Powered By Blogger

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনাঃপর্ব-১

Art শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল 'শিল্প।' ল্যাটিন শব্দ Ars থেকে গ্রিক ভাষায় বিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজীতে Art শব্দটি এসেছে। আদিমকাল থেকেই মানুষ নিজের অজান্তেই শিল্প সৃষ্টি করে আসছে।অরণ্যচারী,গুহাবাসী মানুষ শিল্প কি জানত না,বুঝত না শিল্পের স্বরুপ কি।আদিম মানুষ অন্ধকার দেখে,আগুন দেখে ভয় পেত, তেমনি পূর্ণচাঁদের আলো দেখে মোহিত হত,শিকার করা পশুকে ঘিরে গোল হয়ে মনের আনন্দে নেচে চলত।।নিজের বাসস্থান গুহায় এঁকে রেখেছিল কল্পিত দেব-দেবী,শিকার দৃশ্য কিংবা স্বাভাবিক,দৈনন্দিন জীবনের চিত্র। এগুলো সবই শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর যে কোন শিল্পই দৃষ্টিনন্দন বা নান্দনিক। মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ-কর্মে যে সৌন্দর্য্য ফুটে ওঠে তার সবই নান্দনিক। নিজের আলুলায়িত কেশ যখন কোন রমণী পরিচর্যা করে কিংবা ফুটপাথে বে-আব্রু রমণী সর্ব-সমক্ষে স্তন উন্মুক্ত করে তার সন্তাঙ্কে দুগ্ধ পান করানোর ফলে যে সৌন্দর্য্যটুকু ফূটে ওঠে তার সবই নান্দনিক। W.B.Warsfild তাঁর Juddgement in literature বইয়ে স্পষ্ট বলেছেন, 'Arts is an element in the life civilizeds man.' মানুষের জীবন জটিলতম অধ্যায়। জীবনকে সাজাতে হয় নানা প্রকরণে। কারো কারো মতে এই প্রকরণই নন্দন ত্তত্ব।নন্দনত্তত্বের সঙ্গে সৌন্দর্য্যবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকের কাছে নন্দনতত্ত্বই হল সৌন্দর্য্যতত্ত্ব।নন্দনত্তত্বের সংজ্ঞা নির্ণয় খুব সহজ কাজ নয় এর পরিধির ব্যাপক ও বিশালতার কারণে ।J.A.Cuddon তাঁর Penguin Dictionery of literary Terms and literary theory বইয়ে নন্দনত্তত্ব সম্পর্কে লেখেন,
''aestheticism:A complex term 'pregnant' with many connotations.The actual word derives from Greek aistheta 'thing perceptible by the senson':and Greek aisthetes denotes 'one who perceives.'

এই Aesthetics শব্দটি গ্রিক 'aisthesis' থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজীতে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গ্রিক 'aisthesis' শব্দটির অর্থ sense perception বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষতা। অন্য কথায় নন্দনতত্ত্বকে প্রত্যক্ষণ শাস্ত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রাচীন সংস্কৃতে যাকে বলা হয়ে থাকে  'বীক্ষণশাস্ত্র'।বীক্ষণ শব্দের অর্থ বিশেষভাবে দেখা। অর্থাৎ গ্রিক প্রত্যক্ষণ ও সংস্কৃত বীক্ষণ একই অর্থ বহন করে থাকে।
Aesthetics sশব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলেন তার সঠিক কোন হদিস পাওয়া যায় না ।তবে বাউম্ গার্টেন Meditationes philosophicae de nanullis ad poema pertinentibus বইয়ে প্রথম এই শব্দটির ব্যবহার করেন। এরপর ইমানুয়েল কান্ট Aesthetics শব্দটি ব্যবহার করেন ১৭৯০ সালে প্রকাশিত Critique of Judgement বইয়ে। F.T. Vischer তার Aesthetik oder Wissen Schafides Schonen শীর্ষক বইয়ে ১৮৪৩ সালে শব্দটির ব্যবহার করেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত G.T Fechner এর পর Vorschule der Asthetik বইয়েও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। ইউরোপীয় দর্শন চর্চায় Aesthetics শব্দটির অর্থের এই বিশেষীকরণ ব্যাপারটি হেগেল তাঁর Aesthetics বইয়ে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লেসিং,শিমার,গোয়েটে,শেলিং,শোপেন হাওয়ার,হিউম,বার্ক,রাস্কিন,ড্রাইডেন,পোপ প্রমুখ কবি ও দার্শনিক চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করেন। আর ক্রোচে নন্দনতত্ত্বকে দার্শনিক তত্ত্বের রুপ দিলেন তাঁর শিল্পতত্ত্ব ও শিল্পতত্ত্বের ইতিহাস বইয়ে।
বম গার্টেনের মতে,যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের লক্ষ্য সত্য,নান্দনিক জ্ঞানের লক্ষ্য সৌন্দর্য্য।বিচার ও পর্যবেক্ষন দ্বারা উপলব্ধিজাত চরম উৎকর্ষতাই সত্য।সৌন্দর্য্যের লক্ষ্য নির্ভেজাল আনন্দের উদ্রেক।সৌন্দর্য্যের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি প্রকৃতির অনুকরণ।
মেলডেনসন এর মতে,'সৌন্দর্য্যের বিকাশই শিল্প।' প্রকৃত পক্ষে মানুষের রুচিই সুন্দরের স্বরুপ নির্ধারণ করে থাকে।তবে রুচি সম্পর্কিত বিধি-বিধান অলিখিত এবং কোনো আইন-কানুন বা বিধি নিষেধ দিয়ে এর সীমা নির্ধারণ করা যায় না।

ডাচ লেখক হেমস্টার হুইস মনে করতেন,আনন্দ বিধায়ক বস্তুই সৌন্দর্য্য এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রচুর অনুভূতির সঞ্চারক বস্তুই সর্বাধিক আনন্দদায়ক এবং স্বল্পতম সময়ে বৃহৎ পরিমাণ অনুভূতি সঞ্চারক বলেই সুন্দর বস্তুর উপভোগ মানুষের অধিগম্য মহত্তম সংবেদনা।

কাল পরিক্রমায় সৌন্দর্য্যবোধ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে।নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সৌন্দর্য্যের সনাতন ধারণা নয়,মানুষের চিন্তা,চেতনা এবং সৃজনশীলতার ভিত্তিতে যে আনন্দময় অপরুপ এক জগতের সৃষ্টি হয় তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।যখন এই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রচলিত ছিল না তখনো এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও অনুশীলন হয়েছে।

বেনেদিত্তো ক্রোচে শিল্পসৃষ্টি ও নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিষয়ে নূতন বক্তব্য রেখে নান্দনিকতার কেন্দ্রীয় অবস্থানে পরিবর্তন এনে দেন। ''শিল্প মানে প্রকাশ,প্রকাশ মানে সজ্ঞা(ইনট্যুইশন),শিল্প প্রকাশের সমার্থক এবং প্রকাশ আর সজ্ঞা একই।'' শিল্পবোধের সৌন্দর্য্য বিমূর্ত বা মূর্ত নয়,সফল প্রকাশ।শিল্পের এই সফল প্রকাশ সৌন্দর্য্য কিংবা সৌন্দর্য্য ব্যতিরেকে হতে পারে।বেনেদিত্তো ক্রোচে মনে করেন শিল্পের এই সফল প্রকাশই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব এর মূল বিষয়।

বম
গার্টেনের মতে,যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের লক্ষ্য সত্য,নান্দনিক জ্ঞানের লক্ষ্য
সৌন্দর্য্য।বিচার ও পর্যবেক্ষন দ্বারা উপলব্ধিজাত চরম উৎকর্ষতাই
সত্য।সৌন্দর্য্যের লক্ষ্য নির্ভেজাল আনন্দের উদ্রেক।সৌন্দর্য্যের সর্বোচ্চ
অভিব্যক্তি প্রকৃতির অনুকরণ।

মেলডেনসন এর মতে,'সৌন্দর্য্যের বিকাশই
শিল্প।' প্রকৃত পক্ষে মানুষের রুচিই সুন্দরের স্বরুপ নির্ধারণ করে
থাকে।তবে রুচি সম্পর্কিত বিধি-বিধান অলিখিত এবং কোনো আইন-কানুন বা বিধি
নিষেধ দিয়ে এর সীমা নির্ধারণ করা যায় না।


ডাচ লেখক হেমস্টার
হুইস মনে করতেন,আনন্দ বিধায়ক বস্তুই সৌন্দর্য্য এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে
প্রচুর অনুভূতির সঞ্চারক বস্তুই সর্বাধিক আনন্দদায়ক এবং স্বল্পতম সময়ে
বৃহৎ পরিমাণ অনুভূতি সঞ্চারক বলেই সুন্দর বস্তুর উপভোগ মানুষের অধিগম্য
মহত্তম সংবেদনা।


কাল পরিক্রমায় সৌন্দর্য্যবোধ সম্পর্কে
মানুষের ধারণা বদলে গেছে।নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সৌন্দর্য্যের
সনাতন ধারণা নয়,মানুষের চিন্তা,চেতনা এবং সৃজনশীলতার ভিত্তিতে যে আনন্দময়
অপরুপ এক জগতের সৃষ্টি হয় তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।যখন এই Aesthetics
বা নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রচলিত ছিল না তখনো এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও
অনুশীলন হয়েছে।


বেনেদিত্তো ক্রোচে শিল্পসৃষ্টি ও
নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিষয়ে নূতন বক্তব্য রেখে নান্দনিকতার কেন্দ্রীয়
অবস্থানে পরিবর্তন এনে দেন। ''শিল্প মানে প্রকাশ,প্রকাশ মানে
সজ্ঞা(ইনট্যুইশন),শিল্প প্রকাশের সমার্থক এবং প্রকাশ আর সজ্ঞা একই।''
শিল্পবোধের সৌন্দর্য্য বিমূর্ত বা মূর্ত নয়,সফল প্রকাশ।শিল্পের এই সফল
প্রকাশ সৌন্দর্য্য কিংবা সৌন্দর্য্য ব্যতিরেকে হতে পারে।বেনেদিত্তো ক্রোচে
মনে করেন শিল্পের এই সফল প্রকাশই Aesthetics বা নন্দনতত্ত্ব এর মূল বিষয়।

প্লেটো শিল্পকে মনে করতেন মিথ্যার জগৎ কেননা শিল্প হচ্ছে,''বিশেষের প্রতিভাসের অনুকরণ,'' বা ''Imitation of Imitation.''

শিল্প
অনড় বা স্থবিরতা থেকে মুক্তি চায়।অনড়ত্ব বা স্থবিরতা থেকে মুক্তিলাভই
হচ্ছে শিল্পের সার্থকতা।যে কোন শিল্পই মানুষের মনে আনন্দের অনুভূতি
জাগায়।কিন্তু প্লেটো মনে করতেন শিল্পের আনন্দ পরিশেষে মানুষকে ভোগের পথে
নিয়ে যায় এবং তাকে নীতিগতভাবে আদর্শভ্রষ্ট বা বিপথে চালনা করতে
পারে।প্লেটো আরো মনে করতেন শিল্প যেমন একদিকে নিছক আনন্দ সৃষ্টি করে
মানুষকে ভোগের পথে নিয়ে যায়,তেমনি শ্রোতা বা দর্শক বা পাঠককে ভাবাবেগে
আপ্লুত করে ফলে সমাজ ও নৈতিক জীবন অবক্ষয়ের পথে যেতে পারে।সে কারণে প্লেটো
শেষ পর্য্যন্ত শিল্পের জগৎকে প্রকৃত reality'র জগৎ বলে মনে করতেন না,মনে
করতেন appearance এর জগৎ।পরিশেষে এই মিথ্যার জগৎ অমঙ্গল্বোধ জন্ম দেয় ফলে
নৈতিকদৃঢ়তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।প্লেটো তাঁর বিখ্যাত 'Republic'
গ্রন্থে কবিদের ধান,দূর্বা ও চন্দনকাঠ দিয়ে নির্বাসন দিতে
চেয়েছিলেন;যারফলে প্লেটোরও ঠাঁই হয় নি কবিতার ইতিহাসে।।প্লেটোর প্রিয় কবি
ছিলেন হোমার।সাফোর কবিতাও পছন্দ করেছিলেন তিনি।প্লেটো নিজেও প্রেমের আবেগে
গদগদ দু'চারটে পদ্য লিখেছিলেন কিন্তু প্লেটোকে একজন ব্যর্থ বা সার্থক কবি
বলা যাবে না কারণ তিনি কবিতার সাধনায় সিদ্ধি খোঁজেন নি।যেহেতু মানুষের
চিন্তারাজ্যে প্লেটোর দর্শন আজও শেষ হয়ে যায় নি আর তাই তাঁর কবিতার পাঠক
এখনো খুঁজে পাওয়া যায়।
(অসমাপ্ত)

সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১.বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্বঃমাসুদুল হক।
২.শিল্পের স্বরুপ/লিও টলস্টয়।অনুবাদঃদ্বিজেন্দ্রলাল নাথ।
৩.সবার জন্য নন্দনতত্ত্বঃহাসনাত আবদুল হাই।
৪.কবিতার বীজতলাঃআবু হাসান শাহরিয়র।
৫.নন্দনতত্ত্বঃডঃ সুবীর কুমার নন্দী।
৬.নন্দনতত্ত্ব এর সূত্রঃ অরুণ ভট্টাচার্য।
৭.নন্দনতত্ত্বঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
৮.নন্দনতত্ত্বে প্রতীচ্যঃ ড.সুখেন বিশ্বাস।
৯.নন্দনতত্ত্বে প্রাচ্যঃড.সুখেন বিশ্বাস।
১০.সঙ্গীত ও নন্দনতত্ত্বঃসুচেতা চৌধুরী।
১১.মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্যবিচারঃঅরবিন্দ পোদ্দার।
১২.নন্দনতত্ত্ব-জিজ্ঞাসাঃতরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
১৩.আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্বঃ জিললুর রহমান।
১৪.A Guide To Aesthetics:Prof.Prabasjiban Choudhury.
১৫.Studies In Comparative Aesthetics: Pravas Jivan Chaudhury.
L

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন