্জলিপির দুর্বেধ্যে

পুঁথি,পূরাণ ও পাঁজি--বাঁচবার মৌল রসায়নে
শিখেছি বুনন,--- জাল ও নৌকা নির্মাণ।ভেসে যাবে
বাস্তব নদীর তীর ছুঁয়ে ছূঁয়ে,জলে মুখ দেখে,
ছত্রাক ও শ্যাওলার স্তরে বৈঠা টেনে,প্রাণপনে?
পরার্থ জলের কাছে ধাত্রীবিদ্যা,তারা ও আগুনে
সেঁতুবিদ্যা,ভূ-খনন আর বাতাসের কাছে শিখে নেবে
গতির সমীকরণ;ঘুম নেমে আসে দুই চোখে?



মাত্রাবৃত্ত ভালোবাসা ও অমিত্রাক্ষর প্রেম

মাত্রাবৃত্ত ভালোবাসা ও অমিত্রাক্ষর প্রেম ছেড়ে
পয়ারের স্নেহদাগ মুছে ঘুমন্ত অস্ত্রের গান
শেষ পর্য্যন্ত কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি?ধ্বংমাঠ,
ধোঁয়াপাহাড়,অগ্নিস্ফুলিঙ্গ--বারবার নেচে ওঠে।
দ্রুতমুকুরের ছায়া কাঁপে শালকী নদীর তীরে
গতায়ু পাপ ও দুঃখ ছেড়ে যেতে চেয়েছি অম্লান,
আত্মার ভেতর ভাপ ওঠে চিতার কালচে কাঠে।

আমার কবিতাগুলো ঝড় ও জলের আঁচে লেখা
বিন্যাসিত অক্ষরের ক্রমে পরিস্ফুট দৃশ্যমান--
পাঠযোগ্য কি-না পড়ে,দেখো।দুঃখস্নান শেষ হলে
বাতাসে উড়ছে হাঁস তার ডানায়-পাখায়-পিঠে
আধভাঙা সোনারোদ,চোখে দূরান্তের ছবি আঁকা।
পাপনদীর এ জলে ভাসে যত কবিতা ও গান
কিছুটা কুড়িয়ে নাও নীলাম্বরী শাড়ির আঁচলে।

অতর্কিত অন্ধকার

জেগে উঠেছে শরীর রুপোঝরা রাতে,শরীরের
আলপথ ভেঙে ভেঙে হাতের তালুতে শস্যদানা
শরীরে জলের ঢল,বুকে আগুন,তারই তাপে
রক্তবিষ গলে যায়---নিথর শরীর কেঁপে ওঠে
অশোক হাতের ছোঁয়া যেন আশ্রয় নদীতীরের
তোমার মুখের ছায়া,শরীরে কলংকরেখা টানা
কলুষমাখানো হাতে,ভ্রূণহত্যার গোপণ পাপে

আজ এই নদীতীর,এই কাঁশবন,বালুচর
তরূণ শষ্পের মতো আমাকে ফিরিয়ে দেয়,মুখে
আত্ম লাঞ্জনার ক্ষত,মাথার ওপরে মীন,হাতে
তুলাদন্ড,ভোররাত অবিরল ভাসে,বুক-পিঠে
লিখে রাখে অভিশাপ,ভেঙে যায় নদীর কিনার
রাতের বেলার বিষ শুষেছিল চন্দ্রতাপ,---দুঃখে
অন্ধকার নেমে আসে চরাচর জুড়ে,অতর্কিতে

নির্ভার হাত

উদ্ভিদের সবুজ রঙ মিথ্যে মেখে নিয়ে ওই চোখে
বলেছিলে,'ভালোবাসি।'কিশোর বেলার একাকিনী
পাথরপ্রকীর্ণ দুঃখ নেমে আসে পাহাড়ের ঢালে।
স্নেহরঙিন আমার চোখে অন্য পৃথিবীর ছায়া।
প্রবাহ্মান দিগন্ত,--শকুনের রক্তমাখা মুখে
এ জীবন কেটে গেল।স্বাধীনতা চাও,কতখানি?
মানুষেরা আজ বন্দী হয়ে আছে দেয়ালে দেয়ালে।

উৎকীর্ণ চিৎকার---আমি দুই হাতে কান ভেঁপে ধরি,
ভেবে দেখো,একে,ওকে অনায়াস ভঙ্গিতে এড়িয়ে
জলের অবাধ স্রোতে কতবার,কত জ্যোৎস্নারাত
অকাতর ভাসিয়েছি অবসিত যৌবনের মায়া।
অমিত সম্ভাবনার ধূলোওড়া শহরের বাড়ি,
তার বাগান,ফোয়ারা,পানশালা দু'পায়ে গুঁড়িয়ে
আজ পড়ন্ত বেলায় খুঁজে নিয়েছ নির্ভার হাত?

সনেটের সাথে সারারাত

কাল সনেটের সাথে শুয়েছিলাম,ভোর অবধি,__
তার অনাঘ্রাত যোনী,চাঁদের মতোন গোল স্তন,
দুধের সরের রঙা উন্মুক্ত পেট ও নাভী,উরু
নিমাঙ্গে ঘাসের বন---পিচ্ছিল সুড়ঙ্গে সারারাত
স্থির ছবিতে নিসর্গ দৃশ্যমানতার পূর্ণ গতি
শরীরে শরীর ঘষে জ্বেলেছিলে অনঙ্গ আগুন
স্বচ্ছ,তরল ও নগ্ন---সারারাত বেজেছে ডম্বুরু

কত দেনা হয়েছিল,হিসেব রাখি নি ,কতদূর
যেতে হবে আমাদের,পায়ের অসুখে বাসা বাঁধে
জীর্ণক্ষত,দীর্ঘস্নেহ---অনেকদিনের দায়হীন
শরীরের স্রোতের টান,বাধভাঙা অবাধ প্রপাত
দাঁড়ানো মিথুনমুর্তি-পরাভব বুকের ওপর
দূর অভিবাসী গ্রামে হাঁটছে যুবক,লাঙল কাঁধে
পায়ে পায়ে উঠে আসি শূণ্যতায়,শূণ্যতাবিহীন

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৪

জোনাকীর দৃষ্টি

প্রতিপদের চাঁদের আলো শুয়ে আছে নিকষ রাত্রির ঘাটে
জোড়া তালগাছ শেকড় নামিয়ে জলে সূচিপথ খোঁজে
সহজ জলের ব্যুহমুখ থেকে চেয়ে দেখো,
এই স্থবির আহত কাল বুকে পথের ওপর পড়ে আছে

ঘুর্ণ্যমান বিপণি বিতান,পাথরের শিল্প,ফোয়ারা,বাগান
স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যে---অসাড় দিনের মুখোমুখি কথামালা
সেই সন্ধ্যাজালে কাঁকরবিছানো পথ থেকে আমার হাতের
নির্ভার আঙুল এলোচুল তুলে দিয়েছিল প্রচ্ছদপট কপালে

মতিচ্ছন্ন তোমার মুখের পাশে আজো লেগে আছে গো-ধূলির ছায়া
প্রবাহদূয়ার খুলে প্রতিকোষে আলো জ্বেলে গেয়েছি পাতালগান

যদি মুছে যায় শূণ্যতা,---এখনো পাথরের গায়ে ছাইভষ্ম
জলের ভেতর পথ করে এতদূর চলে এসেছি,এবার

জোনাকীর দৃষ্টিতে তাকাও

জাল বোনা

জালবোনা শিখে নিয়েছিলাম ষোড়শী নিকারী কন্যার থেকে
আজ যে সব মাছের খেলা দেখি খালে-বিলে-জলাশয়ে
সব মাছের নামও জানি না---জালের
ফাঁস গলে বেরিয়ে যাওয়া
মাছেদের শরীরে ছত্রাক,শ্যাওলার ঘন স্তর
সাম্য-প্রতি সাম্যতার ঢেউয়ের দিকে ধাবমান মাছেদের ক্লান্তি কত--
সৈকতে আরুঢ় বসে ভাবি

জাল বোনা শিখিয়ে ষোড়শী সেই কন্যা
ঝাউবন পার হয়ে অগ্নি ও সন্ধ্যার মেঘে ডুবে গেছে

জলের ওপর ভাসছে ঘর

উড়ে উড়ে ঘুরছে বাঁশের পাতা।আণব ধোঁয়ার স্তম্ভ;
যা প্রত্যক্ষ এবং ইন্দ্রিয়গোচর---তা ফেলে এসেছি।
আঙুলের কর গুনে গুনে খাজনা আদায়,---
অথচ খরায় পোড়ে,বানে ভেসে যায় আলবাঁধা ফসলের ক্ষেত।
কে হিসেব রাখে?
অংশত রহস্যঘেরা প্রকৃতির বিচরণ।
ফেনদুগ্ধময় গো-চারণ ভূম,
ভুল পথে তাড়িত বিবেক,
ক্ষুধা-তৃষ্ণা-জ্বরা-মৃত্যুহীন এক একাকী ঈশ্বর
অযত্নে গা মুছে ঐ দূরের মাঠে শুয়ে আছে।

রথ নেই,পায়ে হাঁটছি।পথের দিক পাতার সংকেতে,
বনবিপর্যয়ে মরুভূমি বোধে রঙের প্রকৃতি যেন শোণিতপ্লাবন ধারা।
পূর্বসুরী কবিদের মতোন আমিও স্বপ্নচারী,
পারঙ্গম বালির ভেতর পথ করে ঢুকে যেতে
ছিদ্রান্বেষণ,পরচর্চায়,খসে পড়া তারাগুলো ঠিক জুড়ে দিয়েছি আকাশে।
আহ্নিক আবর্তে পাকা ফল,বীজ ফুরিয়েছে,---
কেন যে এসব নিয়ে ভেবে ভেবে সারা হচ্ছি?
পূর্বাপর ফিরে যেতে চাই বলে এই গ্রহণের দিনে
নিয়ম ভাঙার খেলা ভেঙে ভেঙে অন্তহীনপথ পাড়ি দেয়া।

এই ক্ষেতজাঙালে পরার্থপর অগ্নি ও পাথর ছুটে যাচ্ছে পথের আড়ালে,
বাগান ও তীর্থস্থান ঘুরে তীর্থযাত্রীরা নামছে পাহাড়ের ঢাল থেকে
সূর্যের প্রতিফলিত আলো ধরে রাখে তাদের পায়ের ছাপ।
আমি জলার ধারের উঁচু পারে বসে থাকি,এ জলের বিভাজন
থেকে উঠে এসেছিল আদিপ্রাণ,
পেছনে পেছনে গান,সহমর্মিতা,বিদ্বেষ,পশুআত্মা।
শামুকলালার দাগ,জলরেখা ঘিরে পদ্মপাতা,স্নানরত আদিবাসী নারী ও পুরুষ,--
চিত্রাপিত ক্রমঃরেখাপাতে অধোঃমুখ।

হাত ইশারায় জটাফুল ডাকে,অনাসক্ত ধুতুরার ফুল রহস্য বোঝে না,
পাখিদের গানে গানে সদুপদেশের সুর?
মঙ্গলঘট,--দেবতাদের জন্যে।আমি কিনে এনেছি কম্পাস
নোঙর কেনা হবে এই হাটবারে,
ততদিন জলযানগুলো ধুয়ে মুছে,বাতিঘর মেরামত করে রাখি।
স্তব্ধ এ সময়ে ঈর্ষাসবুজ কৃষিক্ষেত রৌদ্র,বৃষ্টি চায়,
চায় আরো বেশী শীত,অতিথি পাখির সমাগম।

শিকারীর পেছনে পেছনে বাঘ,বনের ছায়ায়
হরিতকি ফলের অমৃত শ্বাস,অলাবুভক্ষণ।
ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের শরীরে উড়ে আসে নীল মাছি,
রক্তস্নান সারা হয়ে গেলে
চারপাশে বেজে ওঠে পাতাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসে
সেচজমি পাশে রেখে গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগিয়ে আসছে একদল রুপালী কুকুর।

এখনো জলের ধারে বসে আছি।
রক্ত,অশ্রুপাত,পর্যবেক্ষনে ক্রমশঃ জেনে গেছিঃ
অর্থহীন মানবজন্মে দু'হাতে খামোখাই আগুন ছুঁয়েছি
বৃষ্টিহারা সমস্ত অঞ্চলে কেউ লেখেনি আমার নাম
মাটি,বালি,জল,শিলাগুল্মে।

শরীরের ওপর বৃষ্চিক,নিরুদ্বগে হাঁটে শুঁয়াপোকা।
হাতে তুলে নেই,কেঁপে ওঠে---
বিসর্পিনী অত্যাচারে যা কিছু আমার চারপাশে
একসাথে জ্বলে ওঠে সমস্ত মশাল স্মৃতির,স্বপ্নের।

এক শ্মশ্মাণের থেকে আরেক শ্মশ্মাণ ঘুরে উঠে আসে আত্মঘাত শব
রাত্রিময় অমাবশ্যা---তার দিকে
বিমূঢ়তা নিয়ে বসে আছে চিরহরিতের ক্ষিধে।

আধপাকা ফলের ভেতর ম্রিয়মান আমার পথের
বাঁকে অবিমৃশ্য হাড় মিশে আছে

আর জলের ওপর ভাসছে আমার ছেড়ে আসা ঘর।

ঝড়ে ভাঙা শরীর

তোমাদের ভুট্টা চাষ কোথায়?খাদ্যের জন্যে খোঁড়া পায়ে এখানে এসেছি।
তৈলহীন রুক্ষ্ম শরীর,সর্ষের ক্ষেত,শুয়োরের পাল?
রক্তক্ষরণের দিন সমাগত।নীল বর্মে প্রতিহত কালের চিৎকার।
বাজারের তেমাথায় এসে দাঁড়িয়েছি,দেখে নেব থলের আড়ালে কারা ছুরি শান দেয়?
হাতের থাবায় বাঘনখ,ঠোঁটের ভেতরে তিতা কষ।
করতল ভরে তোমার নগ্নতা নেচে বেড়িয়েছে,আজ মুখ অবগুন্ঠণে ঢেকেছ?

একদিন আমিও জেগেছিলাম মালীর পায়ের শব্দে
ফুলদানীতে টাটকা ফুল
কোথায় বাগান,কই গেল মালী?
পরিত্যক্ত সাপের খোলস,ইঁদুরের বিষ্ঠা,
ছাগলে খেয়েছে বাগানের নটেফুল।

খালপারে নৌকা বাঁধা,স্রোতে জোয়ারের টান
অনায়াস ভেসে যেতে পারো যে কোন নদীর তীর
জলের রেখায় ধূয়ে যায় কত গোপণ সঙ্গম,
মেরুদূরাতীত পাপ আর অবৈধ জন্মের ভ্রুণ।

দেয়ালে দেয়ালে পিঁপড়ের সারি,মুখে ডিম।
জল উঠবে।প্রমত্ত জলে সবকিছু ভেসে যাক,
আমরাও ভেসে যাব।

তোমার দু'হাতে স্রোত,কালনাগিণীর দর্পে
বহু মঠ পার হয়ে সন্ন্যাস নিয়েছ

ঝড়ে ভাঙা আমার শরীর পড়ে থাকবে নদীর তীরে?

পার ভাঙা নদী

সবুজ ঘাসের চাঁপ লেগে আছে ঠোঁটের কোণায়
মাটির ওপর মুখ---সবুজের অবাধ স্মৃতির উত্থাপন কেবল উদ্ভিদে
বিলীয়মান মাটির মধ্যে শ্যাওলা,ব্যাঙের ছাতা
সপ্তর্ষির দিকে উড়ে যায় স্বপ্ন,গৃহপালিতের

স্তব্ধ আকাশের নীচে শূণ্য চরাচর,বালির শহর
কোথায়,কিভাবে ভাঙে জানতে চেয়েছ
স্রোতের ভেতর দাবদাহ---নৌকা ও নদীর সংঘাতে সংঘাতে
দেখো,সাঁকোগুলো অটুট দাঁড়িয়ে আছে

ভাঙছে,কেবল নদীর পাড়

রক্তক্ষত,জবাফুল

স্তব্ধ বসে আছি আকাশের নীচে
শূণ্যতার কেন্দ্রে গড়ে ওঠা দালান-বারান্দা,সাঁকো
চোখে উপুড়করা প্রদীপ---সান্নিপাতিক আলোর মধ্যে
ঠোঁটের দু'কোণে ভাঙা হাসি নিয়ে বসে আছ
ভেবেছ,ব্রক্ষপুত্রের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে মায়াজাল ছিঁড়ে যাব

তোমার পায়ের কাছে উন্মুল পরাগ
ফুলের বাগান,জলপাই বনে রাতে ঝড় হয়েছিল
সৃষ্টির ভেতর ধ্বংসবীজ পুঁতে রাশি রাশি
পরাগের কোমলতা ছড়িয়ে দিয়েছি

দুঃখ বুনেছি করোটির বর্তুল গহ্বরে,অন্ধকার জ্বেলে জ্বেলে
ফাঁসজাল গলে বের হয়ে গেছে হাঙর
তার মুখেই সর্বস্ব হারিয়েছি

হিম শৈলচূড়ায় ধুনুচি নাচ
যদি মশাল জ্বালাতে চাও,--- এই নাও বুকের পাঁজর

আমি শরীরে জড়িয়ে নেব রক্তক্ষত,জবাফুল

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

আয়ু,বার্ধক্য,যৌবন,প্রেম,কিংবদন্তি

আজ ভাবি ভুল ছিল এত মুখোমুখি বসে থাকা,
একেকদিন ঝড়ের রাতে খোলাছাদে বৃষ্টি মেখেছিলাম শরীরে
তা কি ভুল ছিল?গন্ধর্ব বিশ্বাসে মুছে নিয়েছি শরীর
শতভূজ,বহুকুন্ডে শুয়ে আছে,অনার্য পৃথিবী,নারী তুমি কোন দিকে চেয়ে আছ?

তোমাদের পরিত্যক্ত ফলের বাগান,সমাধিপ্রস্তরে
আগুন জ্বলার আগে বুঝে নিই মাটির প্রবাহ,ঘাস,
দৃষ্টিশ্রুতিহীন পথিক হাঁটছে---রোমকূপে জ্বলে বসেছে পাতালগান।

আর আমার বুকের মধ্যে জমেছে আগুনভরা জল,
এসো,ঝাঁপ দাও,সর্বনাশ পেছনে উড়িয়ে।

লেখো,লিখে রাখো আয়ু,বার্ধক্য,যৌবন,প্রেম,কিংবদন্তি।

রক্তখেকো শহর

খর শীতে শহর ডুবছে
এ্যামোন শহর--তৃষ্ণার্তের জলে বরাদ্দ ঘাটতি
ধূলোওড়া পথে ট্রেন থেমে আছে
ষ্টেশন গিয়েছে যাত্রী খুঁজতে,টিকেট কিংবা বিনা টিকিটের

বস্তুগত পাথুরে দেয়ালে ক্ষত,লবণজল,পানের পিক
রাত যত ঘন হয়,দেখি উপচে উঠছে পানশালা
সকলের হাতে রক্তভরা গ্লাস
সন্ধ্যায় যে মেয়েটিকে দেখেছিলাম গলির মোড়ে,সেজেগুঁজে
তার ঠোঁট থেকে অবিরল ঝরছিল

এমনই রক্তখেকো এ শহর

বিষ্ণু দে

''আত্ম-চেতনার চর্চ্চাই কবিতা''

আঁধার,নিকষ অন্ধকার নামছে রাতের বুক জুড়ে।
'এখন সময় কত'---বলে উপহাস করে উড়ে গেল রাতের পাখিরা।
যারা ডানা মেলতে পারে না,উড়ে যেতে শূণ্যের কেন্দ্রের কাছাকাছি
অথচ ওড়ার সাধ তাদেরই সব থেকে বেশী।

আমরা বসেছি খোলা মাঠে।ওপরে নিঃসঙ্গ চাঁদ জ্বলছে।আঙুলে
আঙুল জড়িয়ে।'জীবন কবিতা নয়'---
বস্তুবাচক বয়স আর সময়ের গাছপাথর খেয়েছে চষাক্ষেত,খড়,
গরুগুলো অভূক্ত।প্রতিবেশীর উঁচু ঘর থেকে নামছে স্বাচ্ছন্দ্য,
আমার উঠোন ভরে আছে পরিত্যক্ত সাপের খোলসে।

যে দিকে তাকাই পথশ্রম।উত্তর-দক্ষিণে
বিরান প্রান্তর।দশ  আঙুলের সুতোয় ক্ষয়িষ্ণু শব্দচাষী,
ফিরে গিয়েছিল জলার ধারের পথ দিয়ে।শতাব্দীর মহাবট স্বাক্ষী
মাঝরাত ছুঁয়ে গেছে কবির তৃষ্ণার্ত ঠোঁট।

স্পর্শটুকু ধরে রাখতে চোখের মণি জল টলমল,ভরা পুষ্করিণী।

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৪

নিরন্তর মৃত্যুর প্রস্তুতি

নিরবিচ্ছিন্ন পাতার পাশাপাশি আঁধারচক্র,নিয়মি বিন্যাসের আধিপত্য
আমি ভাবি সেই থেমে থাকা,রথচক্র,নৌকা,--
সাবলীল গতি অথচ ধারাবাহিক ছন্দপতনের খেলা
পথ থেকে পাথর সরছে---সেই যে বর্ষায় ভেসে এসেছিল
নিথর সমর্পণের সাজে অপ্সরীরা নক্ষত্রেরও অধিক জ্বলে ওঠে
আকাশে পাতালে সেই সুর

তামসী রঙ শুকনো নদীর
তাকে পারাপার করে খেয়া নৌকার জন্মান্ধ মাঝি
রোদে শুকাচ্ছে মাছধরার জাল---ফাঁস গলে বের হয়ে আসে নিকারীর স্বপ্ন
শিউলিতলার সকালবেলা---রোদ ওঠেনি এখনো
ডালা ভরে এলো,পূজারী কোথায়
এখনো আসে নি ভাঙা আলপথ ধরে

নিরন্তর মৃত্যুর প্রস্তুতি
আমি সেই দিন বুনি

মনোহীন বৈকল্যের নিবৃত্তি ও গান

পাপ থেকে পাপের স্খালনে তোমরা কি অবিরত ভেসে যাবে মাতৃসমা জলে

সৈকতের বালুচরে কত বিনিদ্র রাতের কাল কেটে গেছে,সমুদ্রের জলরাশি
চাঁদের টুকরো,ঋণপত্র,সত্যায়িত দলিলের কপিসহ ভাসিয়ে নিয়েছে দূরে

মনোহীন বৈকল্যের নিবৃত্তি ও গান গেয়েছিল অন্ধ বাউল,সুরবিহীন
কেউ শুনেছিল
লেলিহান শিখা,জ্বালানী আঘাতে পোড়ে নির্বিকার শব,চিতার পেছনে ঘাট

ঘট ভরে জল তোলে অর্ধনগ্ন ডোম,হেতালের লাঠি পাশে
ফিরে এসে ভস্মগুলোর প্রতিটি অঙ্গ,প্রতিটি প্রত্যঙ্গ জুড়ে দেয় চিতার আগুনে
আজ চিতা জ্বলছে বাইরে,অন্তরীক্ষে
রাতজাগা কুকুরেরা ভীড় করে চিতা থেকে দূরে

শরীরে সংগতি
চিতায় জুড়াবে হাড়
দুঃখী মা কাঁদছে
খোকা তার শিখা হয়ে আকাশে উড়ছে
ফিরে এসো ভস্মদল,মায়ের শরীর ধরে রাখো

সমুদ্র ফিরিয়ে দেবে নৌকা,জাল,---
এতকাল যা নিয়েছে ঝড়ে,জলোচ্ছ্বাসে
বালির তলা থেকে ভাপ ওঠে
শরীরে সমুদ্রক্ষত,বালি ও কাদায় কংকালের ছাপ,সারি সারি শান্ত গৃহ
'কেউ জান না মাটির নীচে হাড়,খুলি জমে আছে'----
আমি জেনে গেছি

রমণীর অর্ধনগ্ন স্নান আর কলহাস্য,রঙিনসূর্যাস্ত
গিলে খায় চন্দ্রভূক কবি
জল-জলাশয়ে সব কবিতা ভাসিয়ে
নখরাঘাতে খুঁটছে সূর্যোদয়

কবি দাঁড়িয়েছে বৃষ্টির ভেতর,অক্ষরের ক্রমে কবিতা ভাসছে
প্রত্যাশার পচা হাড়-গোড়,--ছুড়ছে তামসী স্রোতে

নদীর ওপার থেকে ঈভ পৃথিবীর পথে ছুটছে,গন্ধম হাতে


প্রত্যাদান

মাঠের কিনারে কবি ভিজছে,একাকী।পাশে এক সন্ধ্যাকাশ।পরনে পাতার তৈরী
পোষাক,চাঁদের মুখোমুখি বাড়ি।মেঘের ভেতর গাছ,বনজঙ্গল,পদ্মপুকুর।
পয়ারের মাঠ,কবিতার ছন্দোবদ্ধ সারি,---কবির কী চাই আর?
স্বপ্ন দিতে উড়ে আসে ফিঙে,শালিকের ঝাঁক।

তবু কবি বিষাদে বিষন্ন।পঁচিশ বছর আগেকার
সাবেক প্রেমিকা চিঠি লিখেছে---'সমাধি নয়,
স্মৃতি নয়,নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ ফেরৎ দাও।
এতদিন যা লিখেছ,কবি।আমার ঠোঁটের থেকে,
আমার জিহ্বার স্পর্শ থেকে,আমার শরীরে,পদপ্রান্তে
যত কবিতা,সমস্ত গান...............

ফেরাতে পারবে, কবি?

গ্রহ-নক্ষত্রের ছায়া

নৈসর্গের নিস্তব্ধতা এতো বেশী ভালো লাগে

প্রতিরাতে আমি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি
খালপারে জ্যোৎস্নায় ভিজছে, কবি---দূরলক্ষ্যা কাকে ভেবে

অস্পষ্ট দু'হাত খুঁজে পেতে হারানো শরীর
ছুঁড়ে ফেলে দিই,মৃত্যুশোক
ঘরে ফেরে সকলেই,পাখিরা নিঃসঙ্গ পূর্ণিমার দিকে

ঘট,ভেঙে,নীল অধোঃশ্বাসে সমস্ত শরীর গলে ঝরে পড়ে
আমার চোখের পাতা মৃত্যুর প্রতিচ্ছায়ায় কেঁপে ওঠে
গড়ে তুলবার কথা মনে হয় নি--ধূলোশহরে তবু
লিখে রাখব সমস্ত নির্মাণ,বিনির্মাণের ইতিহাস

ভাঙা গ্রামে পড়ে আছি
শুকনো বালির ঝড় উড়তে উড়তে পথ ভুলে আমার উঠোনে এসে থামে
আমার পাঁজর,সাদা হাড় সব একে একে নক্ষত্রের দিকে ছুটে যায়
শুধু একবার নক্ষত্র ও আকাশের কোণ ঘুরে..............
চেয়েছিলাম আকাশ ছুঁতে তারপর মৃত্যু এসে হামলে পড়ুক এই ঠোঁটে

মৃত্যু ধরে আছি হাতে
এতো ধ্বস,বালির উত্থান----নিজেরই অথর্ব শরীর
টেনে আনি রাত্রিবেলা মৃত গাভী,শুকরের স্তুপ থেকে
পরাভূত মৃত্যুশোকে ছেড়ে দাও সব অধিকার

কৈবল্য মানি নি
মাটির প্রবাহ বুকে ছেড়ে এসেছি জলের টান
জল,--কোন ব্যথা শুষে নেয় নি,আমার

শুধু বাণিজ্যের ঢেউ অবিরত প্রস্তুত,প্রতারণার
আমি জল ছেড়ে পালিয়ে এসেছি

তোমার কাজল চোখে গ্রহ-নক্ষত্রের ছায়া,তার কিছু ভাগ নেব

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

পিঁপড়ে অধ্যুষিত সভ্যতা

খোলা প্রান্তরেই কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সবুজ,সুন্দর রথে শুধুই পথের কথা
ভাবতে ভাবতে আনমনা দেখতে পেলাম মৃত মহিষ,ক্ষুধার্ত মানুষ ছুটছে ওই,
মৃতের স্ফটিকমাংস লেগে আছে শকুনের ঠোঁটে,ধানক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ছে রক্ত,শিরা
শস্যের সবুজে কদাকার বীভৎসতা।রথের চাকায় এসে বিধঁছে পাথর,নুড়ি।
পেছনে শহর ফেলে এসেছি,সমস্ত সম্ভাবনা,পৌরপিতার দুর্নীতি,বিমানবন্দর,--
ইচ্ছে হলেই অন্য কোন আকাশে ওড়ার সাধ............।

সামনে ঘাসের বন।শুভ বুদ্ধিজাত গাছ মাথা ঊঁচু করে দাঁড়িয়েছে কিন্তু ওই গাছে
ঝুলছে মানুষ,তার নীচে ছেঁড়া চটি,করোটি ও কংকালের স্তুপ;সূর্যের উচ্চতা থেকে
ধারারক্ত,বসাকোষ---আমরা জেনেছি দূরত্ব,দ্বি-ঘাত সমীকরণের রাশিমালা
কিন্তু এসবের চেয়েও জরুরী সূর্য্যাস্তের পূর্বেই এ উপত্যকা পেরিয়ে যাওয়া,
বনের একটি চিতাবাঘ নজরে রাখছে সুদর্শন সাদা ঘোড়াটিই তার লক্ষ্য।

জল-জলাভূনি ছেড়ে রুঢ় অনুশাষণ,কাঁচের ভঙ্গুরতা,যাদুপট বাতাসে দুলছে,
সুখ ও দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে ক্ষিধের জগৎ-পশুহননের ইচ্ছে,--
আমূল বর্ষায় গেঁথে ফেলব হরিণ,কচি মোষ--পশু হত্যার ইচ্ছায় এখানে এসেছি?
ধর্মবক একপায়ে জলায় দাঁড়িয়ে-কে বেশী ক্ষুধার্ত?আমি না ঐ ধর্মবক?

বিপদসীমার উপরে প্রশ্নেরা,প্লাবনের মুখোমুখি গ্রাম-কে কাকে আশ্রয় দেবে,
কালোটাকা,রেশনের মোটাচাল,  বিপর্যস্ত অর্থনীতি,সমানুপাতিক বিরোধীতা?
জলনড়ানি বাতাস,মেঘলোকে আজ সুখী মানুষের বসবাস।

এ প্রান্তরে এত গুল্ম   ও উদ্ভিদ,পৌরাণিক ঝর্ণার সমস্ত জল উড়ছে বাতাসে
পূর্বাপর ফিরে যাব শহরে,পিঁপড়ে অধ্যুষিত মিথ্যে সভ্যতার স্বাক্ষী হতে?

বুনোফুল,পরজীবী লতা,ডাল থেকে ডালে--আমি তৃষ্ণাতুর চেয়ে থাকি।


ধূলো ও মলিন মাটি

মাটির প্রবাহ বুকে,জলের স্বচ্ছতা মুছে একাকার হয়ে আছে ডাঙা ও নদীর তীর।

পেতে রাখা জালে শতাব্দীর শেষ মোহ এসে আটকে থেকেছে,সারারাত।টানি নি সে জাল,
অন্তিম গহ্বরে রক্ত তার মুছে গেছে,ক্ষতের ওপর ব্যভিচারী জলস্রোত,পথ নেই

অবাধ আস্তরণের।স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যে এই ভ্রষ্ট সচলতা ঘূর্ণ্যমান সুদর্শনে
ছিঁড়ে যায় কবিতার খাতা,জলরঙে আঁকা ছবি।ভেঙে পড়ে জলস্তম্ভ।ছায়াচ্ছন্ন ঘাট,
মানুষের আকারপ্রকার,নৌকার গলুই,ধ্বসে পড়া দালানের নীচে সূর্যোদয়।
আমাদের লৌকিক নদীর ঘাট ভরে আছে মরুশূণ্যতায়,সীমাহীন প্রশ্নের মীমাংসা
আর সেইসব শব্দে প্রতিটি মুহূর্তে মাছধরা বালকের দল লম্বা ছিপ,ঝুড়ি হাতে
ফিরে আসে।ধানক্ষেতে গোধূলি।জন্মের ভ্রুণ আছে ভেবে ডেকে যাই।শুনেও শুনে না কেউ।

শুধু জলের কল্লোল থেকে উঠে আসে বন অবলুপ্ত এক নারী,জ্বলন্ত শরীর নিয়ে বলে,
'কোথায় কবিত?আমাদের সম্পন্ন উঠোনে মরা মেঘ এসেছিল,বৃষ্টি সে আনে নি তবু
ছাইমাখা আলোতে কবিতা লিখেছিলে।স্পষ্ট মনে পড়ে আমার বুকের সাদা স্তনে।লজ্জা,
খুশী,সৃষ্টির আনন্দে গর্বঢেউ খেলেছিল তোমার কবিত্ব ঘির।এখন চন্দন নেই,---

কবিত্বের আড়ালে আঙুলে ঘষা দিলে উঠে আসে ধূলো ও মলিন মাটি।'





বোধশক্তিহীন শরীর

অবিশ্বাসী কবিদের ভীড়ে জীবন ভাসছে,ভেসে যাচ্ছে শিমুল তুলোর মতো,পরিণতিহীন

সামাজিক দুঃখ,কবিতার সারল্য নিয়েছি দুই হাতে তুলে
মুঠো মুঠো ধান,দূর্বা নিয়ে ফিরেছি,জীবন,---তারা সব উন্মত চাতক

মেঘ ফুঁড়ে ফুঁড়ে রক্ত বের করে আনে
মাধবীলতার স্রোতে ভাসছে মৃতশরীর
মাটি ধোয়া কাঠামোটি দূর থেকে চেনা যায়

কে কবে ভাসিয়ে দিয়েছিল এ শরীর,আমিও ভেসেছি কিছুকাল
শ্রাবণের জলোচ্ছ্বাসে পায়ের তলায় ভেঙেছিল অসংখ্য গুঁড়ি-গেগলি
শুনেছি তাদের আর্তনাদ শব্দভাঙা ঢেউয়ের তালে

সেই ঢেউগুলো আমাকে বোঝাতে চায়ঃআমি গাছ নই,আমার শেকড় নেই

কালপুরুষের ছায় থির থির কাঁপছে,দীঘির জলে
সমাগত এ ধ্বংসের দিনে রক্তবৃষ্টি ঝরার আগেই
আমার ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছ
জাগিয়ে দিয়েছিলাম মোহ,ঘনিষ্ট নিঃশ্বাস স্বরে
আপ্রাণ বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে এ শরীর,দু'হাত আঁকড়ে ধরেছিলে
এ হাত কাঠের,এই শরীর ধাতুর তৈরী---বোধশক্তিহীন এ শরীর ছুঁয়ে লাভ নেই

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৪

পরাভূত দৃষ্টি ও শ্রুতির আলোড়নে

নীল অন্ধকারে এসেছ খালের ধারে
নীচে কালস্রোত,উপরে তারামন্ডল
জন্মের ওপার থেকে অতীত,স্বজন,আত্মপরিচয়---
চারদিক আলো করে আসে ভাসানের গান

আমি রক্ত দেখেছি সূর্য্যাস্তে
পাথর সময় পথ আঁকড়ে নিহিত বোধ জুড়ে ছিল
ফেরার সময়ে আমি কাউকে দেখি নি
আশাতীত নিপূণতা নিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলাম
সহজেই তোমার পাবার জন্যে

আপ্রাণ বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে
সাঁতরাতে সাঁতরাতে খাল পার হয়ে দেখি
ঘাটের পৈঠাতে আর্য যুবক আমাকে প্রশ্ন করেছিলঃ
'সব রক্ত আর জল কি সাগরে মেশে'

ভালোবেসে আমার শরীর সাড়হীন,আমি আজ অন্ধ ও বধির
অসাড় এ শরীরের ভার কোথায় রাখবো,এই ঘাটের পৈঠাতে

পরাভূত দৃষ্টি ও শ্রুতির আলোড়নে

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

কেবল একটি সমর্পনে মগ্ন অনিশ্চিয় প্রার্থিতার

ডুমুরগাছে বাতাস এসে এলিয়ে পড়ছে
এ অন্যায়
ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিবাদে গাছের শাখার আলোড়ন
রাক্ষুসী বিকেল---আমি তাকিয়ে দেখছি
ডুমুরের ডালে দুইটি পাখির আত্মমগ্ন প্রলাপ,উল্লোল

হেমন্তের রোগাটে পৃথিবী,উঁচু-নিচু মাটির বিকৃতি---
জিহ্বার জড়তা নিয়ে পথে নেমেছি,জুঁই ফুলের মালা হাতে

তোমাকে দেখতে যাবো

নদীর ওপারে লাল ইটের সমৃদ্ধ বাড়ি,বিস্তৃত উঠোন
পাশে ঝুমকোলতার গাছ
দড়ির ওপর নীল শাড়ী
স্তব্ধ বাহিরবেলায় একটানা ডেকে গিয়েছিলাম,নিশ্চিত---
অবোধ প্রেমিক

বিষাদে বিস্তীর্ণ সারাদিন নির্নিমেষ দেখেছি হলুদ ফুলে
অন্তর্মুখী নিস্তব্ধতা---একাগ্র চোখের আত্মময় লুন্ঠিত উদ্ভাস

কেবল একটি সমর্পনে মগ্ন অনিশ্চিয় প্রার্থিতার


মৃত্যুর ধাতব শব্দ

রাতের ভেতর কেঁপে ওঠে ছায়া
আমরা হারিয়ে ফেলি ঘুমের আলস্য,আশা ও করুণা,
হেসে ওঠার সাহস
অদম্য ক্লান্তিতে পথিকেরা রাতের চেয়েও দূরে হেঁটে যায়

শান্ত ও ঊষর পৃথিবীর নৈঃশব্দ,কালপুরুষ,ইস্পাতের দারুশিল্প
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ দ্রুত পাল্টে দেয় বস্তুজগতের দৃশ্যপট
মৃত্যুর ধাতব শব্দ তারা পৌঁছে দিচ্ছে-সেইসব ঘরে;
যার বাসিন্দারা পাথরের ফেনা খেয়ে বেঁচে থাকে

চাঁদের ভূতুড়ে আলো নেই,ধ্বংসস্তুপে পেঁচা
হেলে পড়া পৃথিবীর ওপর গাছেরা
কেবল কাঁপছে

তবু গাছটি অক্ষত

যথেষ্ট বর্ণনা নেই তাই ছাই ঝরে পড়ে চারপাশে
অসম্ভব তারামন্ডল ছুটছে
ছুটছে উন্মাদ ঘোড়া মৃত্যুর ধাতব শব্দে

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪

জীবনের ছায়া

ক্ষমার সজীবতায় আর্দ্র হাত থেকে উপছে পড়ছে
আলোহীন অন্ধকার,---অনন্ত প্রসারণের
প্রাচীন পাথর ক্ষয়েযায় স্পর্শের ঝর্ণাধারায়
আমরা নিমগ্ন আমাদের এই এক টুকরো জমিতে
নীল গুল্ম   আর স্বপ্নে দেখা অপুষ্পক উদ্ভিদ;কেঁচোর শরীরের ভরা দাগ

খালপারের জলের পথে কোমরভাঙা সময়
পড়ে আছে নৌকা---শ্যাওলা ও ঘাসে তৈরী--
যা একসময় সবচেয়ে দূরের নদীর তীর ছুঁয়ে দেবে
রোদ চকচকে বৈঠা সীমাহীন বৈচিত্র্যে
সাহস কুঁকড়ে আনে

একা বসে আছি খালপারে,হলুদ দাগের প্রান্তে
জীবনের ছায়া এসে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার নিজের জায়গাটুকু
দখলে রাখতে

আজ এখানে যা কিছু খাঁটি---করতল বেয়ে নেমে আসে
জীবনের নির্যাসটুকুর জন্যে

মিথ্যের সহজ স্রোত

বৈশাখের প্রশিক্ষিত ঝড় থেমে গেল দ্রুত কিন্তু তার অন্যায় তান্ডব
মিলনী সংরাগে আমাদের ভালোবাসা আজো লেগে আছে বুক জুড়ে
মেঘাচ্ছন্ন দিন
সমুদ্রের বালিকা রঙ
সুষমিত দেহ----ধূপের মতোন উড়ে গেছে
উত্তরের ভীরু শীত পাখি

আকাশের মেঘাচ্ছন্ন পটভূমি
আর পদতলে লেগে আছে চিহ্ন,প্রচন্ড ঝড়ের
জলে ভাসছে,পৃথিবী

স্রোতঃপ্লাবী মন,যাবার সময়ে বলেছিলে,
'ঘুমাও,ঘুমিয়ে থাকো,শীতঘুম কেটে যাক,
ফেরার সময় হলে ডেকে নেবো।'

আমি ঘুমোই নি,জেগে আছি,---
মৃত্যু নেই,মৃত্যু নেই---বলে করতল ভরে তুলে আনি হাহাকার
আত্মমগ্ন তোমার দু'হাত জুড়ে নবজন্মের উৎসব
চোখে জলের গভীর প্রহেলিকা

আজ এই খোলা পৃথিবীতে গভীর বিস্ময়ে দেখিঃ
ঝড়ের মুহূর্তে বলা কথাগুলো নিমিষেই মিথ্যের সহজ স্রোতে মিশে যায়

রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৪

নির্বিকার

বিনিদ্র বন্দরে ভেড়ে নৌকা,অতঃপর মোহনায়া মোহনায় যাযাবর বৃত্তি....

রাতের কুয়াশা ঢেকে ফেলে সমস্ত ফেরার পথ আর আমাদের হাসিমুখ ঘরে ফেরে
দেখি সন্তানেরা সাঁতার কাটছে অফুরন্ত জ্যোৎস্নার আলোতে

সন্তানের চোখে জেনে নেইঃবজ্র প্রত্যুত্তর বুকে আকাঙ্খাময় প্রতীক্ষা
ছায়াময় মরুবৃত্ত;পাথর পথের চিহ্নে আমার বুকের হাড় বিছানো রয়েছে
শতাব্দীর পর শতাব্দীর দম শেষ হয়ে যাওয়া ঘড়ির মতো কষ্টে বুক ছেঁয়ে যায়

আমাদের শরীরেরে একেকটি অংশ ভেঙে জোড়া লাগে আবার সাঁকোর নীচে ভেসে যায়
এই অন্তহীন ভাঙা গড়ার খেলায় খোলা নর্দমার ভেতর জমতে থাকে ধাতুমল
মৃত্যুর সমূহকালে রাসায়নিক বিপাকে বের হয়ে আসা উৎকট দুর্গন্ধে পিত্তি গলে যায়
আর নির্বিকার আমরা যে যার কাজে মগ্ন হয়ে থাকি

অস্থিঘর

শূণ্যের ভেতর যেতে যেতে
কখন আকাশ পার হয়ে গেলাম,বুঝি নি

যখন মাঠের শেষে এক অস্থিঘর
চারপাশে স্তুপীকৃত হাত,পা ও করোটি
শূণ্য চোখের কোটর

ছেঁড়া চটি,লুঙ্গি ও কাঁচুলি দেখে বোঝা যায় নারী ও পুরুষ

এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে সত্যি যে এরাও একদিন বেঁচে ছিল

চেনামুখ

অর্ধেক জীবন;যার জন্যে নিরন্তর প্রস্তুতি ও
নিজেদের ভেবে নিতে হয় অতিকায় গুহা মানবের ছায়ারুপে
আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ঘিরে বসে থাকি শীতার্ত পৌষের গোটা রাত
এবং আমরা নিঃশব্দে বসে থাকি,মানবীর চোখে বিষাদের প্রতিচ্ছায়া
মাথার ওপর নিরপেক্ষ বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর পার্থিব শব্দে
কেঁপে ওঠে বনভূমি

অসুখী শকুন ঘোরে
ঘরের চারপাশের বৃত্ত ভেদ করে কি খুঁজছে
তবে কি এখানে আজ, কাল বা পরশু ধেয়ে আসবে মড়ক ও মারী

পরিপক্ক ফল তোমার মুঠোয়--ব্যর্থ ামার এ হাত ফিরে আসে
ছন্নছাড়া শিরা-উপশিরা ব্যাপী অপমান
আমাদের সাবলীল পরিত্রাণ নেই
ম্লেচ্ছ ডোবা,অনাদেয় তপশিলি ঋণ----
প্রতিহত পথ আমাদের বাড়ীর উঠোন ঘিরে

আমার নিজের আয়নায় কোন চেনামুখ নেই
 

পাঁজরের হাড়ের মশাল

চারপাশের কাজল পরিবেশ,পাথরের গায়ে জলের ঝাপট
সাঁকো পার হতে থাকা সন্ন্যাসীর নগ্ন পায়ে বেজে ওঠে পাথর,ধূসর নুড়ি
অমীমাংসিত আঙুলের খাঁজে খাঁজে যাত্রাক্ষত
কুন্ডলিত রাত গলে পড়ে ভেজা কুয়াশায়
ভিখারীর শূণ্য করতলে ভরে ওঠে ম্লান উপত্যকা

কাগজের মত সাদা মুখ
তোমার চুলের ডগা ফেটে বেরিয়ে আসছে রক্তমেঘ
গাছের পাতায় ছিল প্রাচীন পাঠমালার নিস্পৃহতা আর
আমাদের বুকের ভেতর আগুনজলের ধোঁয়া
শরীরের ফাটলে ফাটলে জাতকের বীজ

শুয়ে আছে বসুন্ধরা,--শরীরবিহীন
ছড়িয়ে দিয়েছি কথামালা---অসাড় আঙুলে
এখন শীতের শুরু---আরেক শীতার্ত রাতে
ডানায় রক্তের দাগ মেখে উড়ে গিয়েছিলে,অপারগ ভেবে

যদি অন্ধকারে পথ খুঁজে না পেলে আমার
পাঁজরের হাড়ের মশাল জ্বেলে নিও

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪

উর্ধ্বগ্রীব,কাতর প্রেমিক

পুড়ছে স্বপ্নের তাবু
তার ধোঁয়া এসে লাগছে চোখের কোণে
স্বপ্নশেষ;সব উর্ধ্বশিখা উঠে যায় আকাশের দিকে
উর্ধ্বগ্রীব,কাতর প্রেমিক আমি---
হৃদয়রহিত অন্ধকার চারপাশে,শুয়ে আছি
টিলার ওপরে,রাত শেষ---

প্রতিপলে অভিমান,মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে অমোঘ নিয়তি
সহজ স্রোতের বিপরীতে
তুমি কতদূরে যাবে কীর্তিনাশিনী,মানবী
ভ্রুক্ষেপহীন শরীরে জ্বেলেছিলে আত্মমগ্ন বালির প্রদীপ
খরার অগ্নিতে ঠোঁট জ্বলছিল
বৃষ্টি দিয়েছিলে,আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণ
বৃষ্টির চাঁদরে মুড়ে নিয়েছিলাম শরীর,আমাদের
সমর্পন শেষ হয়ে গেলে ছায়া ছুঁয়ে সরে গেলে ভ্রুষ্ট রাতে
আমি করতল পেতে ধরেছি রক্তপাথর,শ্লেষ

তার কিছু ভাগ নাও

নাগরিক বাস্তবতা

স্ফটিক সময়ে দূরাগত শব্দে তোমাকে ডেকেছি,
শুনেছ সে ডাক?
উলটোমুখে বালির ঝড়ে পেতে রাখা জাল,গাছের পাতারা খসে পড়ে
নিষ্প্রাণ আঙুলে সাড় নেই---অনুচ্চার অভিযোগে ধ্বংসস্তুপে শুয়ে ভাবিঃ
কোনদিকে যাব,কোথায় আমার আলো জ্বালা ঘর?

নীল শরীরে ভগ্নাবশেষ জমে আছে।
রাত্রিবেলার বিশ্বাস,শিশিরপতনে নষ্ট হয়ে গেছে ইন্দ্রিয়স্বভাব।
এমন আচ্ছন্ন দীর্ঘ বটের সমকালীন ঝুরি
পাখিকল্প সকালের আলো ফোটার আগেই খালপারে এসে দাঁড়িয়েছি।
দূর দেখে দেখি তোমার স্বাচ্ছন্দ্যঃ
ইট-সিমেন্টের স্নেহদাগে তোমার ঘরের জানালায় পর্দাঘেরা আলো,
বারান্দায় সংহত মালতীফুল।

শেষ বিকেলের আলো গায়ে ধূলোপায়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম,
'নাগরিক বাস্তবতা শিখে নাও'---বলে পাথরচোখে তাকিয়েছিলে।

নাগরিক বাস্তবতা আজো শেখা হল না,আমার।

উজ্জ্বল প্রুতিশ্রুতি

মুখ পুড়ে গেছে।মুখ পুড়ে গেল খুব ক্লান্তি জমে জমে।
স্থির অনবার্যে আমাদের সব উৎসবের শেষে এক অবিরুদ্ধ স্রোত।
বালির প্রদীপ জ্বেলে জন্মান্ধের কানে একা শুনিয়েছি ঢোল-করতালের মিশ্রিত গান।
চারপাশ আলো করে ফেটে আসে চুম্বনলোলুপ মেঘ।

প্রতিপদের একলা চাঁদে লেগে আছে কংকাল,পঞ্চাশমারি কাল,
সে কি মুছে যাবে যমুনা,ব্রক্ষপুত্রের তীরে?
ভীড় করে আসা অন্ধকার মুখ,---
তাদের প্রার্থিত দাবী,'আলো।'
মাথার ভেতর জেগে ওঠে এক অক্ষৌহিনী সোনামুখী সুঁই।

আমি কোথা থেকে আনব উজ্জ্বল প্রুতিশ্রুতি।

বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৪

সম্ভাবনাহীন স্বপ্ন

সারাদিন মগ্ন অবকাশে পরিচিত বাগান,চড়ুই
স্বপ্নের নিভৃতে স্থলপদ্ম কেবল নিপূণ বিন্যাসের,---
অন্ধকার সিঁড়ির বিষাদে বোবা মাকড়সা জাল বোনে
দেখিঃদুপুরের হলুদ বেলায় মালতী ফুলের প্রীত অনুচ্ছ্বাস।

এমন অরক্ত দিনে তুমি ঘরের জানালা বন্ধ করে বসে আছ?

ঘরের ভেতর আলো নেই।বাইরে স্থলপদ্মের দীপ্তি।
করোটির শ্বাসভূক বইগুলো ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে।
একদিন এই বইগুলো স্থবির,নির্বোধ কোলাহলে আলো জ্বেলেছিল।

এখন সময় পতনের।

মনে আছে,জীর্ণ পুঁথি হাতে এক ভিক্ষু এসেছিল গ্রামের মেলায়,
তার নাম জিজ্ঞেস করিনি।
কি ছিল পুঁথিতে?গোলাপগাঁথা,রঙিন কল্পচিত্র শেকড়ের আদিপ্রাণ?
বিরুদ্ধ বাতাসে ভেসে আসে ভাসানের গান,বাজছে বিসর্জনের ঢাক।
উত্তরাধূনিক বিবর্তনে চাঁপা পড়ে গ্যাছে নির্মাণের ইতিহাস।

আমাদের সন্তানেরা জিজ্ঞেস করবে,'নীলিমার আলো কই গেছে?'
ছিল কোনদিন?
প্রিয় মিথ্যেগুলো সমূহ স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের জলে মিশে যাচ্ছে।
আর অলীক বিশ্বাসে জেগে উঠে দেখিঃ

ছাতিম গাছের নীচে দ্বিতীয় নির্মাণে শব্দভূক কবি স্বপ্ন দেখে,সম্ভাবনাহীন।



অহিংস নীতি

একাদশীর একলা চাঁদ মেঘ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে
হলুদজল সময়ে।জঙ্গলের মাঝখানে নীল জলাশয়।
আহত শুকর জল খেতে খেতে কাদার ভেতর গড়াগড়ি খায়
পিঠে অর্বুদ কালের ক্ষত,নখ বেঁকে গেছে
কুন্দ বনের ভেতর ছোট্টো ছোট্টো পায়ে যেতে যেতে।
বিবসিত শরীর দহনে জেগে ওঠে অহিংসার নীতি
লাফ দেয় ক্ষিপ্র চিতার মতোন---বুকে থাবার আঘাত।

আমি বুক চেঁপে বসে থাকি,
আমার মাথার চুলে সমুদ্দুরের বাতাস বেঁকে যায়।

শুকরের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শ্বাসে

জলময় আঘাতে আঘাতে পিঠে রক্তজবার মতোন দুর্গলিত ক্ষত
দেখো অবশেষে তবু পাপের অভ্যাসে আমাদের অস্পষ্ট দু'হাত
মৃত্যুর মুহূর্তে ভিন্নতায় ডুবন্ত পাথর খোঁজে
জীবনের এত গতি অথচ শরীর ভরে আসে রক্তাপ্লতা,পাথরপ্রকীর্ণ দুঃখ
শরীরের প্রতি রোমকুপে জমে ওঠে লোহা,সীসা,গন্ধক,আঁকরচূর্ণ

শুকরশব্দে পৃথিবী কম্পমান,রাত্রির অব্যবহিত সময়ের পরে
শুকরেরা নিয়ে আসে মদ,মাংস,মধূ,দুধের বোতল
বালতির জলে অপর্যাপ্ত স্নান এবং পরধর্মময় সূর্য
ছিঁড়ে ফেলে জন্ম ও মৃত্যুর আপাত পার্থক্য

স্ব-শিক্ষিত বেশ্যাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল না
আত্ম-পরান্মুখ পৃথিবীতে এই শব্দের আধিক্যে
আজ দেখি পথ,নগর,প্রান্তর সব প্রদোষের অন্ধকারে নিমজ্জিত

প্রবল বর্ষণে ফুঁসে উঠছে সমুদ্র,তলদেশে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ
তারপর ধোঁয়া ও ধোঁয়ার মেঘে ঢাকা অপরিণত আকাশ

আর ক্ষতে শুকরের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শ্বাসে জ্বলে ওঠে গাছের পাতারা

মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

ভ্রুণহত্যা

সজল চোখের দৃষ্টি,অশান্ত সংসার ফেলে আমি নেমে আসি খালের শীতল জলে

পূরোনো খালের ধারে অশথগুঁড়ির জট,সমূহ সবুজ স্রোতে প্রবাসী নৌকার সারি
ভূ-গর্ভের কালো হৃৎপিন্ড উপড়ে ফেলে একদিন ভেসে গিয়েছিলাম,সমুদ্রে

সূর্যাস্তের দেশ থেকে নভোমূখ ফেটে খসে পড়েছি শুকনো পাতা ও ধূলোর মতো
খালের জলের ধারে ডুবন্ত পাথর,ঘাট,শ্যাওলায় দেখা যায় রক্তরঙা আভাতাপ,--
লাল জলাধারের ভেতর বালি-লোহাচূর্ণ ঘেঁষা জল ঢুকে পড়ে বুকের পাঁজর ফুঁড়ে

লিপিকার ছিলাম-দেখেছি অন্ধকারে লোকলজ্জাভয়ে কুমারী মা;গর্ভজাত ভ্রুণের সন্তান
দিয়েছিল খালে,বিসর্জন!আজ সেই পাপ দেখো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে কাছিমের চোখে
ভ্রূণহত্যার পাপ ও অনুতাপে সমুদ্রের শেষে সারি সারি নারিকেল ঘেরা শান্ত দ্বীপ

কখন অম্লান মিশে গিয়েছিল

সেদিন অনন্ত মধ্যরাতে বৃষ্টি হয়েছিল,খালের ধারের তাল সুপুরির বাসা ভেঙে
মিশেছিল স্রোতে;অন্ধকার একপাশে--জল তাকে অবিরল ডেকে গিয়েছিল
জলজভূবন ডাঙা আর শব্দের প্লাবনে ছুঁয়েছিল মাটি ও আকাশ---সেতু হয়ে

এখন বৃষ্টির শেষে ভাঙানৌকা পড়ে আছে খালের কিনার ঘেঁষে,অবসাদে
চলে গেছে পরকীয়া প্রেম ও ভ্রুণহত্যার পাপ খালের জোয়ারে ভেসে

নিঃশ্বাসের বিষ

ঋতুর ওপারে এক জন্মবারে----যা কিছু আমার চারপাশে ছিলঃ

পাহাড়ে ঝোলানো সরু সেতু
জলার কচুরিপানা
উঁচু ঘাসের জঙ্গল
নীল জলাশয়
বিজন মন্দির
দেবতা ও কুয়াশার দেবী
প্রতিপদের জ্যোৎস্নার নীল আলো

নিঃশ্বাসের বিষে জ্বলে গেল
পোড়া সেই শক্ত মাটি
আবার বৃষ্টির জলে ভেসে গেল।

কবি ডুবে গেল।কবি ভাসছে,সমূহ স্রোতে।

যাত্রাক্ষত

ক্ষতের ওপর চাপা দিয়েছিলে একতাক দূর্বাঘাস

নদীর এ পারে ঘুমহীন রাত কেটেছিল
সকাল বেলায় উঠে দেখি নদী নেই,সমতল ভূমি

যাও,অধিকার করে নাও সমস্ত রজনীগন্ধা
খুব মাঝরাতের প্রহরে
আমার দু'চোখ দিয়ে ছুটেছে উন্মাদ অশ্ব

ভাবো,পেয়ে যাবে সহজ জীবন
গলানো ধাতুর নীচে হৃৎপিন্ড,হেমন্ত রৌদ্র ছুঁয়ে যায় বর্তুলাকার পৃথিবী
আমার প্রেমিকা নেই দেবী,তুমি অগভীর ঘুম থেকে খোলা মাঠে এসে দাঁড়িয়েছ
মুঠোভর্তি মাটির আঘ্রাণ নাও

আমি এইরকম ভুল করে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম;পাথরখন্ড
পথে পথে সরীসৃপ,একলা সূর্যাস্ত,তীর্থযাত্রী,ভাঙাবাক্স
বৃষ্টিপাতের ভেতর শুয়ে থাকা শব,ডোমের চিৎকার

পায়ে যাত্রাক্ষত নিয়ে ফিরে এসেছি,আমার ক্ষতে
দূর্বাঘাস চেপে ধরো

কবিতার দেয়াল

দুপুরের পথে শুধু একটি নিঃসঙ্গ পাখি চুপ করে পাতার আড়ালে বসে ছিল
আর নিজেদের নিংড়ে সর্বস্ব দিয়েছিলাম---তার হিসেবে নিমগ্ন থেকে
নিদ্রাহীন কবিতার খাতা খুলে দেখিঃ
অক্ষরগুলো উধাও,সাদা পাতায় হৃৎপিন্ড খুলে বসে আছে
আস্ত এক মানবীর ছায়া
জ্বলন্ত ঘাসফুলের মতো,আলো চারিদিকে
চুম্বনলোলুপ মেঘে নিবিড় সম্মতি
যখনই নীচু হয়ে ধরতে গেলাম

ওহ,মা!কোথায় গেলে
অক্ষরেরা ছোটাছুটি করে কবিতার দেয়াল গাঁথছে
আমি চেয়ে চেয়ে দেখি

অন্ধকারের দিক

শীতকালে শালকীর জল সরে গেলে মাথা তোলে কয়েকটি বিমর্ষ পাথর
ঠিক  যেমন দেখেছি পরিত্যক্ত কবরস্থানে করোটিগুলো
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে;শব্দহীন পায়ের পাতায় ঝরে অস্তালোকে।

'সকলের মুখে প্রেতছায়া'বলে হাসে কৃকলাশ পিশাচিনী
চন্ডালের হাতে মদ,---পানপাত্র করোটির
রক্তাবাস,ছেঁড়াচটি,হেতালের লাঠি পাশে শুয়ে
গ্রাম পতনের শব্দে সারা শ্মশ্মাণজুড়ে উৎসব।

চিতার ওপর শুয়ে আছি শব হয়ে
আঁকাবাঁকা পাহাড়ের পাদদেশে নিপীড়িত দেহ
খুলে দ্যায় সমস্ত অন্ধকারের দিক।

সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৪

পথশ্রম

ধ্বংসের কিনারে খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়েছ
তারামুহূর্ত পতন,উপবাসী দিন,সমূহ সংসার,--
ফাঁদ পেতে রাখা আছে,'অপেক্ষায় থেকো,
দিগন্ত উপচে ওঠা নীল ফেনা তার রহস্য হারাবে।'

স্বাতী নক্ষত্রের পাশে দেখি ওই পরিশ্রমী মুখ
ভুল করে ঢুকে পরেছে শামিয়ানার নীচে
সরাসরি,সহজভাবে মুক্তি চেয়েছিলামঃপায়ের পাতা,
গোড়ালি অবধি,হাঁটু....

পথশ্রমের ফ্যাকাশে মুখ চুম্বনে তাতিয়ে তোল।

শহর

দুপুরবেলার বিষন্ন জলে কার ছায়া পড়ে?
বুকে আঁচল জড়িয়ে যাবার বেলায় কেন বলেছিলে,পথে 'রিপুভয়?'
আমি শ্মশ্মাণ পেরিয়ে রৌদ্রনভস্তল শহরে পৌঁছেছি,--
আজন্ম শহরপাপী,খাঁ খাঁ রোদে পীচ গলে
গাড়ীর চাকার ঘূর্ননগতির পাশে মানুষহীন ট্র্যাফিক
ফুটপাতে দোকানের সারি আর পার্কের গাছের নীচে
ঘুমায় হকার,চানাচুর,বাদামওয়ালা।

চোখের জল

মাথার ওপর চৈত্র,মিহি ধূলো বাতাসে উড়ছে।দৃঢ়সম্ভব উপসংহারে
নেমে এসেছি পথের প্রান্তে।দুপুরের ধারাপাতে ধূসর জীবন।
ভাপ ওঠে চারিদিকে।রৌদ্রাহত নির্মলতা ভেঙে তুমি কি ভেবেছ ভুলে যাবে
গতরাতের প্রণয়,মেরুদূরাতীত আত্মপতনের বীজ,
মাটি খুঁড়ে তুলে আনা স্নেহদাগ?
সকালের আলোয় দেখেছি একরাশ রক্তের কাদায় মাখামাখি
শুয়ে আছ,হাঁটু ভাজ,ভ্রুণের আকৃতি।

সুন্দরের মজ্জাহীন শোকের আতসেগড়া রাত্রিগুলো ওড়াও আকাশে
রাজপথ-ঘর-বারান্দা তখন নামহীন অন্ধকারে ডুবে থাকে আর
তোমার মাথার চুল ভিজে যায়।
শরীরের সব দাগ ভেসে ওঠে,রক্তজবা,___
রুপালী পাতারা ফিরে আসে বাতাসে,উঠোনে ঝরে পড়ে
ঘন শীৎকারে ব্যাকুল।

বিচ্ছেদের হেমন্থলুদ পাতা,রক্তবীজের বংশধরেরা
অসাড় দিনের দিকে কতটুকু স্থির---জানতে চেয়েছ?
সবুজ রঙ গাছপালা---স্বপ্নে স্বপ্নে মগ্ন রক্তবাস পরনে,খড়গ,কাঁধে ধনুর্বান
চন্ডাল শিকারের খোঁজে বনের ভেতর
মৃত্যু পাশে রেখে সজাগ রয়েছ?

চোখের পাথর দেখে জেনেছিঃগ্রহনক্ষত্র ছিল একদিন ওই চোখে
তোমার চোখের জ্যোৎস্না পেলে কঠিণ পাথর,
সেও ফেটে যাবে।
অন্ধ করতলে ছুঁয়ে দেখো এ শরীর।

নিরক্ষর বৃষ্টির ভেতর
ছাতা খুলে ধরেছিলাম,আঁচল দিয়ে ঢেকেছিলে,---
নিকষ রাত্রির শব শুয়ে ছিল ঘাটের পৈঠাতে।

পথ হাঁটছি অনন্ত সূর্যকাল থেকে
তোমার স্বাচ্ছন্দ্য দেখি পথের ওপার থেকে।

তোমার চোখের জল ধরে রাখি করপুটে
(আদৌ যে জল তোমার চোখে নেই।)

রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৪

সংহত সংসার

হাঁটুর তলায় অন্ধকার,তরল।একাগ্র মাকড়সা
জাল বুনছে সিঁড়ির নীচে।ভরদুপুরে মেয়েটি চলে গেল।
নদীর ওপারে,ঘোরলাগা বাথানের পাশ ঘিরে।
আজ ছিল তার জন্মদিন।

'সকলের মুখে এত ছায়া' বলে মুছে দিয়ে গেছে
সামঞ্জস্যহীন পরিণতি।শূণ্য থেকে শূণ্যতায়
জলস্তম্ভ উঠে পড়ে রুপালী ঝলকে।অবনত দিনে
মুহূর্তের ঘূর্ণি ভেঙে দেয় সংহত সংসার।

মুক্তি

অনায়াস ইচ্ছের বাতাসে উড়িয়েছ পাল
নদীর ওপাশে অশথগুঁড়ির জট
পথের ফাটলগুলো ঢেকে গেল অন্য গ্রহের ধূলোয় আর
পদ্মার বালিয়াড়িতে ধীবরেরা টেনে তুলছিল জাল

অর্ধেকগড়ন প্রতিমাবলয়,পূর্ব পাথরের দিকে চেয়ে
ছুঁয়ে দিয়েছিলে চেতনার অন্ধিসন্ধি
কবোষ্ণ হাতের রেখা---জল তার চিহ্ন ধরে রাখে
জীবনের দাবী মিটে গিয়েছিল---প্রত্যেক মুহূর্তে
বিস্ফারিত হয়েছিলাম আমরা

অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্যে আমার ক্রমশঃ ঋণ বাড়ে


স্নেহাশীষ,দু'জনের সাজানো জীবন,স্থির,নৈসর্গিক চিত্র,
আনত মুখের ছায়া,আমার দু'চোখে নীল আলো,
হাতে মাটির সানকী

ছায়াপ্রশাখার জটিলতা ঘিরে নেবে আমাদের ঘর-বারান্দা-উঠোন
দীঘিভরা অবসাদ,ভেতরে কী তপ্ত জল
সদাচারী মাতামহ---গোবর নিকানো পূজোঘর
গ্রামান্তরে যাবার বেলায় নীচু হয়ে বলি:

এমন অরব ভালোবাসা থেকে মুক্তি চাইনি কখনো

হোমযজ্ঞ

আগুন---পাতারা পোড়ে।ধোঁয়া ওঠা অগ্নিকুন্ড ঘিরে পূণ্যার্থীর দল।
মৃত্যুকোষ ঢেলে দেই।সিফিলিস,গণোরিয়া----যৌনরোগ,গুপ্তব্যাধী;
তার থেকে একফোঁটা পুঁজ,
ক্রমশ আগুন বেড়ে ওঠে ।
দেহের সরলীকৃত কোষ থেকে খসে পড়ে ছায়াগণিকা,মেনকা,রত্না,উবর্শী অপ্সরীগণ
পরপারের বিপথে উড়ে চলে।

ভরে নাও ঝিনুকখোলের হোমপাত্র ।

রোগজ্বরাগ্রস্ত জীবন----গোঁসাই
কত হোমযজ্ঞে মুক্তি লেখা আছে চতুর্বেদ,পূরাণ ও ভাগবতে?

দূরাগত

অশরীরী অন্ধকার,পেছনে পাতার শব্দ।
কথা ছিল গ্রামান্তরে যাব।শালকীর স্বচ্ছ জলে ছায়া পড়ে।
বৈঠাহীন নৌকা ভাসে।তীর ঘেঁষে খড়ভর্তি গরুগাড়ি।
কোথায় এসেছি?ধূলোওড়া শহরের থেকে দূরে,
চারিদিকে উঁচুনীচু সবুজের ঢল।একদিন প্রচন্ড ঘৃণায়
পরস্পরের শরীরে বেঁধে নিয়েছিলাম ইস্পাত।
আগুন জ্বালিয়ে একে একে খুলছি পোষাক,শরীরের।
শুকনো পাতারা উড়ে যায়।
আমাদের শরীর বিবশ।পড়ে থাক শালকীর বালিতীরে।

আমরা অনেক দূরে চলে গেছি একে অপরের থেকে।

পায়ের চিহ্ন

আমরা বুঝিনি ব্যক্তির আবর্তে ঘূর্ণিঘোর,সময়ের বিলাসীতা
ইস্পাত,অভ্রুর কুঁচি লেগে আছে দাঁতে
ছুঁয়ে দেখেছ সবুজ পাতা,গাছের বাকল কত ঘূণ ছড়িয়ে রেখেছে
মাটির শরীর আমাদের সহজতর স্রোতের উল্টোদিকে ছুটে চলে

আমাদের এই লোকালয়,মাঠ,সড়ক,খামার
এতকাল কেটে গেল,___
ভেঙে ফেলছে পূরাণো বাড়ী--তার দেয়ালে লবণক্ষত
সম্ভবতঃ আমরা পরার্থপর জল এবং পরাহত শতাব্দীর কাছে
বিনাশ চেয়েছিলাম।

যারা পাহাড়ে উঠেছে
যারা সমুদ্রচারী হয়েছে
যারা বন কেটে আবাস গড়েছে
তাদের পায়ের চিহ্ন কতকাল মনে রাখবে,মানুষ

সারিবদ্ধ কবিতা

অস্ফুট শব্দের বোধে,পাঠ-নিরন্তরে আমার কবিতা দেখেছিলে সাময়িকীর পাতায়,
নক্ষত্রের আলোর মতোন এত দুর্গলিত ক্ষত,জন্মবিজন তৃষ্ণামন্দির,পাশে নদ,__
উমাকীর্তিবাবুর চরণাশ্রিত গান-কোথায় হারিয়ে গেছে সান্ধ্যআসর,সাগরদীঘি
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কাঁচপুর ব্রীজ থেকে নেমে এসেছি,ক্ষেতজাঙাল ভালো লাগে, ভালো লাগে
পশুচারণের গীত,বৃষ্টিজলে ধোয়া বন আর রক্ত সমুদ্রের থেকে উঠে আসা মেঘ।
গ্রন্থ অবমাননার কালে শ্মশ্মাণে শুনেছি মৃত পুরুষের কোরাস সঙ্গীত।

ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুব্যাপকতা থেকে দূরে এসেছি,পথের পাশে প্রতিপত্তিময় খড়,
পাতা-বাতাসতাড়িত ফলের বাগান।উঠোনপ্রান্তিক গ্রাম।দুপুরের হলুদ বেলায় ঝরে
কাঠচাঁপা ফুল।গ্রামসীমান্তে কবরস্থান,পরিত্যক্ত।পড়ে আছে অনুশোচক করোটি
এবং কংকালের স্তুপ।যখন জীবন ছিল ছুঁয়েও দেখেনি।ওখানেই থাকে,থেকে যেতে চায়--
স্থবির,নিঃসঙ্গ অভিলাষী স্বভাবী মানুষ ঘরে ফেরে।

আকাশে আলোর রেখা,অর্থের বিকৃতি একদিন ঐ বিশাল বটগাছ উপড়ে ফেলবে;
নীচে,দু'জনের নির্মিত বিকেলে 'ভালোবাসি'বলার আগেই মাঝখানে উড়ে এসেছিল
অন্য গ্রামের ধূলো ও তামাকের গুঁড়া।এলোমেলো আবেগী শৈথিল্যে অপলাপী ভাষার সঙ্গীত
আর বড় হওয়ার গান গাইতে গাইতে অবিশ্বাস করেছিলাম মানুষ এবং প্রেমে।

মহাবিষুবীয় রেখা,সহজ ভূগোল,লাল ইটের সমৃদ্ধ বাড়ী,নূতন সাহিত্যপত্র,
ভষ্মীভূত পার্ক,ভূর্জপত্রে মানুষের কাঁটা-ছেঁড়া ইতিহাস।পরিণতিহীন লক্ষ্যে ওড়ে
শিমুল তুলোর বীজ।ঔষধির ক্ষেত-সহস্র একর অনুর্বর ভূমি,গুল্মলতা ভরা।

বেদনা-আহত হাসি নিয়ে দেখি ঐ জানালা খোলা।গ্রাম্য গণিকার উঠোনে ভীড়,
সালিশ বসেছে।আত্মআবিষ্কারে মেতে উঠি--শব্দময় মূর্ছায়,পতনোন্মুখ।

ঝড় ও জলের আঁচে লেখা আমার কবিতাগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে।
তা আজও পড়া যায়।ইচ্ছে হলে,দেখো।



শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৪

মহাজাগতিক লাটিম

গৈরিক সন্ন্যাসে দুপুরের প্রতিহত পথে কেঁপে ওঠে শালের মামল্ল পাতা
আদিবাসী যুবতীর শরীরে অঘ্রাণ,বৃষ্টিহীন দুই হাত
উঠে যেতে চায় বুকে।দেখেছি বনের পাশে
পাথর ও শ্যাওলার অন্ধকারে এক ধ্বংসস্তুপ।

অতর্কিত অন্ধকারে জ্বলে নিষ্প্রাণ আঙুল,ঝর্ণা
ধ্বংসস্তুপের ভেতর নামে চাঁদ,গ্রীষ্মের জলপতঙ্গ--ভেসে যেতে শূণ্যের ভেতর
বায়ূযান,মন্দিরের ছড়ানো চত্বরে শুয়ে আছে কাপালিক
গায়ে বাঘছাল,ইতস্তত ছড়ানো নরমুন্ডের মালা।

যেদিন ভাষার জন্ম হল--সেদিন থেকেই
আপ্লুত আহ্লাদে হাত বাড়িয়ে বলছেঃএসো
অর্থাৎ আলো ও অন্ধকার পৃথক হয়েছে
অনুচ্চার অভিযোগে স্থির মাকড়সাজাল,ঝুল,কড়ি-বরগা,মরচে ধরা লোহা
সংসারের কোণে,দেয়ালে,উঠোনে রুদ্রজটাজাল,পোকামাকড়ের গ্রন্থি
পথের ফাটলে ব্যক্তি-শ্বাপদের শ্বাস---কান পেতে শুনছে কুকুর।

দূরে,নদীতীরে বটের শেকরে জলস্পর্শ
মাটির গভীরে শোনা যায় মহাজাগতিক লাটিমের ঘূর্ণি
পৃথিবী ঘোরার শব্দ,কক্ষপথব্যাপী...

বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৪

যুদ্ধের কবিতা

উদ্বেগ ও ভয়াবহতার স্বপ্নের ভেতর কাল অগভীর ঘুমে কেটে গেছে রাত।
ভরা জ্যোৎস্না ছিল।ছিল কুকুরের করূণ বিলাপ।
খাপ খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যেরা নেমেছে স্বপ্নে।
কিছুটা রহস্যে তারা খুঁড়েছে মগজ
।'এর মগজে কবিতা','এটা ফেলে দাও','কি হয় কবিতা লিখে?
'বলাবলি করতে করতে এরা অযথাই যুদ্ধ করছিল নিজেদের সাথে।

সন্ত্রাস ও সিকি-আধুলির শব্দে তোমাকে শোনাব আজ যুদ্ধের কবিতা।

অনতিক্রমণীয় ভবিষ্যৎ

জল থেকে পৃথক---যথার্থ এবং অনিবার্য প্লাবনসীমার মুখোমুখি
পশুহত্যার সন্ধ্যায় শালকীর ঘোলাজল উঠে আসে উঠোনে,দেয়ালে
আকাঙ্খার ভেতর ডুবন্ত মানুষের নিঃশ্বাসে বুদবুদেরা নক্ষত্রের মতো জেগে ওঠে
বর্গক্ষেত্রের চারটি বাহু যথা;আমি।পূর্ব।হৃদয় এবং পশ্চিম
পালানোর সব পথ একে একে বন্ধ হয়ে গেছে
বরঞ্চ কাঁটাতারের বেড়া কেটে নাও

কৈবল্য মানি নি অথচ ভবিষ্যতের সংলাপের রাশি,পূরাণো কবরখানা---
যাদের জীবন ভেঙে গেছে,মানুষ সম্পর্কে ভাবিঃ
সংকুচিত কর্ম,ঘুম ও বিচরণের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ আবাস
পাকা ডালিমের মতো ফেটে নগ্নতা বেরিয়ে আসে
অনতিক্রমণীয় একটা ভবিষ্যৎ ঘনিয়ে তুলছে প্রলম্বিত অনির্ভর
প্রশ্নাতীত নিঃসংশয়ে বর্তমান এবং বাতাসের অন্তর্বর্তী নীরবতায় নিমগ্ন
মরণশীলতা নয় মৃত
আমার পবিত্র প্রার্থনার ধ্বনি জীবিতদের জীবনে এবং মৃতদের মৃততেও সম্ভবতঃ

বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

ভ্রষ্ট

অপলাপী ভাষার কবিতা,তারবার্তা;যা ভাঙবার নয়,---
তাও ভেঙেছিলাম পৌষের শীতে।সুযোগ সন্ধানী কিছু ফুল
ঝরে পড়ে চৈত্রের দুপুরে।যে সরলতা জীবনের কাছে প্রাপ্যনীয়--
ঝরে পড়ছে অবলীলায়।আমাদের পশুআত্মা উঠে এসেছে সমুদ্রস্নান শেষে
তার গল্প বাঁশবনে,হলুদ পাতায়।
খসে পড়ে বুকের ওড়না।উড়ে যায় ছেঁড়াখোড়া পাল।

প্রতিমুহূর্ত পরিবর্তিত। শহরের নূতন রাস্তার মোড়ে
মাদারী বসেছে।তার ঝাঁপিতে নানান বুজুরকি।
তাকে ঘিরে আছে উৎসুক বালক এবং বাজার ফেরত লোক।

বস্তুজগতের টুকরো,বিচূর্ণ রৌদ্ররশ্মিকণা,বৃষ্টিমুখর বালকবেলা
বিশুষ্ক ফলের মতো আমাকে ভাসিয়ে নেয় দূর কোন শূণ্যে।
আফ্রোদিসিয়াক নেশায় আচ্ছন্ন ভাবি উত্থানপতনে আমি এক ভ্রষ্ট রাজা।
রঙমহল,বাঈজী,সাকী---চারিদিকে সুরের মুর্ছনা
একেকটি সুরের জন্মরহস্য নির্জীব রেণুর পুঞ্জে কিংবা ফুলের কোরকে।
কাল-মহাকালের আবহমানতার গোপণ গহ্বরে।

অথচ আজও কেন সুর হলাম না
কেন গান হলাম না?