Powered By Blogger

রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১০

স্বতন্ত্র ধারার চতুর্দশপদী-৫

উচ্ছেদের হরতালে ডোবে রাজপথ,পোড়ে গাড়ী
হিমবাহ চেপে বসে ক্ষমতাসীন ও হীনতার
স্থায়ী গোপণ বৈঠকে সত্য বিতাড়িত হয়ে যায়
সিডরে বিলীন হয় জনপদ চোখের পলকে
কামাসাক্ত লালসায় প্রতারিত নির্বাক কিশোরী
উদাস তাকিয়ে দ্যাখে : প্রজাপতি ডানার সঞ্চার
সম্পদের মালিকানা চলে যায় অসুষমতায়।

মানুষ নদীর কাছে নেয় চলমান জীবনের
পাঠ,সমুদ্রের কাছে শেখে গভীরতা,উদারতা
শিক্ষা দ্যায় নীলাকাশ;আদিমতা শেখে ঘূর্ণিঝড়ে
দৃপ্তপদে জীবন এগিয়ে যায় জীবনের দিকে
চিরকাল য্যামোন গিয়েছে;শেখে সবুজ বনের
পেলবতা,মৌল পাঠশালা পৃথ্বী দিগন্তবিস্তৃতা
সয় পাষাণ কালের চিহ্ন,প্রেম ঝরে ঝরে পড়ে।


২৮.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১০

চতুর্দশপদী,অন্যরকম

( হাসানআল আব্দুল্লাহ শ্রদ্ধাষ্পদেষু )

নিস্তব্ধ শবের পাশে থেকে মৃত্যুবোধে নয়,গাঢ়--
জীবনবোধে আচ্ছন্ন,বিমর্ষ থেকেছি গোটা দিন
ভালোবাসা পাবার পরই মনে হয়েছে বিরহ
কত সুখের মানবী!জোস্নার কাফন মোড়া রাতে--
মনে হয় বর্ষণমুখর রাতের মতোন দৃঢ়
আসক্তি কিছুতে নেই।যুদ্ধ অপব্যয়ী,অর্থহীন--
উপদ্বীপে অবিরত বয়ে যায় যুদ্ধের আবহ!



সন্দেহের তীব্র বিষে নীলাভ উত্তরাধুনিকতা
বিবর্তিত হয়ে যায় শিল্পকলা-কবিতা,মননে--
মানব-স্বভাবে রয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিকতার
জ্বীন,মূল্য বাড়ে নান্দনিক গোলাপের,পৃথিবীতে!
ব্যর্থতায় অন্ধকারে মুখ লুকায় মানবিকতা
সুষম সমাজ সাম্য মৈত্রী রচিত কবির স্বপ্নে
ভার নিতে অপারগ হয় কদর্য,নিঃস্বতার।

২৫.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

বুধবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১০

অন্যরকম চতুর্দশপদী

মৃত্যুও জন্মের মতোনই আনন্দময়, বোঝেনা--
মানুষ অবুঝ তাই ছুটে ছুটে যায় ক্লান্তিহীন
জীবনের দিকে;গতি,শক্তিহীনতাই মৃত্যু,স্থিরঃ
স্থিরতার কি ক্ষমতা বহমান জীবন থামিয়ে
দ্যায়,বাস্তব তাড়না কি মেটায় অজানা,অচেনা
স্বর্গ?নরকের লেলিহান আগুনে সমস্ত দিন
জ্বলেও কি ছারখার হয় সীমাহীন পাপাচার?

মূঢ় পশুর মতোন তাকিয়ে দেখেছি :সভ্যতার
গর্ভে ধাবমান নান্দনিক প্রেম জীবন উল্লাস
ভেসে যায় ঘুর্ণিঝড়ে,প্রেমহীন যৌনাচারে লিপ্ত
মত্ত দাম্পত্য যুগল!শতাব্দীর জঞ্জাল এড়িয়ে
চলে স্রোত,সময়ের। পাষাণ অমানবিকতার
লীন হয় ইতিহাসে,প্রিয় মানবীর তপ্ত শ্বাস
বুকে নিয়ে মানব নূতন মন্ত্রে আজ উজ্জীবিত।

২৪.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১০

শিরোনামহীন

চৈতালী খরায় পোড়ে মাঠ,কাঁদে শিশু অনাহারে
একটানা ডেকে যায় পেঁচা, গাছের শুকনো ডালে
ডেকে যায় কাক;ক্ষুধা ও তৃষ্ণার তীব্র যাতনায়
জর্জরিত স্ফীত উদরের আত্মজার কংকাল
কাধে স্তনহীনা নারী ফুটপাথেই এলিয়ে পড়ে
পথচারীরা ভূলুন্ঠিতাকে এড়িয়ে এগিয়ে চলে
নিষ্প্রাণ মাতাকে শিশু ধরে জাপটে,নির্ভাবনায়।

সময়ের চোরাস্রোত এসে খেয়ে গ্যাছে জমি,ভিটে
হালের বলদ,-আশা,যৌবন-লাবণ্য,প্রেম-স্বপ্ন--
দিয়ে গ্যাছে দরিদ্রতা,ক্ষুধা আর গ্লানির জীবন,
হতাশার  দীর্ঘশ্বাস :দগ্ধীভূত শিল্প-সমকাল
লীন হয়ে যায় মহাকালে,পড়ে থাকে অবশিষ্টে-
ধূলায় লুটায় শিশু,ভূলুন্ঠিতা শেষ ঘুমে মগ্ন
পত্রিকায় মৃত্যুর খবর আসে 'শিরোনামহীন।'


২৩.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০১০

'স্বতন্ত্র সনেট' পড়ার পর



পড়ন্ত বিকেলে আরক্তিম গোধূলীতে বলেছিলে--
এক জীবনের কতটুকু ভালোবাসা দিতে পারো
সমকাল থেকে নৈঃশব্দ পেরিয়ে এসে নিসর্গের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বল্লাম: নিও অযুত নিযুত;
সহস্র-কোটিও নয় মহাকালে অসামান্য দিলে--
ডজমানো ভালোবাসা পেয়ে তৃষ্ণা মিটেছে কি কারো;
রসালো ঠোঁটের বৃষ্টি অকৃত্রিম খোলা আবেগের


উত্তরাধুনিক দস্যু লুটে নেয় জৈবনিক প্রেম
ইতিহাসের মহাসড়কে পিষ্ট হয় মানবতা
বিলের শাপলা কুমারীর ঋতু-রক্তের মতোন
জ্বলে, উড়ন্ত ঈগল, চিল হানে অব্যর্থ, নিখুঁত।
আধুনিকতার শিক্ষা দেয় তবু অসভ্য হারেম
মানুষ, জল্লাদ পাঠ দেয় অস্রাব্য মানবিকতা
মানবী, সঞ্চিত--আজীবন--ভালোবাসা কি এ্যামোন!

২২.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

শনিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১০

কবিতা

পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম গোধূলিতে দু'হাতে আমার
হাত চেঁপে ধরে গভীর আবেগে বলেছিলে,
কাকে তুমি বেশী ভালবাস,
কবিতা না আমাকে ?

সূর্যাস্ত থেকে চোখ ফিরিয়ে
তোমার স্বচ্ছ গভীর দৃষ্টি উপেক্ষা কোরে-
গাঢ়স্বরে বলেছিলাম,'কবিতা'
অস্ফুষ্ট আর্তনাদে কেঁপে উঠলে তুমি
হাত সরিয়ে ত্রস্তা হরিণীর ক্ষিপ্রতায়
বিকেলটাতে একরাশ বিষন্নতা ছড়িয়ে চলে গেলেঃ
দু'হাত বাড়িয়ে তোমাকে ফেরাতে গিয়েও অব্যক্ত
এক অভিমানে থেমে গেলাম।

তারপরঃ
বিকেলগুলো হয়ে এলো বিবর্ণ,ম্রিয়মান
সন্ধ্যাগুলো ধূসর,রাতগুলো কালো, নিকষ অন্ধকার
আর সকালগুলো হতাশার কুয়াশায় মোড়ানো।

কখনো বোঝনি যে তুমিই ছিলে আমার 'কবিতা' ।


২১.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।
http://www.notundesh.com/Archive/12-01-10/shahitta_news9.html

বুধবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১০

'কবি ও কবিতা' বিষয়ক একটি বানানো (অ)কবিতা

কবিতার জন্যে প্রয়োজন নিরন্তর,নিরবিচ্ছিন্ন সাধনা
জীবনও বাজি ধরে কেউ কেউ খ্যাতির দুর্নিবার আকাঙখায়
জীবিকার্জন বা জীবিকাহীনতায়ও অকালে ঝরে যায় কেউ কেউ
দেশান্তরী কিংবা নির্বাসনেও যেতে হয় কখনো কখনো
দান্তেকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল জন্মভূমি ফ্ল্যোরেন্স
রাতের আধাঁরে দাউদ হায়দারকে ছাড়তে হয় প্রিয় বাংলাদেশ

কেউ কেউ আছেন যারা কবিতা লেখেন মজ্জাগত স্বভাব হিসেবে
কেউ কেউ আছেন যারা কবিতা লেখেন লিখতে হয় বলে
অপার জীবন আর দিগন্তবিস্তারী নিবিড় প্রকৃতিই কবির পাঠশালা
জড়প্রকৃতির মধ্যেই কেউ কেউ খুঁজে পান জীবন্ত,সর্বব্যাপী সত্ত্বা
কারো কাছে প্রকৃতি প্রেমই ধর্ম
কেউ কেউ কবিতার পাঠ নেন জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন
অপমান-লাঞ্জনা এ্যামোনকি অসফলতা কিংবা কেউ কেউ চষে বেড়ান
পূরান,ইতিহাস,নৃতত্ত্ব,দর্শন, সঙ্গীত শিল্পক্ললার বিস্তীর্ণাঞ্চল

কবির কোনো সান্তনা,আশা,আশ্বাস কিংবা মুক্তি নেই
সমকালের হুল্লোড় থেকে দূরেই কবিতার সিদ্ধি,আত্মস্ততাই সন্ন্যাস
মেঘদূতের স্বপ্ন কবির কাছের ব্যর্থ,শকুন্তলার স্বর্গ অর্থহীন
প্রচার নয় সৃষ্টিতেই আনন্দ,বিরহ তার কাছে নরক,প্রশান্তিতেই মৃত্যু।

সোমবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১০

২২শে অক্টোবর

( ত্রিশাখ জলদাশকে )

সমস্ত সবুজ পাতা অগ্রহায়ণের বিষন্নতায় ম্লান হয়ে আছে
ইতঃস্তত ঘুরে বেড়ায় ইঁদূর আর ব্যাঙ হতশ্রী ধান কাটা মাঠে--
নীলাভ জ্যোৎস্নায় ম্লান হয়ে আসে পৃথিবী;
কুয়াশারা ভেঙ্গে পড়ে খান খান হয় অন্ধকারের আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকীতে ভরে যায় মৃত নক্ষত্রেরা অন্ধকারে কাদার মত
থক থকে জ্বলে। সমুদ্র তার সমস্ত সফেদ ফেনাগুলো গভীর
থেকে আরো দূর গভীরে নিয়ে যায়। কোনো ঘাই হরিণী
মিলনোম্মোত্ত উন্নম্মতায় পূরুষ হরিণকে ডাকবে না,
কোন কীট আজ বিষাক্ত দাঁতে ফুটন্ত গোলাপকে ছোঁবে না
বুঁনোহাস আজ সারাদিন জলকেলী করেনি- রাঙা পৃথিবীর সব
ঘুঘু হিজলের বনে মৌনভাবে বসেছিল যেমন  চিল ডানায় রৌদ্রের
গন্ধ মেখে অশ্বত্থের জানালার ফাঁকে তাকিয়েছিল ধানসিড়ির দিকে।

আজ শুধু মানুষই যাবে মানুষের বিপক্ষে আর
বুনো শুয়োরগুলো আদিম উল্লাসে মেতে উঠবে ।

১৫.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।

শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১০

বাংলা কবিতাঃআধুনিকতার সুচনা-২

এখন বাংলা কবিতার আধুনিকতার সুচনালগ্নে 'আধুনিক কবিতা' কি এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলা কবিতার পুরোহিত বুদ্ধদেব বসু'র মতে 'আধুনিক কবিতায় নগর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁওয়া থাকবে,থাকবে বর্তমান জীবনের ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবোধ,দেখা যাবে আত্মবিরোধ ও অনিকেত (Rootless) মনোভাব এবং রবীন্দ্র ঐতিহ্যের (রোমান্টিকতা) বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহ ও নতুন পথের সন্ধানের প্রয়াস।' মার্কসিষ্টরা এর সাথে যোগ করলেন সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে নতুন সমাজ সৃষ্টির আশার কথা থাকবে কাব্যের মধ্যে এবং বাকরীতি ও কাব্যরীতির সচেতন মিশ্রন ঘটবে কাব্যে।গদ্যের ভাষা,প্রবাদ,চলতি শব্দ,গ্রাম্যশব্দ ও বিদেশী শব্দের ব্যবহারে গদ্য,পদ্য ও কথ্যভাষার ব্যবধান বিলোপের প্রচেষ্টা অবশ্যই থাকবে কবিতায়।আবু সায়ীদ আইয়ুবের মতে,'কালের দিক থেকে আধুনিক কবিতা প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী,ভাবের দিক থেকে মুক্তির প্রয়াসী....।' 'আধুনিক কবিতা হল বিদ্রোহের,প্রতিবাদের,সংশয়ের,ক্লান্তির,সন্ধানের আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ,জীবনের আনন্দ,বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য,অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা,সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা,এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন কবিতাতেই নয়,কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।''

এ কথা কারুরই অস্বীকার করার উপায় নেই যে,আধুনিক বাংলা কবিতা উদ্ভূত হয় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রোমান্টিসিজম কবিতা বর্জনের ঐকান্তিক প্রয়াস থেকে।প্রত্যেক কবিরই সহজাত বৈশিষ্ট্য হলঃ পূর্ববর্তী ও সম-সাময়িক কবিদের থেকে 'স্বাতন্ত্র্যবোধ'।এ স্বাতন্ত্রবোধটাই কবিকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরে আসতে কিংবা বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর স্বাতন্ত্রবোধে সচেষ্ট থেকে,স্বীয় কবিসত্ত্বা বিনির্মাণের প্রত্যয় থেকে বিদ্রোহ করেছিলেন মধুসূদন সাম্রাজ্যে।তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্যের,বর্জন করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়,নবীনচন্দ্র সেনের কৈশোরিক পাঠের। নবীনযুগের কবিরাও সচেতনভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের মাঝখানে তারা বিকশিত হতে পারবেন না । তাই তারা সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে আক্রমন করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে লিপ্ত হলেন।আধুনিক যুগের প্রবর্তক কবিরা তাদের রোমান্টিকতা বিরোধী দৃষ্টি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের দিকে নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের বাইরে এসে পূর্বে অনাস্বাদিত এক নব কাব্যধারার। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ তখন একচ্ছত্রাধিপত্যে বাংলা ভাষাকে শাষণ করে চলেছেন।রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সেসব তরুণ কবিদের স্বাভাবিক কিন্তু সহজ ছিল না।বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নূতন কবিতার নান্দীপাঠ করেছিলেন ১৯২৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মর্মবাণী'তে;যদিও তা ছিল রবীন্দ্রঘেঁষা। আর এ সমস্ত তরুণ কবিদের মতামত প্রকাশ করতে লাগলো দীনেশরঞ্জন  দাশ সম্পাদিত'কল্লোল',মুরলীধর বসু,শৈলজানানন্দ মুখোপাধ্যায়,প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত'কালিকলম',বুদ্ধদেব বসু,অজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত 'প্রগতি' প্রভৃতি পত্রিকা।মূলতঃ কল্লোল পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর পরই শুরু হল নবধারার আধুনিক বাংলা কবিতা রচনা প্রবাহের ধারা আর এঁদের সাথে যুক্ত হলেন অজিত দত্ত,অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত,সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য প্রমুখ কবিরা।রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,'হাট ত্রিসীমানায় নেই বটে,কিন্তু হট্টগোল যথেষ্ট আছে।আধুনিক সাহিত্যে ঐটেই বাহাদুরী...'। ঠিক তখন অমিয় চক্রবর্তী প্রবন্ধ লিখে কঠোর সমালোচনা করলেন কবিতায় ব্যবহৃত ছিনু,গেনু,হিয়া ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের।রবীন্দ্রনাথ সরাসরি আধুনিক কবিদের 'ভাঙন ধরা,রাবিশ জমা,ধুলো-ওড়া যুগের কবি বলে চিহ্নিত করলেন। 'সাহিত্যের স্বরুপ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,'শ্রী নেই,তাতে পরিমিতি নেই,তাতে রুপ নেই,আছে প্রচুর বাক্যের পিন্ড।এটা দানবিক ওজনের সাহিত্য,মানবিক ওজনের নয়।' আর এদিকে আধুনিক কবিরা আরো সঙ্ঘবদ্ধ ;কবিতার পয়ার,অতিকাব্যিক শব্দ ব্যবহার পরিত্যাগ করেন।সেই সময়,অমিয় চক্রবর্তী লিখলেনঃ তালিকা প্রস্তুত/কী কী কেড়ে নিতে পারবে না/কুয়োর ঠান্ডা জল,গানের কান,বইয়ের দৃষ্টি/গ্রীষ্মের দুপুরের বৃষ্টি।

শেষ পর্য্যন্ত কালের দাবী মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তকছন্দ নামে 'পুনশ্চ'তে আনলেন গদ্যছন্দ;যেখানে তিনি তাঁর অতি প্রিয় তবে,সনে,মোর কাব্যধর্মী শব্দগুলো ব্যবহার করেন নি।সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ'নামে প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করে আধুনিক কবিদের সাবধান করে দিলেন,'তপস্যা কঠিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যেটা মোক্ষ,আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়তো সর্বনাশের পথ।' বুদ্ধদেব বসুও 'নতুন পাতা' নামে 'পুনশ্চ' গ্রন্থের প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখলেন।

কিন্তু তিরিশ দশকের এসব তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটু স্নেহ ও তাঁর কাছ থেকে সমর্থন পাবার লোভে ব্যাকুল থাকতেন।একদিকে তরূণ বিদ্রোহী এ সকল কবিগণের রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা,অন্যদিকে কবিগুরুর স্নেহাশীষ লাভের আকাঙ্খার কারণেই অনেকের লেখায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্ব-বিরোধীতা প্রকাশ পেয়েছে।সম্ভবতঃ তারা রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েই রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা সে কথা পরিষ্কার করে উল্লেখ করেন নি।তরূণ এ সবকবি তাদের প্রকাশিত বই রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে সাগ্রহে তাঁর মতামতের জন্যে অপেক্ষা করতেন।রবীন্দ্রনাথ তাদের নিরাশ করতেন না।সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আধুনিক কবিদের কারো কারো উক্তি কখনো কখনো পরস্পর বিরোধী মনে হয়ঃবুদ্ধদেব বসু 'প্রগতি'র ১৩৩৫,বৈশখ সংখ্যায় অভিনব গুপ্ত ছদ্মনামে লিখলেন,'....রবীন্দ্রনাথের দিন এক রকম ফুরাইয়া আসিতেছে,একথা আমি কোন খানেই বলি নাই।আমি শুধু লিখিয়াছিলাম যে আধুনিক সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ক্রমশঃ সরিয়া যাইতেছে।'সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তন্বী' (১৯৩০) রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।উৎসর্গপত্রটি ছিল এরকম---
"উৎসর্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের শ্রীচরণে
অর্ঘ্য
ঋণ শোধের জন্য নয় ঋণ পরিশোধের জন্য।" এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'তন্বী'র ভূমিকায় লিখেছেন-'.....কবিতাগুলোর উপর স্বদেশী-বিদেশী অনেক কবিই ছায়াপাত করেছেন-সব সময়ে গ্রন্থকারী সম্মতিক্রমে নয়।কেবল রবীন্দ্রনাথের ঋণ সর্বত্রই জ্ঞানকৃত।' আবার ১৯৩৫ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'অর্কেষ্ট্রা'তে রবীন্দ্রাসক্তি আর খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু তখনো তিনি রবীন্দ্রনাথকে অদ্বিতীয় মনে করতেন।রবীন্দ্রমনস্কতা সত্ত্বেও তিনি লিখলেন,'যুগধর্মে দীক্ষা গ্রহন তার (আধুনিক কবির) অবশ্য কর্তব্য।এ কথা না মেনে তার উপায় নেই যে প্রত্যেক সৎকবির রচনাই তার দেশ ও কালের মুকুর এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে যে দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে,তাদের সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে উভয়ের যোগফলকে যদি পরীর রাজ্য বলা যায় তা হলে বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।'
কিংবা
দেশ,সাহিত্য সংখ্যা,১৯৭৫ এর এক নিবন্ধে জানা যায়,'কবি জীবনের প্রারম্ভ থেকে জীবনানন্দ দাশের যোগাযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।কারন ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে স্বয়ম্প্রভ ও শক্তিমান কবি হয়েও তিনি অল্পবিস্তর রবীন্দ্রছায়ায় বিবর্ধিত হয়েছেন।জীবনান্দ জানতেন রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে কোনো সাহিত্যকৃত এদেশে চলবে না।তাই পিতৃপ্রতিম কবিগুরুকে বই পাঠিয়ে তিনি সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছেন তাঁর মতামতের জন্য,তাঁর  স্নেহাশিসের জন্য।'


সহায়ক গ্রন্থঃ
১.হাজার বছরের বাংলা কবিতাঃমাসুদুল হক
২.আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়
৩.কল্লোলের কালঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়

(ক্রমশঃ)
http://www.bangladeshnews24x7.com/literatare/ghotonaprobaho/214-2010-12-01-20-10-16.html

রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১০

বৈরী কাল

রবিউল ইসলাম মানিক

মহাকালের দাবানলে দাউ দাউ পুঁড়ছে হৃদয়
সমকালের পিঠে সওয়ার উত্তরাধুনিক দস্যু লুটে নেয় জৈবনিক প্রেম
সভ্যতার গলিত লাশের গন্ধে  নাক চাঁপে বিপন্ন মানবতা
ইতিহাসের মহাসড়ক  ছেড়ে আলপথে নেমে যায় বাস্তবতা
ডাক্তারের সুনিপুণ সার্জারিতে খসে পড়ে অপাপবিদ্ধা কিশোরীর ভ্রুণ
সাম্রাজ্যবাদী বটের ডালে শ্যেণদৃষ্টিতে শিকার খোঁজে চতুর ঈগল
ডাষ্টবিন ভাগাভাগি করে নেয় মানুষ আর কুকুর
স্বপ্নহীন ভাবালুতায় মানুষ ছুটে চলে নিরুদ্দিষ্ট সাগরেরে বালুকাবেলায়

বৈরী এ কালে বাগানের ফুটন্ত গোলাপ বড়োবেশী নিষ্প্রভ, ম্রিয়মান
নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখি প্রেমিকার ম্লান,বিষন্ন হাসি
সৌম্যমুখ প্রাগৈতিহাসিক বুড়োরা  নিজেকে গুটিয়ে নেয় শামুকের সন্তর্পণতায়
একাকী রমণে ক্লান্ত যুবক স্বস্তির পরশ খুঁজে পায় গণিকার সন্ধানে

নষ্টদের কাছথেকে দূরে থাকা নিরন্তর নবায়নযোগ্য নান্দনিক কবি
নিদ্রাহীন লালচোখে প্রেমিকার জন্য লিখে যায় একের পর এক
কষ্টের কবিতা।

০৫.১১.১০
পল্লবী,ঢাকা।




বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১০

বাংলা কবিতাঃআধুনিকতার সুচনা-১

'আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক'প্রপঞ্চ;যা আধুনিক বা আধুনিকতাবাদ নামে অভিহিত। এর জন্ম পাশ্চাত্যে এবং কালের প্রভাবে তা ক্রমে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।আধুনিক শব্দটি এসেছে অধুনা শব্দ থেকে;যার আভিধানিক অর্থ সম্প্রতি বা আজকাল।সে সূত্রে আধুনিক শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় সাম্প্রতিক বা আজকালকার।সুতরাং আধুনিক কথাটির কালগত তাৎপর্য্য রয়েছে।রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,'পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে?এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা।'-('আধুনিক কাব্য',সাহিত্যের পথেঃরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। অর্থাৎ সময়কে তিনি গৌণের কোঠায় ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু জীবেন্দ্র সিংহ রায় রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন,'আধুনিক শব্দের ব্যুৎপত্তির দিকে লক্ষ্য রাখলে তাঁর বক্তব্য মেনে নেওয়া যায় না।কেননা আধুনিকতা কখনও সাম্প্রতিকতাকে বাদ দিয়ে আসতে পারে না। কালের বর্তমান পদচিহ্ন অনুসরণ করেই তার যাওয়া আসা।'-('আধুনিকতা,আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়)।আধুনিকতা একটি আপেক্ষিক ধারণা।আধুনিকতা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়,কোন পাঠকগোষ্ঠীর সাধারণ রুচি ও শিল্পের মান ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ততার।

রবীন্দ্রনাথ,মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের সময়ে নিশ্চয়ই অনাধুনিক ছিলেন না।শিল্পকর্ম তা কোন চিত্রকর্ম বা কবিতাই তা বিশেষকালের ক্ষেত্রে আধুনিক হতে পারে,সর্বকালেই নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন ১৩০০ সনে কল্পণা করেছিলেন,'আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/কৌতুহল ভরে,/আজি হতে শতবর্ষ পরে!'রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজও আমদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়,তা কি আধুনিক বলে? না-কি কালজয়ী বলে?কালিদাস,শেকসপিয়ার,টলষ্টয় এমন কত ঔপন্যাসিক,নাট্যকার-কবি আছেন যাঁদের সৃষ্টি প্রত্যেক যুগের পাঠককে নিত্য-নূতনভাবে টানে।সে তো তাঁদের সৃষ্টি শাশ্বতভাবে আধুনিকবলে নয়-কালজয়ী বলে। শাশ্বতভাবে 'আধুনিক' ও 'কালজয়ী' সমার্থবাচক নয়।তাই আধুনিকতা প্রসঙ্গে 'শাশ্বতভাবে আধুনিক' কথাটির তাৎপর্য্য নেই।-('আধুনিকতা,আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়)

প্রত্যেক দশক বা কালে এক বা একাধিক গুণী কবি,চিন্তাবিদ,দার্শনিক,শিল্পী জন্মে থাকেন।এঁরা তাঁদের সময়ের থেকে অগ্রগামী এবং স্ব স্ব সমাজে সম-সাময়িক রুচি ও শিল্পের মান পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন।এ সকল মনীষী সমাজ ও রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাবতীয় সনাতন রীতি-নীতি,কূপমন্ডুকতা,অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎমুখীনঅতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে কালে কালে,দশকে দশকে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে টেনে নিয়ে গেছেন।এঁরা সমকালকে সাথে নিয়ে মহাকালের প্রান্তর চষে বেড়ান কিংবা মহাকালের নিক্তিতে সমকালকে পরিমাপ করেন।।এঁদের হাতে পূর্বকালের মণীষীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন পরিমার্জিত,সংশোধিত কিংবা কখনো কখনো পরিত্যাজ্যা হয়ে আসছে।যিনি যতবেশী শক্তিমান,তিনি ততবেশী পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকেন।পৃথিবী সৃষ্টির যুগ থেকেই সবার অলক্ষ্যে কিংবা কখনো কখনো বিস্ময়কর,বিপর্য্যস্তভাবে এটা ঘটে চলেছে।

১৮৮০ সনে বোদলেয়ার,ম্যালার্মের আবির্ভাব কালকে আধুনিকতার সুচনাকাল ধরা হয়।এ সময় কতকগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মতবাদের কারণে মানুষ ঈশ্বরবিমুখ হয়ে পড়েন,সমালোচনা শুরু করেন চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদ ও বুর্জোয়া সমাজের। এ সময় বিদগ্ধজনেরা সমাজের নৈরাশ্যচেতনা ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।তাঁরা একেবারে গোড়া থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী।সমাজ ও দেশের পূরানো মতবাদ,ঈশ্বরবিশ্বাস ও চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের চিন্তা,চেতনা ও লেখায় ঈর্ষণীয় সাফল্য ফুটে ওঠে,ফুটে ওঠে নান্দনিক শিল্পকলায়।১৯১০ থেকে ১৯২৫ সনকে ধরা হয় আধুনিকতাবাদের শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় পাশ্চাত্য দগ্ধীভুত হয় অপব্যয়ী প্রথম মহাযুদ্ধে, মানুষ মেতে ওঠে রক্তপাতে,যুদ্ধের পর হতাশা ও অবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় বিশ শতকের শিল্পকলা,কবিতা ;যার মধ্যে থাকে আধুনিকতাবাদ। এককথায় বিংশ শতাব্দীর মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন কবিতায় আধুনিকতাবাদ।বলা যেতে পারে পাশ্চাত্যে প্রত্যেক শতকেই শিল্পকলার জগতে পরিবর্তন ঘটে গেছে নীরবে,অলক্ষ্যে,পরিবর্তন হয়েছে মন,মনন ও সংবেদনশীলতার কিন্তু তা কোনো সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত নাড়িয়ে দেয় নি। কিন্তু আধুনিক কবিতা সমস্ত ভীরুতা ও নৈরাশ্যবাদকে জড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বিপর্য্যয়রুপে আত্ম-প্রকাশ করেছে।১৯১৮ সনে হপকিন্সের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'The Poems of Gerard Manley Hopkins' প্রকাশের পর ইংরেজ কবিতার পাঠকেরা আধুনিক কবিতার বিচিত্র স্বাদ পেলেন।পূর্বেই বলেছি,প্রথম মহাযুদ্ধের পরে জন্ম নেয় নূতন এক শিল্পকলার;যার ফলে সনাতন ও রক্ষণশীল সমাজের ভাবধারায় আমূল পরিবর্তন ঘটার ফলে ইংরেজি সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়ে।আমেরিকান সাহিত্যও পিছিয়ে থাকে না। এ সময় ১৯১৫ সনে 'Some Imagist Poets' শীর্ষক সংকলনে Imagist দলভূক্ত কবিদের কবিতা প্রকাশিত হয় ফলে বৃটেন ও আমেরিকায় কবিতা এক নূতন মাত্রা পায়।এই নূতন মাত্রার সাথে যুক্ত হয় যখন টি,এস,এলিয়টের প্রধান প্রভাবসম্পাতী কাব্যগ্রন্থ'The Waste Land' বা পোড়ামাটি প্রকাশিত হয়;যেখানে তিনি প্রচলিত কবিতার রীতি ভেঙ্গে নিয়ে আসেন অভিনবত্ব।তারপর থেকে এটি বিবেচিত হয়ে এসেছে আধুনিক নগরজীবনের ভাষ্য হিসেবে। ঐ কবিতায় পোড়োমাটির যে উদ্ভাস তাঁর হৃদয়ে মরুময় কণ্টকময় হয়ে উঠেছিল তা শুধু ইংরেজি কবিতাই নয়, তা ছিল বিশ্বের নানা দেশের কবিতা ও ভূগোল। ঠিক একই সময়ে বাংলা কবিতায়ও সনাতন রীতি-নীতি ও পশ্চাদ্মুখীনতা আকড়ে না থেকে সমকালের দাবী মেনে নিয়ে বিবর্তিত হতে থাকে। ''তিরিশের দশকের বাঙালি কবিরা এলিয়টের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কবিতা রচনা শুরু করেন। এলিয়টের অনুকরণে কলকাতা নগরীকে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন ভিড়াক্রান্ত লন্ডন নগরীর অশুভ পাপময়তা-পচনশীলতার এতদ্দেশীয় প্রতিরূপ হিসেবে। (এলিয়টের লন্ডন নিজেই ছিল আধুনিকবাদের আদিগুরু বোদলেয়ারের প্যারিসের প্রতিরূপ।) তারপর থেকে দীর্ঘ দিন বাঙালি কবির কাছে আকাশ মানেই ছিল বিধ্বস্ত নীলিমা, বাতাস মানেই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের ঘামের গন্ধে বিষাক্ত, বিষন্ন। জীবনানন্দের রাত্রি কবিতায় দেখি “হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/... থামে ঠেস দিয়ে লোল নিগ্রো হাসে/নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।”-- এরকম বর্ণনা এলিয়টভাবিত ও প্রভাবিত।...''(খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ)।আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ মূলতঃ জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে;যারা পঞ্চপান্ডব নামে খ্যাত।এঁদের হাতেই ইউরোপীয় আধুনিকতার আদলে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন হয়।বাংলায় আধুনিকতার গোড়াপত্তন হয় ১৯২৫ সনে;যা ইউরোপীয় আধুনিক কবিতার সমবয়সী।
(ক্রমশঃ)
http://www.bangladeshnews24x7.com/literatare/81-ghotonaprobaho/135-2010-11-30-14-45-48.html?tmpl=component&print=1&layout=default&page