এখন বাংলা কবিতার আধুনিকতার সুচনালগ্নে 'আধুনিক কবিতা' কি এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলা কবিতার পুরোহিত বুদ্ধদেব বসু'র মতে 'আধুনিক কবিতায় নগর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁওয়া থাকবে,থাকবে বর্তমান জীবনের ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবোধ,দেখা যাবে আত্মবিরোধ ও অনিকেত (Rootless) মনোভাব এবং রবীন্দ্র ঐতিহ্যের (রোমান্টিকতা) বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহ ও নতুন পথের সন্ধানের প্রয়াস।' মার্কসিষ্টরা এর সাথে যোগ করলেন সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে নতুন সমাজ সৃষ্টির আশার কথা থাকবে কাব্যের মধ্যে এবং বাকরীতি ও কাব্যরীতির সচেতন মিশ্রন ঘটবে কাব্যে।গদ্যের ভাষা,প্রবাদ,চলতি শব্দ,গ্রাম্যশব্দ ও বিদেশী শব্দের ব্যবহারে গদ্য,পদ্য ও কথ্যভাষার ব্যবধান বিলোপের প্রচেষ্টা অবশ্যই থাকবে কবিতায়।আবু সায়ীদ আইয়ুবের মতে,'কালের দিক থেকে আধুনিক কবিতা প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী,ভাবের দিক থেকে মুক্তির প্রয়াসী....।' 'আধুনিক কবিতা হল বিদ্রোহের,প্রতিবাদের,সংশয়ের,ক্লান্তির,সন্ধানের আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ,জীবনের আনন্দ,বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য,অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা,সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা,এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন কবিতাতেই নয়,কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।''
এ কথা কারুরই অস্বীকার করার উপায় নেই যে,আধুনিক বাংলা কবিতা উদ্ভূত হয় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রোমান্টিসিজম কবিতা বর্জনের ঐকান্তিক প্রয়াস থেকে।প্রত্যেক কবিরই সহজাত বৈশিষ্ট্য হলঃ পূর্ববর্তী ও সম-সাময়িক কবিদের থেকে 'স্বাতন্ত্র্যবোধ'।এ স্বাতন্ত্রবোধটাই কবিকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরে আসতে কিংবা বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর স্বাতন্ত্রবোধে সচেষ্ট থেকে,স্বীয় কবিসত্ত্বা বিনির্মাণের প্রত্যয় থেকে বিদ্রোহ করেছিলেন মধুসূদন সাম্রাজ্যে।তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্যের,বর্জন করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়,নবীনচন্দ্র সেনের কৈশোরিক পাঠের। নবীনযুগের কবিরাও সচেতনভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের মাঝখানে তারা বিকশিত হতে পারবেন না । তাই তারা সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে আক্রমন করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে লিপ্ত হলেন।আধুনিক যুগের প্রবর্তক কবিরা তাদের রোমান্টিকতা বিরোধী দৃষ্টি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের দিকে নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের বাইরে এসে পূর্বে অনাস্বাদিত এক নব কাব্যধারার। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ তখন একচ্ছত্রাধিপত্যে বাংলা ভাষাকে শাষণ করে চলেছেন।রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সেসব তরুণ কবিদের স্বাভাবিক কিন্তু সহজ ছিল না।বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নূতন কবিতার নান্দীপাঠ করেছিলেন ১৯২৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মর্মবাণী'তে;যদিও তা ছিল রবীন্দ্রঘেঁষা। আর এ সমস্ত তরুণ কবিদের মতামত প্রকাশ করতে লাগলো দীনেশরঞ্জন দাশ সম্পাদিত'কল্লোল',মুরলীধর বসু,শৈলজানানন্দ মুখোপাধ্যায়,প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত'কালিকলম',বুদ্ধদেব বসু,অজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত 'প্রগতি' প্রভৃতি পত্রিকা।মূলতঃ কল্লোল পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর পরই শুরু হল নবধারার আধুনিক বাংলা কবিতা রচনা প্রবাহের ধারা আর এঁদের সাথে যুক্ত হলেন অজিত দত্ত,অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত,সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য প্রমুখ কবিরা।রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,'হাট ত্রিসীমানায় নেই বটে,কিন্তু হট্টগোল যথেষ্ট আছে।আধুনিক সাহিত্যে ঐটেই বাহাদুরী...'। ঠিক তখন অমিয় চক্রবর্তী প্রবন্ধ লিখে কঠোর সমালোচনা করলেন কবিতায় ব্যবহৃত ছিনু,গেনু,হিয়া ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের।রবীন্দ্রনাথ সরাসরি আধুনিক কবিদের 'ভাঙন ধরা,রাবিশ জমা,ধুলো-ওড়া যুগের কবি বলে চিহ্নিত করলেন। 'সাহিত্যের স্বরুপ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,'শ্রী নেই,তাতে পরিমিতি নেই,তাতে রুপ নেই,আছে প্রচুর বাক্যের পিন্ড।এটা দানবিক ওজনের সাহিত্য,মানবিক ওজনের নয়।' আর এদিকে আধুনিক কবিরা আরো সঙ্ঘবদ্ধ ;কবিতার পয়ার,অতিকাব্যিক শব্দ ব্যবহার পরিত্যাগ করেন।সেই সময়,অমিয় চক্রবর্তী লিখলেনঃ তালিকা প্রস্তুত/কী কী কেড়ে নিতে পারবে না/কুয়োর ঠান্ডা জল,গানের কান,বইয়ের দৃষ্টি/গ্রীষ্মের দুপুরের বৃষ্টি।
শেষ পর্য্যন্ত কালের দাবী মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তকছন্দ নামে 'পুনশ্চ'তে আনলেন গদ্যছন্দ;যেখানে তিনি তাঁর অতি প্রিয় তবে,সনে,মোর কাব্যধর্মী শব্দগুলো ব্যবহার করেন নি।সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ'নামে প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করে আধুনিক কবিদের সাবধান করে দিলেন,'তপস্যা কঠিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যেটা মোক্ষ,আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়তো সর্বনাশের পথ।' বুদ্ধদেব বসুও 'নতুন পাতা' নামে 'পুনশ্চ' গ্রন্থের প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখলেন।
কিন্তু তিরিশ দশকের এসব তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটু স্নেহ ও তাঁর কাছ থেকে সমর্থন পাবার লোভে ব্যাকুল থাকতেন।একদিকে তরূণ বিদ্রোহী এ সকল কবিগণের রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা,অন্যদিকে কবিগুরুর স্নেহাশীষ লাভের আকাঙ্খার কারণেই অনেকের লেখায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্ব-বিরোধীতা প্রকাশ পেয়েছে।সম্ভবতঃ তারা রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েই রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা সে কথা পরিষ্কার করে উল্লেখ করেন নি।তরূণ এ সবকবি তাদের প্রকাশিত বই রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে সাগ্রহে তাঁর মতামতের জন্যে অপেক্ষা করতেন।রবীন্দ্রনাথ তাদের নিরাশ করতেন না।সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আধুনিক কবিদের কারো কারো উক্তি কখনো কখনো পরস্পর বিরোধী মনে হয়ঃবুদ্ধদেব বসু 'প্রগতি'র ১৩৩৫,বৈশখ সংখ্যায় অভিনব গুপ্ত ছদ্মনামে লিখলেন,'....রবীন্দ্রনাথের দিন এক রকম ফুরাইয়া আসিতেছে,একথা আমি কোন খানেই বলি নাই।আমি শুধু লিখিয়াছিলাম যে আধুনিক সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ক্রমশঃ সরিয়া যাইতেছে।'সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তন্বী' (১৯৩০) রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।উৎসর্গপত্রটি ছিল এরকম---
"উৎসর্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের শ্রীচরণে
অর্ঘ্য
ঋণ শোধের জন্য নয় ঋণ পরিশোধের জন্য।" এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'তন্বী'র ভূমিকায় লিখেছেন-'.....কবিতাগুলোর উপর স্বদেশী-বিদেশী অনেক কবিই ছায়াপাত করেছেন-সব সময়ে গ্রন্থকারী সম্মতিক্রমে নয়।কেবল রবীন্দ্রনাথের ঋণ সর্বত্রই জ্ঞানকৃত।' আবার ১৯৩৫ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'অর্কেষ্ট্রা'তে রবীন্দ্রাসক্তি আর খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু তখনো তিনি রবীন্দ্রনাথকে অদ্বিতীয় মনে করতেন।রবীন্দ্রমনস্কতা সত্ত্বেও তিনি লিখলেন,'যুগধর্মে দীক্ষা গ্রহন তার (আধুনিক কবির) অবশ্য কর্তব্য।এ কথা না মেনে তার উপায় নেই যে প্রত্যেক সৎকবির রচনাই তার দেশ ও কালের মুকুর এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে যে দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে,তাদের সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে উভয়ের যোগফলকে যদি পরীর রাজ্য বলা যায় তা হলে বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।'
কিংবা
দেশ,সাহিত্য সংখ্যা,১৯৭৫ এর এক নিবন্ধে জানা যায়,'কবি জীবনের প্রারম্ভ থেকে জীবনানন্দ দাশের যোগাযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।কারন ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে স্বয়ম্প্রভ ও শক্তিমান কবি হয়েও তিনি অল্পবিস্তর রবীন্দ্রছায়ায় বিবর্ধিত হয়েছেন।জীবনান্দ জানতেন রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে কোনো সাহিত্যকৃত এদেশে চলবে না।তাই পিতৃপ্রতিম কবিগুরুকে বই পাঠিয়ে তিনি সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছেন তাঁর মতামতের জন্য,তাঁর স্নেহাশিসের জন্য।'
সহায়ক গ্রন্থঃ
১.হাজার বছরের বাংলা কবিতাঃমাসুদুল হক
২.আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়
৩.কল্লোলের কালঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়
(ক্রমশঃ)
http://www.bangladeshnews24x7.com/literatare/ghotonaprobaho/214-2010-12-01-20-10-16.html