Powered By Blogger

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

মুনীব রেজওয়ানের 'নীলকন্ঠ':বিমুগ্ধ পাঠকের অনুভব।

..............................................
..............................................
রাতে হলে ঢেলে দেই খানিকটা চন্দ্রপ্রভা
খোলা বুকে হুড়মুড় ধুকে যায় রুপালী তারার গন্ধ
অজানা গন্তব্যের জাহাজ ঠিক ভেড়ে স্বপ্নের বন্দরে।
(বাতাসের গান)
 দিগন্ত বিস্তৃতা অপার প্রকৃতি,নিসর্গমন্ডলের রং,ধ্বণি  বা চিত্র নয়,------কবি মুনীব রেজওয়ান তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ্র 'নীলকন্ঠে' স্থান জগতের গতিপ্রবাহকেও বেদনা প্রকাশের ভাষায় প্রকাশ করেন।প্রেম দর্শন ও মহাজাগতিক বোধের অতীত মানসিক অনুধ্যান,জনমানসকে বদ্ধ,নিশ্চল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে যাবার মূল শক্তিই গতিময়তা। আর আবেগের গতিময়তা কবির চিত্তকে করে তোলে প্রাণচঞ্চল ও আবেগময়,সম্মুখধারী।কবি যখন তার বোধের সমীকরন মেলান সৃষ্টিজগতের চিরায়ত গতি প্রবাহের সঙ্গে কিংবা সোজা কথায় বলা যায় কবিতার অস্তিত্বে আবিষ্কার করেন এক নূতন প্রমাজ্ঞান আর এমনই ব্রাম্মমুহূর্তে নূতন নূতন শব্দানুষঙ্গ মিলে সৃষ্টি হয় এক নুতন জীবনপ্রবাহ;যার নাম কবিতাঃ

জীবনের সবক'টি বসন্ত পুড়েছে বেগুনী জ্যোৎস্নায়
প্রতিটা দহনে রক্ত আজ আরো নীল
প্রতিটা চুম্বনে সহস্রবার খুলছে নরকের দ্বার
গভীরতা বাড়াতে আপন,নদীকে দেখেছি
সবগুলো নালা থেকে কেমন শুষছে লালা;
(কাঞ্চন জংঘা)

দ্বান্দিক বরতবাদী কবি নান্দনিক চিন্তা ও শিল্প প্রকরণে উদ্ধুদ্ব যুগের নিষ্পষনে তাঁর কবিসত্ত্বায় সৃষ্টি হয়েছে ুবসাদ,ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতাঃ
কোথাও আকাশ নেই,মাথার উপরে সাজানো শূণ্যতা
একাকী শয্যায় শুয়ে পাতাবাহারের নাচ দেখি
(কোথাও কোনো আকাশ নেই)

কাব্যসাধনার শুরুতেই দেখি শিল্পিত কবিতার পক্ষে কবি মুনীব রেজওয়ান।আর তাই কবিতায় জ্যোৎস্নার শরীরে 'স্বপ্নের বাস্তবে' যাবার বাসনায় শিল্পচেতনার সিঁড়িতে ক্রমাগত বিনির্মাণ করেনঃ
পাতাল খনক,খুঁড়ে আনি অনিমেষ;
ঘুম আর স্বপ্নদের সাজাই তোমার জলপাই চোখে।
নির্ণিমেষে তোমাকে নিমগ্ন করি শরদেন্দু নীলে।
রুপালী নক্ষত্রের ঝালরে জড়াই জোছনা শরীর।
(দিবা নিশি কাব্য)


প্রবল আশাবাদই তাঁর কবিতায় উপজীব্য।প্রেম চেতনার কবিতায় থাকেনা কোনো কেন্দ্রীয় উপমা,প্রথাগত চিত্রকল্প।নিপূণ,নি&খুত শব্দের বুননে নান্দনিক অনুভূতিতে বিনির্মাণ করেন কবিতা;যাতে বাস্তবতাবিবর্জিত,পলায়নী মনোবৃত্তি নয়,বাস্তব আশাবাদের অভিলাষ ব্যক্ত থাকে
.................................
.................................
ঐ দিকে দেখো আঁচল চুঁইয়ে নামছে সোহাগের ঢল
কাঁঠালিচাঁপা ফুটছে তোমার উঠোনে আগের নিয়মেই
প্রতিশ্রুত সন্ধ্যায় তুমি আসনি তবু প্রতীক্ষা রয়েছে জমা
যে কোনো জ্যোৎস্নায় এখনও নিঃশব্দে হাঁটে একটি শাদা পাঞ্জাবী
(নিঃশব্দে হাঁটে একটি শাদা পাঞ্জাবী)

শার্ল বোদলেয়ার ছিলেন প্রথম আধুনিক কবি,যিনি রোমান্টিক কাব্য-চেতনার প্রবল স্রোতের বিপরীতে একটি ভিন্নতর ও অভিনব বাঁধ বিনির্মাণ করেছিলেন;যাতে আশ্রয় করে ইউরোপীয়ান কাব্য চেতনা এক নূতন জগতে প্রবেশ করে।ফলে আমরা পাই ভিন্নমাত্রার এক অনাস্বাদিত কবিতা------আধুনিক কবিতা।বাংলাতে যার সূচনা কাল ১৯২৫।জীবনানন্দ দাশের সংস্পর্শে আধুনিক বাংলা কবিতা ব্যক্তিস্বরুপ্য লাভ করে।আধুনিক কবিদের চিন্তা,মন ও মানসকে শাণিত করে নূতন এক কাব্যালোকের আলোকে নিয়ে গেছেন।প্রথাসিদ্ধ সুন্দর য়ার প্রচলিত ধারণার অ-সুন্দরকে মিশিয়ে অভাবনীয় এক স্পষ্টতা এনে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। গভীর বেদনা,বিষন্নতা ও বিষ্ময়বোধ এক স্বাতন্ত্র্য মহিমা এনে দিয়েছে এক বাংলা কবিতায়।জীবনানন্দ দাশ গভীর বেদনা বিষন্নতা পেয়েছিলেন বোদলেয়ার থেকে।আর উত্তরাধুনিককালে কবি মুনীব রেজওয়ানের কবিতায় গভীর হতাশা ও বিষন্নতা এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকেঃ
হৃদয়ের হ্রদ থেকে কাঁপন শুরু
বিয়াশের ধুবড়ি তরঙ্গ!
গুঁড়িয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ঘর-দোর-জানালা.
তোমার-আমার যুথচারী শব্দের কবিতা প্রসাদ
শব্দরা অতি নিঃশব্দেও ভাঙ্গে বুঝি!
বড়ই কান্নাহীন এ কষ্ট।
(জলতংক)


কবি মুনীব রেজওয়ান দৈনন্দিন ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে দেখেন বাস্তবতা বিবর্জিত,রোমান্টিক দৃষ্টিতে নয়,সমাজ সচেতন একজন নাগরিক হিশেবে।সামাজিক অন্যায় অবিচারে ব্যথিত কবি বিষয় ও প্রসঙ্গের সহজ,স্বতঃস্ফুর্ত স্বাভাবিকতার পাশাপাশি কবিতার ভাষা নির্মাণ ও প্রকৌশলে চিকিৎসক কিংবা বিচারকের দাপ্তরিক ভাষা নয় নিছক আটপৌঢ় ও ব্যকরন শৃংখলমুক্ত সরল ও সহজবোধ্য ভাষায়,বিভিন্ন আলংকারিক প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতাকে স্বতন্ত্র উচ্চতায় নিয়ে যাবা প্রচলিত চেষ্টাকে প্রতিহত করেছেন তাঁর হাস্নাহেনা কবিতায়ঃ

''ছিনাল মাগী
কুলের বদনে চুন কালি
একশ একটা দোররা মারবি
খবিসের খায়েসের মইদ্দে।''

সমকালীন নষ্ট সময়ের সমকালীন কবিদের মতো কপট নন তিনি।অকপটে নিজের বিশ্বাস ও কল্পনা ব্যক্ত ক্রেন তিনিঃ
.......................
.......................
শতাব্দীর সংযম ভাঙ্গি,শুষ্ক কন্ঠে এসো মাধবী সুধা
সংবৃতা জোছনা রাত,এসো ভেজা পরাগের রেণু
উত্থান প্লাবনে ভেসে যাক অয়োমল সন্ধিস্মারক
(বুনো বাতাসের দোল)

গতানুগিতকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন নি তিনি।আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে কবিতায় অভিনব মাত্রা সংযোগ করতে তিনি সবসময়েই বদ্ধ পরিকর। আবেগঘন বস্তনিষ্ঠ নৈর্ব্যক্তিকতা----বাস্তবাতা মূর্ত করে তোলেন স্বতঃস্ফুর্ততায়।আনন্দের জন্যেই কবিতা তবুও তিনি কখনো গ্রহণ করেন না উদ্দেশ্য ও নীতিহীন আনন্দ।গভীর বিশ্বাসবোধ থেকেই জারিত করেন মানবিকতা হৃদয়ে লালন করেন নান্দনিকতা মূল বক্তব্যঃ

আমগাছে লটকে থাকে কাঠাঁল
পুলিশের বড়সাব দিনদুপুরে মাতাল
যৈবতী কন্যার ঘরে তেলহীন কুপি,দাপাদাপি রাত!
গতর খসিয়ে চাঁদা,কুমারী জ্যোৎস্নায় ভাঙ্গে রাতের চৌকিদার
(ঘোরে বন্দী স্বদেশ আমরা)

সময়,পারিপার্শ্বিক ও জীবন ঘনিষ্ট কবিতায় জীবনের আশালোকের ঈঙ্গিত লালনে তিনি একজন সফল শব্দচাষা।কবি মুনীব রেজওয়ান আক্ষরিক অর্থেই একজন কবি,সম্পূর্ণ কবি।সৌন্দর্য্যতার অনুধ্যানে এসে পরিপার্শ্বের অন্যান্য অনুষঙ্গ একীভুত করে নৈরাশ্য,সমাজ,প্রেম,দ্রোহ,দেহ,রিরংসা শিল্পের কেন্দ্রে একীভূত করেছেনঃ

ভয় নেই, ইকেবানা জানি,
জানি কি করে সাজাতে হয় ফুল ও কাঁটা।
বড় যত্নে খুলব মায়াবী মলাট, ধবল জোৎস্নার ফিতে।

কলাবতী চন্দ্ররাত অপেক্ষায় থেকো।
অপেক্ষায় থেকো ঝাউবনে বাতাসের ঢেউ
তুর্ণা নিশীথায় আসব গোধুলির ঠিক আগে।

একটা একটা করে উল্টে যাব কাগজের ভাঁজ
শীতবৃক্ষদের সাজিয়ে দেব সবুজ পাতায়
জীবনের এতোগুলো বসন্ত কুলফি মালাই হয়ে জমে আছে
তোমার উষ্ণতা পেলে ফুল, পাখী আর দক্ষিণা বাতাস হবে।

জলখাবারের টেবিলে বসেই শব্দ চষি আজকাল
ওখানেই তুমি বিছিয়ে দিও আঁকিবুঁকি কাগজের পলি
চাষাবাদে মন্দ নই, রক্তে তুমুল বইছে প্রপিতামহের উত্তারাধীকার।
তাম্রযুগে বসে পালকের ডগায় এঁকে যাব শব্দের মোনালিসা।

এলোচুলে বেঁধে দেব মেঘের আকাশ, মায়াবতী রাত
দূ’চোখের পাপড়িতে মেখে দেব নক্ষত্রের অত্যুজ্জ্বল মায়া
নাকের নোলকে ঘাসফুল ছাবি, দুটি গোলার্ধ নাচবে দুটি কানে
উষ্ণ ঠোঁটে মোহর এঁকে নেমে যাব কবিতার অন্তরাতে—
যেখানে কবির ঠোঁটে  তৃষ্ণা জাগে অবোধ শিশুর মত।
(ইকেবানা!)

উত্তরাধুনিকতা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আত্মানুসন্ধানের মুখোমুখি।প্রকৃতির পরিপূরক্তার ধারণা থেকে আত্ম-সম্পূর্ন্তার দিকে,স্বয়ম্ভুতার দিকে। আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা মধ্যে সবচে' বড়ভেদ হল একরৈখিক্তা ও বহুরৈখিকতা।উত্তরাধুনিকতার মূলে রয়েছে কেন্দ্রকে আঘাত করে বলয় ভেঙ্গে বহুরৈখিকতাকে টেনে আনার সক্রিয়তা। একরৈখিকতার টান যদিও পিছু ছাড়ছে না।কোনো এক কবিতায় কবি একরৈখিক হলেও সমগ্রে দেখা যায় তার বহুরৈখিকতা। এভাবেই একেকজন একেকভাবে তার নিজস্ব আঙ্গিকে জড় হচ্ছেন উত্তরাধুনিকতার বিস্তীর্ণাঞ্চলেঃ


যদি একদিন সত্যি থেমে যায় বৈকাল হ্রদ!
কি হবে যদি সত্যি থামে নাফাখুম  প্রপাতের ধারা?
শুনশান নিরবতায় বৃক্ষগুলো স্থিরপত্র দাঁড়িয়ে।
থেমে আছে নিঃশ্বাস, কন্ঠনালী নীল অজানা বিষে

রাত্রিবাস খুলে আকাশে বাইজী নাচে নটিনী চাঁদ
মৃত জোনাকির গল্পে ভেজে এইসব হরিৎ জোৎস্না
পানপাত্রে জমা হয় আরো কিছু গৌড়ী মদিরা
দূর কাশবনে ফুলে ফুলে কাঁদে বিষণ্ণ পানকৌড়ি

এই যে পাখী---একদিন নিশ্চিত থামবে তার গান।
এই যে  নদী--- সবটুকু জল সহ হতে পারে  উধাও

ফুলেরা সবাই ঝরে
কুসুমের দুষ্ট কীট একদিন সেও যায় মরে

পেয়েছিলে সদ্য জন্মানো দিন, নতুন সম্ভাবনা নিয়ে
কুমারীর কৌমার্যের সুখ-গন্ধটুকু নিয়ে হলে উধাও!
মৃতদের বুক থেকে আজো চুরি হয় প্যাপিরাস, রক্তে প্রত্ন খনন -
নষ্ট ফসিলের মত আমি শুধু বেঁচে আছি মাটির গভীরে।
(মৃত জোনাকির গল্প)

২টি মন্তব্য: